রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার অন্য নাম মুজিবুর রহমান

সমরেশ মজুমদার

স্বাধীনতার অন্য নাম মুজিবুর রহমান
কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউসের দোতলাটা ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, লিটলম্যাগ এবং গ্রুপ থিয়েটারের ছেলেমেয়েদের বারো ঘণ্টার আস্তানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঢেউ সেখানেও আছড়ে পড়ল। প্রতিদিন নতুন নতুন মুখ সঙ্গে নিয়ে পরিচিতরা সেখানে আসছেন। খবরের কাগজে, রেডিওতে সেই যুদ্ধের বিবরণ শুনে আমিও উত্তেজিত। ভারতবর্ষ যুদ্ধ করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আদায় করেনি। হ্যাঁ, অনেকেই শহীদ হয়েছেন, যাবজ্জীবন জেলে কাটিয়েছেন, মাস্টারদা বা বাঘাযতীন যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার ডাকে যোগ দেয়নি গোটা ভারতবর্ষ। কিন্তু বাংলাদেশের সামান্য কিছু রাজাকার ছাড়া সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রায় অসম এক যুদ্ধে। বুকভরা আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে প্রশিক্ষিত পাকিস্তান সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে তারা সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছেন। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সার্থক উত্তরসূরি এসব মানুষ বাঙালি, যাদের মাতৃভাষা আমারও ভাষা। মনে হচ্ছিল বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যাই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। কিন্তু পাশের টেবিলের দেবদুলাল দা বললেন, যুদ্ধ দুভাবে করা যায়। এক. যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে, দুই. দূর থেকে উৎসাহ আর সমর্থনের শক্তি জুগিয়ে। যারা আসছেন সীমান্ত পেরিয়ে তাদের সাহায্য করাও এক ধরনের যুদ্ধে অংশ নেওয়া। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কফি হাউস থেকে বেরিয়ে রেডিও স্টেশনে গিয়ে খবর পড়তেন। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হলো ভৈরবে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকসেনারা পিছু হটেছে। তার কণ্ঠস্বরে যে উৎসাহ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছিলেন তার প্রমাণ পরে পেয়েছি। মনে পড়ছে পল্লীর গায়ক অংশুমান রায়ের কথা। 'শোন একটি মুজিবরের থেকে' গানটি আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছিল। বিশেষ করে ওই লাইনটা। 'বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নাইকো শেষ।' আমরা অপূর্ব এক আবেগে জড়িয়ে গেলাম। দেবদুলাল দা রেডিওতে বাংলাদেশের খবর বলতেন 'সংবাদ পরিক্রমা' অনুষ্ঠানে। সেটা শুনত না এমন কোনো বাঙালি নেই। তার পরে-ই সেই রসিকতার গান কানে আসত, 'শিয়াল কান্দে, কুত্তা কান্দে, কান্দে ইয়াহিয়া, ও বন্ধুয়ারে_!' আমার বন্ধু করুণাসিন্ধু দে ছিল খাঁটি সিলেটী। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না দেবদুলাল দা, পাছে নিজের উচ্চারণ পাল্টে যায়। করুণাসিন্ধু হন্তদন্ত হয়ে এলো, পাঁচজনের একটি পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন, তাদের থাকার জায়গা নেই। অতএব আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এক দিনের মধ্যে পার্ক সার্কাস অঞ্চলে দুটি ঘরের একটা ফ্ল্যাট তদবির করে ভাড়া করিয়ে ওদের থাকার ব্যবস্থা করে খুব খুশি হয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের অনেক পরিবারে তখন বাংলাদেশের মানুষ মাথা গোঁজার জায়গা করেছেন। ভারতীয় সীমান্তে নতুন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী তৈরি হয়ে গেল। তখন 'জয় বাংলা' রেডিও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পরে ঢাকার বেইলি রোডের বাড়িতে বসে মুকুল ভাইয়ের মুখে সেই কাহিনী শুনেছি। এম আর আখতার মুকুল সেই জয় বাংলা রেডিওর দায়িত্বে ছিলেন। এই রেডিও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক রক্ত ঝরিয়ে অনেক প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। স্বাধীনতা পাওয়ামাত্রই কোনো দেশ সোজা হয়ে চটপট দাঁড়াতে পারে না। যারা এতকাল দখল করেছিল তারা তো সব সম্পদ চুষে নিয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা থাকায় সেই সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। আমি জন্মসূত্রে ভারতবর্ষের মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশে পা রাখলেই মনে হয় আমি যে স্বাধীন দেশে এসেছি সেটা আমারও দেশ। শরীরের না হোক আত্দার দেশ, ভালোবাসার দেশ। অংশুমান রায়ের গানের কথায় গলা মিলিয়ে বলতে পারি, 'একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি'। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল কাণ্ডারী তো এইটাই চেয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ানোর দিন।

সর্বশেষ খবর