রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র
প্রাচীন যুগে, জনপদের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অর্থাৎ আপন নিরাপত্তাবোধ থেকেই সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সমাজ আগে, না রাষ্ট্র আগে এ প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র, কেননা সমাজেরই ভিন্ন রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র। সমাজের আদি কাঠামো অর্থাৎ আদিম স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সৃষ্টির ব্যাপারে সমাজ উদ্যোগ নিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসে মেলে না। বরঞ্চ প্রমাণ আছে যে, রাষ্ট্র গঠনে সমাজসত্তা কোথাও কোথাও প্রতিরোধ রচনা করেছে, যদিও সে প্রতিরোধ কখনোই ফলপ্রসূ হয়নি। রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ ব্যর্থ হওয়ার একটি প্রধান কারণ হয়তো ধর্ম। বিশ্বাস করার কারণ আছে, সমাজ রাষ্ট্রের আগে ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়। যেহেতু ধর্ম এবং রাষ্ট্র উভয় সত্তাই সমাজের উদ্বৃত্তের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু প্রাথমিক পর্বে রাষ্ট্রের উত্থানকে ধর্ম একটি প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছে। অনুরূপভাবে রাজাও রাজধর্মের বাইরে অন্যধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করেছে। আন্দাজ করা যায়, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সর্বত্র শুরু হয়। এ সময় সামাজিক স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যেমন, পারস্যের রাজা সাইরাস দ্য গ্রেট [খ্রি. পূ. ৫৯০-৫২৯ অব্দ] ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সমান অধিকার প্রদান করে একটি অলঙ্ঘনীয় শাসনতন্ত্র ঘোষণা করেন। তারই সমকালীন রোমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিধান রাখা হয়, যদিও সে স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ ছিল কেবলই রোমান অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে। সুমেরীয় অঞ্চলের লাগাস নামক নগর-রাষ্ট্রের নেতা উরুকাগিনা ব্যক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। ইতিহাসে আমরা সর্বপ্রথম উরুকাগিনার মুখেই শুনি 'আমা-গী' বা নাগরিক অধিকারের কথা। পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাসের তথ্যানুসারে উরুকাগিনাই মানবজাতির প্রথম দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক যিনি মানবাধিকার নিয়ে চিন্তা করেন এবং নিজ রাজ্যে তা প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হন। ভারতে কিভাবে রাষ্ট্র বিকশিত হলো তা দেখা দরকার। ভারতে জনপদ থেকে রাষ্ট্র নির্মাণ প্রক্রিয়া একটু ধীরগতিতে অগ্রসর হয়। আর সি মজুমদার, হেনরি মেইন ও মেকক্রিনডিল মনে করেন, স্বাধীন গ্রাম সম্প্রদায়গুলো চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য [খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-২৯৭ অব্দ] ও তার উত্তরসূরি সম্রাট অশোক [খ্রি. পূ. ২৬৫-২৩৮ অব্দ], উভয় শাসকের আমলে প্রথম রাষ্ট্রাধীনে আসে। উভয় রাষ্ট্রনেতা মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। উভয় শাসকের নীতি ছিল কল্যাণমুখী। দার্শনিক ও রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের প্রতি তাদের ছিল পরম শ্রদ্ধাবোধ। দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ চাণক্য (আরেক নাম কৌটিল্য) ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের প্রধান উপদেষ্টা। চাণক্যের তত্ত্ব ছিল এই যে, রাজা হবেন কল্যাণমুখী। তার তত্ত্ব মতে, প্রজার প্রতি রাজার দায়িত্বপালন শর্তেই তিনি রাজা। তার পবিত্র দায়িত্ব এবং সর্বপ্রথম ও সর্ব প্রধান দায়িত্ব প্রজা পালন। চাণক্যের রাষ্ট্রচিন্তা তার অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন, প্রজাকুলের ওপর রাজার কোনো ক্ষমতা নেই, আছে শুধু দায়িত্ব, সবার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব, দুর্বল অসহায় মানুষকে ভরণপোষণের দায়িত্ব। চন্দ্রগুপ্তের মতো সম্রাট অশোকও চাণক্যের চিন্তাধারা অনুসরণ করেন। অশোকের শিলালিপিতে খোদাইকৃত নির্দেশাবলী থেকে জানা যায়, তিনি মনে করেন রাজা হিসেবে তার দায়িত্ব শুধু ব্যক্তির জীবন, ধন-মান রক্ষা নয়, পশুপাখিসহ সব প্রাণীর মঙ্গল সাধন করাও। প্রজাকুল ও প্রাণীজগতের ওপর তার নিজের দায়িত্ব এবং ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য লিপিবদ্ধ করে তিনি তা রাজ্যের জায়গায় জায়গায় প্রস্তর ও লৌহ খুঁটিতে খচিত করে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসব রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুমান করা চলে, প্রাচীন জনপদ, বাজার-বন্দরকে কেন্দ্র করে যেসব রাষ্ট্র তৈরি হয় সেগুলো প্রাথমিক স্তরে ছিল। আর সি মজুমদারের ভাষায় 'গ্রাম-প্রজাতন্ত্র'; আর হেনরি মেইন-এর ভাষায় 'গ্রাম-সম্প্রদায়'। গ্রাম-প্রজাতন্ত্র আর প্রজা যাই হোক, জনপদ থেকে রাজ্যে রূপান্তরকালে অন্তত কিছুকাল রাজন্যশ্রেণী প্রজাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু উত্তরকালে ভারতীয় রাজারা ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্রের কর্তাদের মতোই স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এবং এ রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ধর্ম। প্রজাতন্ত্র পতনের পর অধিকাংশ মানুষ রাষ্ট্র ও রাজন্যশ্রেণীর দাসে পরিণত হয়। পূর্বেকার সামাজিকসাম্যের বদলে সমাজ তখন বিভক্ত হলো রাষ্ট্রীয় আমলা-পুরোহিত শ্রেণী এবং দাসে। ব্যক্তি ও সমাজসত্তাকে পদদলিত করে কিভাবে স্বৈরতন্ত্রী রাজ্য তৈরি হলো তা নিয়ে তত্ত্বালোচনা প্রাচীনকাল থেকেই দেখা যায়। ভারতীয় বৈদিক তত্ত্বে যেমন আছে, আলো ও অন্ধকারে মানুষকে চক্রাকারে ঘূর্ণি খেতে হবে, এটাই বিধি বা প্রকৃতির নিয়ম। বৈদিক তত্ত্বমতে প্রাকৃতিক মহাসময়ে মানুষ চারটি যুগের মধ্যে চির ঘূর্ণায়মান-সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ। সত্যযুগ হলো মানুষের জন্য সুন্দর ও স্বাধীন যুগ। তার পরই পতনের পালা। সত্যযুগ থেকে ত্রেতা, দ্বাপর হয়ে কলিযুগে এসে মানুষ হারায় সব ধরনের ন্যায় বিচার ও শান্তি। এ সময় ব্রহ্মা সব ধ্বংস করে আবার নতুন করে সৃষ্টি করেন সত্যযুগ। মিসরীয় ও গ্রিক মিথলজিতেও অনুরূপ সমাজ বিবর্তনের তত্ত্ব রয়েছে। এটা ধর্মীয় তত্ত্ব এবং এমন তত্ত্ব সব ধর্মেই রয়েছে। ভালো ও মন্দ সময়ের জন্য ঐশী শক্তি ক্রিয়াশীল_ এমন তত্ত্ব ব্যক্তি ও সমাজ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী অস্ত্র বটে। মানব ইতিহাসের এটা একটা করুণ দিক, সময়ের ব্যবধানে ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক স্বাধীনতা হারিয়ে পরিশেষে মানুষ তার নিজ দেহের ওপরও অধিকার হারায়। ফলে সে শাসকশ্রেণীর দাসে পরিণত হয় এবং দাস ও তার স্ত্রী-সন্তানাদি মালিকের হস্তান্তরযোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত হয়। লর্ড অ্যাকটন দেখিয়েছেন, আগ্রাসী রাজন্যশ্রেণী প্রথম পরাজিত করে রাষ্ট্রের জনগণকে এবং সৃষ্টি করে শক্তিশালী সেনাবাহিনী। শুরু হয় রাজ্য বিস্তার ও মানুষকে পদানত করে শোষণ করার নীতি। শুরু হয় মানুষকে সামন্তপ্রভুর দায়বদ্ধ কৃষকে পরিণত করার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকেই শুরু অধিকারহীন পরাজিত মানুষকে দাস, আধা দাস ও ভূমি দাসে পরিণত করার পালা। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সামন্ত যুগ। সামন্ত যুগ ব্যবস্থায় ব্যক্তি থাকে, কিন্তু তার সত্তা থাকে না, অধিকার থাকে না, থাকে না কোনো পরিচয়। সামন্ত ব্যবস্থায় সবাই একে অপরের অধীনস্থ, পরিশেষে সবাই শাসক শ্রেণীর সম্পত্তি। এ পর্যায়ে শাসকশ্রেণী দুটি শক্ত খুঁটির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই খুঁটি দুটি হচ্ছে ধর্ম ও শাসন। প্রাথমিক যুগে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ছিল তা এ পর্বে নিরসন হয়ে উভয় শক্তি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে আবিভর্ূত হয়, যদিও অনেক সময় কোনো কোনো শক্তিশালী শাসক নিজের ওপর দেবত্ব দাবি করে ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টায় অনেক শাসক সাময়িক সাফল্য অর্জন করলেও পরিশেষে কেউ শেষ রক্ষা করতে পারেনি। শাসক কর্তৃক ব্যক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা পতনের ব্যাপারে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায়, এশীয় সমাজের তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় না। এখানেও ব্যক্তি ও সমাজসত্তাকে পদানত করে উত্থান ঘটে রাজতন্ত্রের। স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট ছোট জনপদগুলোকে ধ্বংস করে স্থাপিত হয় রাজ্য, রাজ্য থেকে সাম্রাজ্য। একটি সাম্রাজ্যের শাসকশ্রেণী ছাড়া সবাই অধিকারহীন দাস। ভারতে অশোকের শাসন পর্যন্ত ব্যক্তিসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। গুপ্ত, পাল ও তুর্কি সাম্রাজ্য স্থাপনের মাধ্যমে আবির্ভাব ঘটে ইউরোপীয় সামন্ত শ্রেণীর সঙ্গে তুলনীয় স্থানীয় রাজন্য ও ভূস্বামীশ্রেণী যার অধীনে সাধারণ মানুষ হারায় তার সব সত্তা ও স্বাধীনতা। ইউরোপীয় সামন্ত শ্রেণীর ও ভারতীয় ভূ-স্বামী শ্রেণীর মধ্যে মিল-অমিল দুটোই লক্ষ্যণীয়। পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিষয়ে বিতর্ক আছে যে, ভারতীয় ভূ-স্বামী শ্রেণী ইউরোপীয় সামন্ত শ্রেণীর সঙ্গে তুলনীয় কিনা। কেউ বলেন উভয়ই এক জাতের সামন্তবাদ, আবার কেউ বলেন ভারতীয় সামন্তশ্রেণী এক ভিন্ন জাতের সত্তা। মিল-অমিল যাই থাক না কেন, বাস্তব সত্য এই যে, ব্যক্তিসত্তা এখানে অনুপস্থিত। ইউরোপে সাধারণ কৃষক সামন্তের দাস। ভারতে তারা শূদ্র এবং দাস উভয়ই। চীনের বেলায়ও একই সত্য বিরাজমান। চীনের সামন্তরা সম্রাটের খুঁটি, উৎপাদক শ্রেণীর প্রভু। ভারত ও চীন উভয় অঞ্চলে নানা ধরনের সামন্ত ব্যবস্থা সাধারণ মানুষকে দাসতুল্য করে সমাজ কাঠামো তৈরি করেছে। এ কাঠামোয় দুটি শ্রেণী দেখা যায়_ শাসক ও দাস। উনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকেই আইনগতভাবে দাসপ্রথা বিলোপ করার উদ্যোগ আসে ইউরোপ থেকেই। এর কারণ হিসেবে ইউরোপে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানববাদী ও উদারনৈতিক আন্দোলনগুলোকে অনেকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে দার্শনিক তত্ত্ব আমরা প্রাচীনকাল থেকেই পাই। কিন্তু এতে শাসক শ্রেণী ব্যক্তিকে অধীনস্থ করার প্রচেষ্টায় বিরত থেকেছে এমন প্রমাণ নেই। কোনো ধর্মই দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়নি; যদিও কোনো ধর্মই দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধও করেনি। দাসোত্তরযুগে, বৈশ্বিকভাবে মানুষকে অধীনস্থ করে শাসন করার নতুন ধারা সৃষ্টি করল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ। প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বের পিছিয়ে-পড়া জাতিগুলোকে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার অনেক ছুতো ছিল। প্রধান ছুতো ছিল সভ্যতার বিস্তার। সভ্যতার দাবিদার ছিল সাম্রাজ্যবাদীরা। বুঝি-বা অন্যেরা সবাই অসভ্য। অতএব সভ্যতার খাতিরে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সাম্রাজ্যবাদীদের নৈতিক দায়িত্ব। উল্লেখ্য, এমন মনোভাব ছিল আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের আগেও। রোমান সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, তুর্কি সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য এবং চৈনিক সাম্রাজ্যগুলো প্রজাশ্রেণীর সংস্কৃতিকে অসভ্যতার প্রতীক হিসেবেই দেখেছে। সবশেষে বিশ্ব প্রেক্ষাপট ছেড়ে আমরা বাংলার মানুষের ব্যক্তিসত্তা, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করব। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সমাজের আদলে বাংলার সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা ধরনের দাসত্ব প্রথার প্রচলন দেখা যায় প্রাচীন যুগ থেকেই। তবে সুলতানি সরকার অমুসলমানদের জিম্মি হিসেবে ঘোষণা করলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়। জিম্মিরা জিজিয়া কর প্রদান করে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করার বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই পায়। মুঘল সরকার অমুসলমানদের ওপর জিজিয়া কর আরোপের ব্যাপারে বেশ নমনীয়তা দেখালেও দাসপ্রথা আরও জোরদার করে তোলে। এর প্রধান কারণ দাসশ্রমিক। মুঘল সৃষ্ট জমিদার ও ফৌজদার শ্রেণীর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে মূলত দাস শ্রেণীকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার সর্বনিম্নে পেঁৗছায়। সুলতানি-মুঘল রাষ্ট্রে দাসত্বপ্রথা থাকলেও সমাজের উচ্চবর্গের লোকেরা রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখত। দক্ষতা ও মর্যাদাবলে তাদের অনেকের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আমির উমারাহ পদে পর্যন্ত আসীন হতে পারত। নবাবী আমলের আমির উমরাহদের একটি বড় অংশ ছিল দেশীয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দফতরে রাষ্ট্রীয় কাজে দায়িত্ব লাভ করেছে দেশীয় অভিজাত শ্রেণীর লোক। কিন্তু কোম্পানি আমলে এবং কোম্পানি শাসনের পরে রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশীয়দের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। উনিশ শতকের প্রথম সিকি পর্যন্ত দেশীয়দের জন্য খোলা ছিল একমাত্র নিম্ন পদের কেরানি, পাইক, পেয়াদা, বরকন্দজ, সিপাহি-এর পদ। রাষ্ট্রে সমগ্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে শ্বেতাঙ্গরা। শ্বেতাঙ্গ আমলাদের ওপর ন্যস্ত ছিল লাগামহীন ক্ষমতা এবং সমগ্র দেশ শাসিত হতো তাদের দ্বারা। ভারতবর্ষে কয়েকশ শ্বেতাঙ্গ আমলা দ্বারা কোটি কোটি মানুষের শাসনভার সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছে শুধু এ জন্য যে, কোম্পানি আমলে ব্যক্তি ও সমাজের সত্তা ও অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়েছে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি ও ত্রাস সঞ্চারের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া হয়েছে সাত খুনের মাফ পাওয়া অনুগত জমিদার শ্রেণীর। প্রথাগতভাবে ভূমির মালিক রায়তশ্রেণীকে বঞ্চিত করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে দেশের প্রায় পাঁচ হাজার জমিদারকে করা হয় ভূমির একচ্ছত্র মালিক। রায়তকে পরিণত করা হয় জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রাধীনে কোনো স্বাধীন ব্যক্তি ছিল না। ছিল শুধু সত্তাহীন অধীনস্থ প্রজা। সে অধীনতাও ছিল আবার ওপর থেকে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত_ সরকার, জমিদার, তালুকদার, পত্তনিদার, হাওলাদার, জোতদার, কুৎকিনদার। সবাই একে অপরের মনিব এবং সব মনিবই প্রজার উৎপাদনের অংশীদার, যদিও কৃষি উৎপাদনে তাদের কোনোই ভূমিকা ছিল না। ঔপনিবেশিক সরকার জমিদারকে প্রজার ওপর সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় জমিদারকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনা ও দৈনন্দিন প্রশাসন ক্ষেত্রে শাসিত শ্রেণীকে সম্পূর্ণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। নানা সংস্কারের মাধ্যমে এ অযোগ্যতা ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে অবশেষে ইংরেজের বিদায় ঘটল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ইংরেজ প্রণীত শোষণ ও বঞ্চনাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা টিকে থাকল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির পর মনিব হিসেবে জমিদারের বিদায় ঘটল বটে, কিন্তু অন্যান্য মনিব ভিন্ন অবয়বে টিকে থাকে, যা কিনা বর্তমানেও বিদ্যমান। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমান বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ভূমিহীন যা কিনা ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্র-চরিত্রকেও অতিক্রম করে গেছে। একই চিত্র বিদ্যমান নগর জীবনেও। নগরের অধিকাংশ মানুষ কর্মহীন, আশ্রয়হীন, স্বাস্থ্যহীন। খোদ রাষ্ট্র দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাবে পরিচালিত হচ্ছে। শাসনতন্ত্রে যদিও তাত্তি্বকভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। এক কথায়, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাহীনতার ব্যাপারে বর্তমান বাংলাদেশ অতীতকে অতিক্রম করেছে, সামাজিক অগ্রযাত্রা সূচনা করা তো দূরের কথা।

সর্বশেষ খবর