রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গ্রাম চরমাঝারদিয়াড়। দুর্গম যাতায়াতের কারণে এ এলাকায় এখনো পৌঁছেনি আধুনিক সুযোগসুবিধা। ফলে একমাত্র বিদ্যালয়ে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও নেই তেমন কার্যক্রম। সব মিলিয়ে মানবেতর জীবন এখানকার বাসিন্দাদের। বছরের সর্বোচ্চ তিন মাস পানিতে টইটম্বুর থাকে পদ্মা। বাকি সময় কেবলই ধু-ধু বালুচর। নদীর এপার-ওপার ঘিরে কেবল ছোট নালার মতো পানি দেখা যায়। এবারও তা-ই হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পদ্মা এখন পানিশূন্য। বালুর স্তরে আটকে আছে মাঝিদের ডিঙি। ওপারের চরের মানুষ দুর্গম পথ মাড়িয়ে হেঁটে আসছেন এপারে। আর বিশাল বালুরাশির ওপর দিয়ে চলছে গরু-মহিষের গাড়ি। অথচ দুই দশক আগেও এ সময়ে পদ্মায় জোয়ার থাকত। রাজশাহীর পবা, গোদাগাড়ী, বাঘা ও চারঘাট উপজেলার চরাঞ্চলে বসবাস প্রায় ২ লাখ মানুষের। আছে তিনটি ইউনিয়ন। সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহে। এসব চরাঞ্চলের মানুষের সবাই কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত। পবার মধ্যচরের চাষি আফাজ উদ্দিন বলেন, গেল বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙনের কবলে পড়ে বাপদাদার বসতভিটা হারান চরাঞ্চলের অনেক মানুষ। জীবনজীবিকার লড়াইয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যায় অনেক পরিবার। তবে নদীতে চর পড়ায় তারা আবারও ফিরে এসেছেন। দিনরাত এক করে চরের বুকে ফসলের আবাদ শুরু করেছেন। তাদের অভিযোগ, চরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও দিনের পর দিন তা বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎসুবিধা না থাকায় জেনারেটর তাদের ভরসা। স্কুলটিতেও ক্লাস হয় মাঝে মাঝে। হরিপুর ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমান রাশেদুল ইসলাম রাসেল জানান, বর্ষাকালে চরের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটে। শুষ্ক মৌসুমে আবার হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। নাগরিক সুবিধার সবকিছু থেকেই বঞ্চিত এখানকার মানুষ।
বাঘা উপজেলার পদ্মার চকরাজাপুর ইউনিয়নে আট চরে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের বসবাস। শুষ্ক মৌসুমে তারা হেঁটে নদী পার হন, বর্ষাকালে পানিবন্দি হয়ে পড়েন। বর্ষায় নদী পারাপারে একমাত্র ভরসা নৌকা। প্রতি বছর খরস্রোতা পদ্মা নদী পারাপারে নৌকাডুবিতে একাধিক ব্যক্তি মৃত্যুও ঘটে। চার মাস আগেও নৌকা দিয়ে পারাপার করতে হতো। তবে চলতি শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় পদ্মা এখন মরা খাল। কালীদাসখালী চরের গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতি বছর পদ্মা উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বন্যাসহ নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে উভয়সংকটে পড়তে হচ্ছে। চকরাজাপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, সড়কঘাটের খেয়াঘাট থেকে চকরাজাপুরের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। দুই মাস আগেও চরের হাজার হাজার মানুষ ব্যবসাবাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এ খেয়াঘাট থেকে নৌকাযোগে পদ্মা পার হয়ে উপজেলা সদরে যাতায়াত করতেন। দুই মাসের ব্যবধানে পদ্মা শুকিয়ে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। ফলে এলাকাবাসীকে পদ্মার চর হেঁটে পারাপার হতে হচ্ছে। রাজশাহীর সীমান্তঘেরা উপজেলা গোদাগাড়ী। পদ্মার তীরে জেগে ওঠা এ উপজেলার চরাঞ্চলে গড়ে উঠছে গ্রাম। এ চরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বাস। যার নাম চর আষাড়িয়াদহ। দক্ষিণে ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া আর উত্তরে পদ্মার পানি।
এ ইউনিয়নের মানুষ শহরের মতো জীবনযাপন না করলেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইতোমধ্যে নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তন করে বাড়িয়েছে শিক্ষার হার। এ চরে আছে দুটি হাইস্কুল, নয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি মাদরাসা ও পাঁচটি বাজার। চরের উর্বর জমিতে শত শত টন ফসল উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এ ফসল ফলাতে ও বাজারজাত করতে দুর্বিষহ কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের। চরে বসবাস করা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন নদীর চর থেকে কয়েক হাজার বস্তা টম্যাটো, পিঁয়াজ, ধান, গম, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকারের কালাই গোদাগাড়ী হয়ে শহরের বিভিন্ন বাজারে আসছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে চরের বিভিন্ন ফসল সরাসরি ঢাকার বাজারে যাচ্ছে। আবার প্রতিদিন এপার থেকে সার, বীজ, দোকানি পণ্যসহ অসংখ্য মালামাল পার করতে হচ্ছে কষ্ট উপেক্ষা করে। প্রতি বছর কয়েক লাখ টন আবাদ আসে চর থেকে। এমন সম্ভাবনাময় এলাকার সবচেয়ে বড় কষ্ট রাস্তাঘাট। উপজেলার ফুলতলা (ভাটোপাড়া) খেয়াঘাটের পার থেকে জমি ভাড়া নিয়ে চলাচলের জন্য প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা করতে হয়েছে নৌকা মাঝিদের। খেয়াঘাটের মাস্টার শরিফুল মাঝি জানান, ফুলতলা খেয়াঘাটটি এ এলাকার মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন এ ঘাট দিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ চলাচল করে। অথচ নৌকা থেকে নামার পর ঘাট থেকে এক-দেড় কিলোমিটার রাস্তা তাদের ভাড়া নিতে হয়। এতে প্রতি বছর তাদের ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। অনেকবার চেয়ারম্যানকে মৌখিকভাবে বললেও কোনো কাজ হয়নি। স্থানীয় চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম ভোলা বলেন, ‘আমাদের এপারে শুধু ওই রাস্তায় নয়, পুরো ইউনিয়নে রাস্তার বেহাল দশা। আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর বেশ কিছু রাস্তা মেরামত করে দিয়েছি। আবার কিছু পাকা করেছি।’