ওয়াক্ফ সংশোধিত আইন মুসলিমদের মৌলিক অধিকার খর্ব করবে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে-এ রকম একটি ধারণা থেকে ‘ওয়াক্ফ (সংশোধন) বিল-২০২৫’ নিয়ে অনেক আগে থেকেই অসন্তোষ ছিল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিলের বিরোধিতায় সরব হয়। তাদের দাবি ওই বিল ‘মুসলিমবিরোধী’।
৮ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গোটা দেশে কার্যকর হয় ওয়াক্ফ আইন। এর পরই আগুনে ঘি পড়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়। মুসলিম সমাজ যেমন পথে নামে, আলাদা করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও পথে নামতে দেখা যায়। তবে গোটা ভারতেই সে আন্দোলন বা বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ থাকলেও অশান্তির আগুনে জ্বলে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা।
গোটা ঘটনায় ডান-বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তরফ থেকেই নিন্দা জানানো হয়। সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর অভিমত ‘বিজেপি তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এ আইন এনেছে। কিন্তু প্রতিবাদ বা আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ইমাম ও মুয়াজ্জিন সংগঠনের সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এতে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।’ ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির দাবি, ‘রাজ্যে ওই আইন কার্যকর করতে না দেওয়ার বিষয়ে বিধানসভায় দ্রুত একটি প্রস্তাব আনা হোক।’ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘ওয়াক্ফ আইন নিয়ে কা— আপত্তি থাকতেই পারে।’
৯ এপ্রিল মুসলিমদের উদ্দেশে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বার্তা-‘আপনাদের মনে ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ে দুঃখ হতে পারে। কিন্তু ভরসা রাখুন, বাংলায় এসব কিছু হবে না। আমরা কোনো বিভাজন করব না। কেউ কেউ রাজনৈতিক কারণে আপনাদের উসকানি দিতে পারে। কিন্তু আপনারা সে উসকানিতে পা দেবেন না।’ ১৬ এপ্রিল কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও বিদ্বজ্জনদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে মমতার অভিযোগ ছিল, ‘এ সহিংসতার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত।’
কিন্তু বিভিন্ন সময় মুখ্যমন্ত্রীর শান্তির বার্তা দেওয়ার পরেও কেন অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, গোটা রাজ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। মুর্শিদাবাদের তিন তৃণমূল বিধায়ক রঘুনাথগঞ্জের আখরুজ্জামান, সুতির ইমানি বিশ্বাস এবং ফারাক্কার মনিরুল ইসলামরা এ অশান্তির নেপথ্যে বিরোধীদের উসকানির অভিযোগকেই দায়ী করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ‘সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে এখন থেকেই তারা (বিজেপি) ভোটের রাজনীতি করতে চাইছে।’ বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার ঘটনা কেন্দ্র করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল, তা থেকে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই ওয়াক্ফ আইন হাতিয়ার করে হিংসাত্মক আন্দোলন করা হয়েছিল এবং এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি পুরোপুরি সফল হয়েছেন। এদিকে সহিংসাতার পেছনে রাজনৈতিক লাভক্ষতির হিসাব রয়েছে বলে অভিমত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের সাবেক সংসদ সদস্য অধীর চৌধুরীর। তাঁর অভিমত ‘এ ধরনের বিভাজনের রাজনীতিতে একদিকে বিজেপির লাভ, অন্যদিকে তৃণমূলের লাভ হয়-এটা খুব সহজসরল অঙ্ক। কাদের বিপদ হয়? কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থি দলগুলোর। সে কারণে গতবার আমরা হেরেছি।’ তাঁর দাবি, ‘গত লোকসভা নির্বাচনে সমশেরগঞ্জে কংগ্রেস ব্যাপক ভোটে জিতেছিল। ফলে কংগ্রেসের দিকে ভোট চলে যাওয়া এবং তৃণমূলের হারিয়ে যাওয়া ভোট ফেরত আনার জন্যই ছোটখাটো সংঘর্ষের নাটক উপস্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। যারা সে নাটক উপস্থাপন করেছিল পরে হয়তো তাদের হাতের বাইরে চলে যায়।’ তাঁর দাবি, ‘মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘু মানুষ ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে আঘাতের কারণে প্রতিবাদ করতে চেয়েছে। তারা কখনো হিন্দুকে শত্রু মনে করেনি। তারা আইনের বিরোধিতা করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমেছিল। কিন্তু সে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে প্রবেশ করে কোনো অপশক্তি এটাকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করেছে।’ শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে অধীর চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশ যদি মনে করত তবে এ ঘটনা ঘটত না। পুলিশ মনে করেনি তাই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ কেন মনে করেনি, সেটা তদন্ত হওয়া দরকার।’ তাঁর প্রশ্ন-‘পুলিশ কি তাদের বাহিনীর মধ্যেই কারও অঙ্গুলিহেলনে নিশ্চুপ ছিল? তবে কি শর্ষের মধ্যেই ভূত ছিল?’