২৯ মার্চ, ২০২৪ ১৮:০০

অভাবে নরওয়ে দম্পতির কাছে দত্তক, ৪৯ বছর পর মা-মেয়ের দেখা

মাদারীপুর প্রতিনিধি

অভাবে নরওয়ে দম্পতির কাছে দত্তক, ৪৯ বছর পর মা-মেয়ের দেখা

মা ও মেয়ে

১৩/১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার মাদবরচর ইউনিয়নের পদ্মারচর গ্রামের ফিরোজা বেগমের। বিয়ের পর অন্তঃসত্ত্বা থাকতেই মারা যায় স্বামী বছির সরদার। অভাব অনটনের সংসার। এরই মধ্যে জন্ম নেয় একটি কন্যা সন্তান। নাম রাখেন মৌসুমী। সেই সন্তান লালন পালনের সামর্থ নেই ফিরোজা বেগমের। অভাব অনটনে বাধ্য হয়েই সন্তানকে ঢাকার মোহাম্মাদপুর এতিমখানায় দত্তক দেন। সময়টা ছিলো ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই। এরপর কেটে গেছে ৪৯ বছর। 

সেই এতিমখানা থেকে কন্যাকে দত্তক দেওয়া হয় নরওয়ের এক দম্পতির কাছে। সেই দম্পতির ঘরেই বড় হয়েছে মৌসুমী। নাম বদলে নতুন নাম হয়েছে এলিজাবেথ ফিরোজা। 

পাসপোর্টে তথ্য অনুযায়ী এলিজাবেথের জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই। এর পাঁচ মাসের মাথায় ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এতিমখানা থেকে তাকে দত্তক নিয়ে যায় নরওয়ের এক দম্পতি। সেই থেকেই মৌসুমী ওরফে এলিজাবেথ নরওয়ের বাসিন্দা। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জানতেনই না যে, কে তার আসল বাবা-মা।

নরওয়ের চিকিৎসক রয় রয়েড ও ক্যারেন রয়েড দম্পতি দত্তক নেওয়ার পর নাম রাখেন এলিজাবেথ ফিরোজা রয়েড। সেই দম্পত্তিই তাকে বিয়ে দেন। বিয়ের পর রয়েড বদলে হন ফাজালসেট। এরপর এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট অন্তঃসত্ত্বা হয়ে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন। সেই সময় চিকিৎসক তার পারিবারিক বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জানতে চান। তখনই প্রথম তার মা ও তার পরিবারের সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয় এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেটের। এরপর চার সন্তাানের মা হয়েছেন। এরপরই এলিজাবেথের মনে পড়তে থাকে মাকে। সেই থেকে মাকে খুঁজে চলেছেন। ২০১৩ সালে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন মায়ের খোঁজে। তবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। কিন্তু এবার আর ব্যর্থ হতে হয়নি মৌসুমী ওরফে এলিজাবেথকে। 

বৃহস্পতিবার মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পদ্মারচর গ্রামে গিয়ে পেয়েছেন মায়ের দেখা। দুজন দুজনকেকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক্ষণ কেঁদেছেন। সে এক অন্য অন্য রকম দৃশ্য। ৫০ বছর আগে মাত্র দেড় মাস বয়সে মায়ের কোল থেকে নরওয়ে যেতে বাধ্য হওয়া এলিজাবেথ ফিরোজা ফিরলেন তার মায়ের কাছে। 

যদিও জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে পেতে এলিজাবেথের এই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। সকালে একটি গাড়ি নিয়ে ঢাকা থেকে চলে আসেন মাদবরচর গ্রামের তারই বংশের একমাত্র ভাতিজা সেলিম সরদারের বাড়িতে এলিজাবেথ ফিরোজা ও তার জীবনসঙ্গী স্বামী হ্যানরি।
এলিজাবেথ তার মায়ের জন্য নতুন জামা-পায়জামা, কসমেটিক্সসসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসেন। পরে স্থানীয় একটি বাজার থেকে চাল, ডাল, চিনি, দুধ আটা ময়দা সেমাইসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী কিনে দিয়ে যান। আর নরওয়ে থেকে মেয়ে এলিজাবেথ যেন তার মাকে দেখেতে পরেন সেজন্য একটি মোবাইল ফোন কিনে দেবেন বলে জানান। কিন্তু কেউই কারো মুখের ভাষা বুঝতে পারছেন না। কেবলই আবেগ অনুভূতি দিয়ে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকালে আবার ঢাকায় ফিরে যান এলিজাবেথ ফিরোজা ও তার স্বামী হ্যানরি।

এলাকাবাসী জানান, ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই ঢাকায় ননদের বাসায় শিবচরের মাদবরচর ইউনিয়নের পদ্মারচর গ্রামের মৃত বছির সরদারের স্ত্রী ফিরোজা বেগম এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখেন মৌসুমী। সেই সময় ফিরোজা বেগমের আর্থিক অভাব অনটন ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৌসুমীকে মোহাম্মাদপুরের সমাজ কল্যাণ পরিচালককের কাছে দত্তক দেন। 

এলিজাবেথের মা ফিরোজা বেগম জানান, ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালে ওর বাবা মারা যায়। তখন আমার মাথার ওপর কোনো ছায়া ছিল না। আত্মীয়স্বজন অনেকের বাড়ি বাড়ি ঘুরছি। কোনো কূলকিনারা পাই নাই; কিন্তু কোলের মানিক রাস্তায় ফেলে আসিনি। রেখেছি সরকারের কাছে। বেঁচে থাকলে একদিন দেখা পাবই। এক সময় আমার কোলে আসবে, এই বিশ্বাস তো ছিলই। সেই বিশ্বাসই তো আজ ৫০ বছর পর সত্যি ঘটল। 

এ ব্যাপারে এলিজাবেথ ফিরোজা বলেন, ছোটবেলা থেকে নরওয়েতে বড় হয়েছি। নরওয়ের বাবা-মা নাম রাখেন এলিজাবেথ। বড় হয়ে জানতে পারি আমার জন্ম বাংলাদেশে। মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। তারপর থেকেই আমি ফিরাজো নামটাকে আমার নামের সঙ্গে যুক্ত করি। তবে ২২ বছর বয়সে প্রথম সন্তান প্রসবের পর ওই খানকার ডাক্তার আমার হিস্টরি জানতে চান। তখন থেকেই আমি আমার পরিবারকে খুঁজতে চেষ্টা করি। এ ব্যাপারে আমার স্বামী হ্যানরি ও সন্তানরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। সেখানে আমার ৩ ছেলে ও এক মেয়ে এবং নাতি-নাতনি হয়েছে। 
 
বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর