ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে আকরাম হোসেনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলেন আফজাল হোসেন মেরাজ। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বাসিন্দা। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে আকরামের সহযোদ্ধা। আকরামের মৃত্যুর বিষয় সম্পর্কে তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি নিজের চোখে আকরামের লাশ দেখেছি। তার লাশ এখনো ইউক্রেন সীমান্তে পড়ে আছে। মূলত ১৪ এপ্রিল আকরাম তাদের ইউনিটসহ ইউক্রেনীয়দের মিসাইল হামলার শিকার হয়ে সেখানে মারা যান। আমি তার লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করছি। তবে ফের হামলার দুশ্চিন্তায় সেখানে যাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এ সময় কাতর কণ্ঠে বলেন, এখানে আরও অনেক বাংলাদেশি যুবক রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করছেন। আমরা সবাই নিরুপায়। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করব তারা যেন দ্রুত আমাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন।
এ বিষয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাফে মোহাম্মদ ছড়া বলেন, আকরামের লাশ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। লাশটি এখন কোন স্থানে এবং কার হেফাজতে আছে সেই বিষয়ে তথ্য নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে নিহতের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকেও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
গত ১৩ এপ্রিল মায়ের সঙ্গে মোবাইলফোনে আকরামের শেষ কথোপকথন হয়। ওই সময় সে তার মাকে জানিয়েছিল- ‘আইচ্ছা আম্মা ভালো থাইকো, পরে আবার ফোন দিমুনে। আছি ভালোই, কিন্তু যেখানে কাজ করি, একটু আতঙ্কের মধ্যে থাকন লাগে। ড্রোন আসে তো, এগুলা দেখে চলাফেরা করন লাগে।’ এরপর টানা পাঁচ দিন ধরে সন্তানের ফোনের অপেক্ষায় মা মবিনা বেগম। কিন্তু ছেলের ফোন আর আসে না। তাই মায়ের অপেক্ষার প্রহরও শেষ হয় না। অবশেষে গতকাল শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) খবর আসেথ- আকরাম হোসেন আর নেই, প্রাণ হারিয়েছেন চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এরপর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন সন্তান শোকে কাতর মবিনা বেগম। তিনি শনিবার এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি আমার সন্তাদের লাশ একবার দেখতে চাই। আর যারা আমার ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছে, তাদের বিচার চাই। তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে পরিবারের হাল ধরেছিল। এখন কীভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আমি চাই সরকার যেন আমার ছেলের লাশ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনে। আকরামের বাবা মোরশেদ মিয়া বলেন, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ প্রথমে পোল্যান্ড নেওয়ার কথা বললেও প্রায় দেড় বছর ঘুরানোর পর জানায় পোল্যান্ডের ভিসা পাওয়া যাবে না। পরে জানায় রাশিয়ায় ভালো কাজের ভিসা আছে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা করেছে বলেই আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল আমার ছেলে। এখন আমি কীভাবে সংসার চালাব, কীভাবে দেনা পরিশোধ করব তা বুঝতে পারছি না। বাবার কষ্ট দূর করতে একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখে প্রায় ১০ লাখ টাকা ধারদেনা করে ৯ মাস আগে পাড়ি জমান রাশিয়ায়। সেখানে একটি চীনা কোম্পানিতে কাজ পান। এরপর সংসারে আসতে শুরু করে সচ্ছলতা। তবে আকরামের পরিবারের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পরিবারের অভিযোগ, মাত্র ৪ মাস কাজ করার পর বেতন বন্ধ করে দেয় চীনা প্রতিষ্ঠানটি। এরপর বেশ কিছু দিন বিনা বেতনে কাজ করেন। পরে সেখানকার দলালের ফাঁদে পড়ে চুক্তিভিত্তিক সৈনিক হিসেবে যোগ দেন রুশ বাহিনীতে। প্রথম প্রথম কষ্টের কথা জানালেও পরে পরিবারের সবার কষ্টের কথা ভেবে মেনে নেন যুদ্ধজীবন। প্রায় আড়াই মাস যুদ্ধজীবন কাটিয়ে ১৪ এপ্রিল প্রাণ হারান আকরাম। স্থানীয়রা দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। অন্যথায় এভাবেই আকরামের মতো তরুণরা পরিবারের জন্য সুখ আনতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে প্রাণ হারাবেন।