রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

পা ও গ্রেনেড

সেলিনা হোসেন

পা ও গ্রেনেড
সাদা রঙের ওপর বেগুনি লতাপাতা-ফুল আঁকা কোটা শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয় সামিনা। বেশ লাগছে দেখতে। মুগ্ধতা তো নিজেকে নিয়ে নিজের উপলব্ধিতেই গাঢ় হওয়া উচিত। অন্যরা কে কী বলে তা নিয়ে আনন্দের রেশ ছড়িয়ে যায়, তার বাইরে গভীর অনুভব তৈরি হয় না। বাতাসের এক ঝটকায় উড়ে যাওয়া কোনো ক্ষুদ্র বস্তুর অনুভব আটকে থাকে কেবল। সামিনা ছোট ঘরের চারদিকে তাকায়। নিম্নবিত্ত পরিবারের ঘর-ছোটখাটো-প্রায় ছেঁড়া তোশক এবং রং-জ্বলা বিছানার চাদর, দেয়ালে ঝোলানো আয়না, পড়ার টেবিল নিয়ে দুই বোনের ঘর। ও তেইশ বছর বয়সের আগেই বুঝে গেছে যে, নারীর নিজস্ব ঘর হয় না। জীবনের ক্ষণিকের অনুভব নারীর মতো কে আর উপলব্ধি করে? তার পরও ঘরের জন্য ভীষণ মায়া নারীর। আকস্মিকভাবে মায়ের জন্য প্রবল মমতা অনুভব করে ও। হাঁড়িকুড়ির দিনযাপন। বুঝলই না পৃথিবী কী, বেঁচে থাকা কেমন, জগৎটা কত অন্য রকম হতে পারে এক জীবনে। তার মেয়ে হয়ে ও নিজে অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করে। বোঝাটা যেন ভুল না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকে। এই মুহূর্তে ও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় ঘরের স্বপ্ন। জানে বিষয়টা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। তার পরও। শাড়ির অাঁচলটা বুকের ওপর টানটান করে পিঠের ওপর ব্লাউজের সঙ্গে সেফটিপিন আটকায়। আবারও নিজেকে বলে, বেশ লাগছে দেখতে। পাঁচ কি ছয় ইঞ্চি লম্বা এই শরীরটা নিজের রাখতে পারবে তো? নাকি অন্যের দখলে চলে যাবে? নিজেকে এখন শক্ত করে। ওই ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে তো, যারা বলে দারুণ ফিগার! রাস্তায় বেরোলে প্রায়ই তো শুনতে হয় শিসের শব্দ এবং একই সঙ্গে একটি শাণিত বাক্য, শ্যামলা পরী। ওর ফিগারের সঙ্গে এমন গায়ের রংই তো মানায়। এসব মন্তব্যে ও ঘুরে দাঁড়ায় না। উপেক্ষা করে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে। ও জানে না ওই শিসের পাথরটা খুব ভারী। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজব্যবস্থা_ সবই ওই শিসের পক্ষে। আইনও কাজ করে না বহু ক্ষেত্রে। শুধু ওর হাসি পায়। পরী আবার শ্যামলা হয় নাকি? কখনো কেউ তো পরীকে শ্যামলা ভাবে না। ভাবে ফরসা ও উজ্জ্বল। পরীকে শ্যামলা ভাবে না। সাদা রঙের দাপট তো বোঝা যায় টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন এবং করপোরেট বিশ্বের পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়। সাদা সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ, শ্যামলা নয় কিংবা খুব কালোও নয়। এসব ও ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় বুঝতে শুরু করেছিল, এখন সে বোঝা আরও যুক্তিযুক্ত হয়েছে। বিয়ের পাত্রীর বিজ্ঞাপনে ফরসার আধিক্য শ্যামলা রং নিয়ে ন্যাকামি করার সুযোগ দেয় না। ও মাথা অাঁচড়ায় না। মাথাভর্তি লম্বা চুলের খোঁপা বাঁধে। সাদামাঠা হাত খোঁপা। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে আবার ভাবে, রাস্তার ছেলেদের শিস এবং মন্তব্য গায়ে মাখলে শরীরে ছোলতা পড়বে। ইভ টিজিং নিয়ে যতই চেঁচামেচি হোক না কেন ও নিজের নিয়মে সেটা মোকাবিলা করে। ওর নিজস্ব চিন্তার জায়গা আছে। ও জানে বয়সের ধর্মে এটা একটি সরল হিসাব। উপেক্ষা করাই ভালো। একে যদি রুখতে হয় তাহলে স্যান্ডেল খুলতে হবে শিস আর মন্তব্যের বাড়াবাড়ি হলে। কাজটা খুব কঠিন হয়। প্রতিরোধের সাহসটাই প্রধান। সামিনা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাইরে এলে বারান্দায় মায়ের মুখোমুখি হয়। মাকে সব সময় বিধ্বস্ত এবং ক্লান্ত দেখায়। মুখে হাসি নেই। তেলেঝোলে শাড়িটা প্রায়ই নোংরা থাকে। নিজের দিকে তাকানোর সময় তার নেই। সামিনা বোঝে যে ইচ্ছেও নেই। বাবার সঙ্গে পারে না। বাবার খেয়ালখুশির কাছে পরাস্ত নারী। ওকে দেখে মৃদু হেসে বলে, তোকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে। দেখাবেই তো। আমি যে তোমারই মেয়ে। মামা-খালারা বলে, আমি একদম তোমার মতো দেখতে হয়েছি। আমার মতো? আমি কি জানি যে আমি কেমন? চলো আয়না দেখি। আয়না? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিনার মা আমিনা বেগম। বলে আজ ক্লাস আছে? হ্যাঁ, মা। মিটিং-মিছিল নেই? আজ নেই। যাক বাঁচলাম। আমিনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সামিনা মৃদু হেসে বলে, আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি তোমার মতো বাঁচতে পারব না। আমি বেঁচে থাকার জায়গা তৈরি করে বাঁচব। নইলে মরব। কোনোটাতেই আমার ভয় নেই। আমিনা বেগমের মুখ শুকিয়ে যায়। কথা বাড়ায় না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে শূন্য উঠোনে ফেলে। যেন দৃষ্টির শূন্যতা মেয়েটা দেখতে না পায়। সামিনা মায়ের পিঠে হাত রেখে বলে, আসি মা। আমিনা বেগম ঘাড় নাড়ে। যে ঘাড় নাড়ায় কিছু বোঝা যায় না। ঘাড়টা যন্ত্রের মতো নড়ে। সামিনা জানে মায়ের দুঃখবোধ বুকের গভীরে শক্ত হয়ে আছে। ওটা থেকে মায়ের কোনো মুক্তি নেই। ও উঠোন পেরিয়ে গেট খুলে বের হওয়ার সময় পেছন ফিরে তাকায়। মা ঘরে ঢুকেছে। তবু বারান্দায় অদৃশ্য মায়ের ছায়া লুটিয়ে থাকে। ও জানে মায়ের পোড়খাওয়া জীবনে পুরুষের অদৃশ্য শিস আর মন্তব্য আছে। ওর মা সেসবের অর্থ বোঝে না। ঘর অাঁকড়ে ধরে জীবনটা পাড়ি দিচ্ছে কেবল। গলি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনতে পায় পাড়ার বখাটের মন্তব্য। মেয়েটার দেমাগ বেশি। রাজনীতি করে তো! রাজনীতি করা মেয়েরা বোঝে বেশি। সামিনার চোখের সামনে সোনালি আকাশ বর্ণাভ হয়। মনে হয় গলিটা পল্টন ময়দানের জনসমুদ্র হয়ে গেছে। ও তখন নিজেকে আবিষ্কার করে বড় সংযোগে নিজেকে স্থাপনের আবিষ্কার। নিজে বলে, আমার আসমুদ্রহিমাচল চাই। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালায়, বাবার কাছ থেকে কিছু নেয় না। বাবা তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। ওকে যত্ন করে, ভালোবাসে, কিন্তু ওর মনে হয়েছে সামর্থ্য থাকলে নিজেকে অন্যের ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা নীতিবিরুদ্ধ কাজ। বরং ও মাঝে মাঝে নিজের খরচ বাঁচিয়ে কিছু টাকা ওর পালক বাবাকে দিয়ে আনন্দ পায়। দেখতে পায় লোকটার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লোকটা নিজের খুশি আড়াল করে না। করবে কেন, তার কাছে তো টাকাটা মুখ্য নয়, মুখ্য নয় মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া। সে মেয়েটির দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছিল এবং কোনো রকম অবহেলা না করে দায়িত্বটি পালন করেছে। বরং মেয়েকে খুশি করার জন্য বলে, তোর উপার্জন মা? আহারে, গরিব বাপকে সাহায্য করার জন্য তোর কষ্ট দেখে আমার চোখে পানি আসে। আমার কোনো কষ্ট হয় না বাবা। হয়, হয়। তুই আমাকে বুঝতে দিস না। অথচ এই একই লোক নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে না। কোথায় যেন দূরত্ব তৈরি করে রাখে। সে দূরত্বের স্বরূপ সামিনা ধরতে পারে না। বেশি ভাবলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এখনো তো প্রেমে পড়েনি। যে দু-একজন কাছে ভিড়তে চেয়েছিল, তাদের ও সুযোগ দেয়নি। তাই পুরুষ চেনা শুরু হয়নি। কেমন করে বুঝবে যে কোন ফাঁকে কত জল গড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জানালা দিয়ে দ্রুত সরে যায় দালানকোঠা, দোকানপাট, গাছগাছালি, মানুষ আর মানুষ। দৃশ্যটি অলৌকিক মনে হয় কখনো। কারণ, ছোটাটা সত্যি হয়ে ওঠে। থামা নিষ্ক্রিয়। পাশে বসে থাকা মেয়েটি ওর দুই বছরের ছোট। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে কেবল। বলে, সামিনা আপা, আপনার নোটগুলো আমাকে দেবেন? নোট? আমি তো নোট করি না। নোট করেন না? একদমই না। আমি মূল বই পড়ি। তারপর পরীক্ষা দিই। বাব্বা, আপনি তো ভীষণ সাহসী। আমি নোট মুখস্থ না করে পরীক্ষার হলে যেতে পারব না। সামিনা মৃদু হেসে বলে, দেখো দেখো কী সুন্দর একটা দৃশ্য! ইশ্, আমি দেখতে পেলাম না। কী ছিল সেই সুন্দর দৃশ্য? ওই দৃশ্য বলার না, শুধুই নিজের চোখে দেখার। আমি আপনার মতো করে দেখতে শিখব সামিনা আপু। সামিনা শব্দ করে হাসে। আশপাশে ছেলেমেয়েরা ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখে। ও বিব্রত হয় না। হাসতে থাকে। ছেলেমেয়েদের কৌতূহলী দৃষ্টি ওকে ঘিরে ধরে। ওর মনে হয় ওর পেছনে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে। ও একটি বিশাল মিছিলের নেতৃত্বে আছে। অধিকার আদায়ের লড়াই। গুমগুম শব্দটা। আকাশ-পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। বাসের চাকার ঘরঘর শব্দ সেই ধ্বনিকে ছাপিয়ে বড় হতে পারছে না। পুরো বাস আশ্চর্য নিশ্চুপ। কারও মুখে কথা নেই। এক সময় ও কোলের ওপর রাখা বইয়ের পাতা উল্টায়। সাঁই সাঁই সরে যায় ধানখেত, জলাভূমি, কারখানার দালান কিংবা বিলবোর্ড। ও প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া মেয়েটির থুঁতনি নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, রাজনীতির অর্থ নিজের অধিকার বোঝা এবং সমাজকে চেনা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও। রাষ্ট্র গণতন্ত্রের চর্চা না করলে জনগণের মিত্র হতে পারে না। আর যে রাষ্ট্র জনগণকে উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, সে রাষ্ট্র জনগণের শত্রু। সামিনার কথা শুনে ছেলেমেয়েরা নড়েচড়ে বসে। প্রত্যেকের চোখ ফেরানো থাকে ওর মুখের দিকে। সামিনা হাসতে হাসতে বলে, আমরা এসে গেলাম। তখন প্রথম বর্ষে পড়া মেয়েটি ওর হাত চেপে ধরে বলে, বোমা কী সামিনা আপু? হো হো করে হেসে ওঠে বাসের ভেতর বসে থাকা ছেলেমেয়েরা। কে যেন ব্যঙ্গ স্বরে বলে, বোমা বোঝো না কচি খুকু? তুমি বোমা খেতে চাইলে তোমাকে আমরা বোমা খাইয়ে দেব। তখন বুঝবে বোমা কী! আবার হাসির তোড়ে ভেসে যায় বাসের পেট। মেয়েটি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, আমি জানতে চেয়েছি যে বোমা কীভাবে বানায়। এসো। নামতে হবে। সামিনা ওর হাত ধরে। বাসটা গেটের সামনে সশব্দে থামলে ছেলেমেয়েরা হুড়মুড়িয়ে নামে। ছোট মেয়েটি বিড়বিড় করে বলে, এদের কোনো ধৈর্য নেই। এরা আচরণ শেখেনি। সামিনা ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে দেখে। তোমার নাম কী? রোদেলা। বোমার কথা মনে এলো কেন? আসবে না কেন? বোমা খেতে হবে বলে? হ্যাঁ। মেয়েটি দ্রুত পায়ে চলে যায়। ওর লম্বা বেণি পিঠের ওপর দুলতে থাকে। সামিনার চারপাশে আরও অনেকে জড়ো হয়। ওর কথা বলতে বলতে এগোয়। রাষ্ট্রের নানা অপরাধ ওর কাছে স্পষ্ট হয় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঘেরা পথে একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনতে পায় ছেলেরা তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছে, যুদ্ধটা শেষ হয়নি। আরেকটি যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। যুদ্ধ কী? শান্তা ব্যঙ্গ করে। ওর ধারালো কণ্ঠে হিসহিস ধ্বনি। যুদ্ধ কী? জুবায়েরও একই কণ্ঠে স্তব্ধ করে দেয় সময়। আর সামিনা সময়ের টুঁটি চেপে ধরে বলে, যুদ্ধ হলো বোমা আর গোলার মহোৎসব। মানুষের রক্ত আর জীবন এবং সবশেষে সিজ ফায়ার। বিরতির পর আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি। মাঝের সময়টুকুতে শিশুদের বেড়ে ওঠা দেখা। একদল মানুষের কালো টাকা বানানোর মেশিনে কয়লা গুঁজে দিয়ে অপলক সে আগুনের দিকে তাকিয়ে দেখে পুড়ে মরার জন্য নিজেদের ডানা গজাতে দেখা। সামিনার কথা বন্ধ হলে হা হা করে হাসতে থাকে ছেলেমেয়ের দল। গাছের ফাঁকে বাতাসের সরসর শব্দ ওঠে। কারা যেন প্রেতাত্দা কণ্ঠে বলছে, দারুণ রংধনু সময় আমাদের চারদিকে। এত রং আমরা কখনো দেখিনি। আগুনের এমন অপরূপ শিখাও। তখন ওরা শুনতে পায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে অদ্ভুত ঘণ্টাধ্বনি। কিছুতেই থামে না সে শব্দ। এ কিসের সংকেত? থামে না কেন? চারদিকে ছুটোছুটি। সব ছেলেমেয়ে ক্লাসরুম ছেড়ে বাইরে চলে এসেছে, শিক্ষকরাও। যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গাছের পাতা ঘণ্টা পেটাচ্ছে। ভবনের ইটগুলো ঘণ্টা হয়েছে। ঝিলে ভেসে থাকা পাখির ঝাঁক, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, পিঁপড়ে ঘণ্টা হয়ে গেছে। চারদিকের অদ্ভুত শব্দে বিমূঢ় মানুষেরা স্তব্ধ হয়ে গেছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। সামিনা বিড়বিড় করে বলে, আমাদের জীবনে একটা কিছু ঘটবে। আমাদের পাপে ডুবে গেছে দেশ। পরিত্রাণের জন্যই আবার যুদ্ধ। বিকেলে বাড়ি ফিরলে আমিনা বেগম ভ্রূ কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। বলে, কী হয়েছে মা? বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছেলে খুন হয়েছে। খুন তো হামেশাই হচ্ছে। তোর মন খারাপ কেন? তোমার খারাপ লাগছে না মা? আমিনা বেগম চুপ করে থাকে। মেয়ের ঝাঁজালো কণ্ঠ টের পায়। কিন্তু তার পরও খুনের ঘটনা তাকে তেমন তাড়িত করে না। হরহামেশার ঘটনায় উতলা হওয়ার কী আছে। চা খাবি? না। চিৎকার করে না বলে সামিনা নিজের ঘরে ঢোকে। ছেলেটি ওরই দলের ছেলে। মৃত্যুটা ওর কাছে সহজ নয়। আমিনা বেগম পিছে পিছে এসে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। সামিনার দুই চোখ জলে ভরে গেছে। দুহাতে চোখ মুছে বলে, কিছু বলবে? আজ তোর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। আমার মনে আছে মা। মানুষটার কবরটাও এ দেশে নেই। বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার বয়স ছিল তোমার পেটে ছয় মাস। বাবা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। আমিনা বেগম দরজা ছেড়ে সরে যায়। সামিনা জানে এই দিনটি ওর মায়ের বিশেষ স্মৃতি। ওরা দুজন ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ এ দিনের খবর জানে না। সামিনা নিজের বাঙ্ খুলে একটি পুরনো ছবি কাপড়ের ওপর রেখে ব্যাগ থেকে কয়েকটা বকুল ফুল বের করে ছবিটা ঢেকে দেয়। তারপর বাঙ্রে ডালা বন্ধ করে। ভারতের কোনো জায়গায় যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে ওর বাবা, সে খবর ওর আর পাওয়া হয়নি। বাবার জন্য এখন আর ওর কান্না নেই। ও শুনতে পায় রান্নাঘরে ভাইবোনদের হইচই। আমিনা বেগম ছেলেমেয়েদের খাবার দিতে ব্যস্ত। একটু পরেই বকুল ফুলের মৃদু গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে যায়। সামিনা বড় করে শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর ভীষণ কান্না পায়। সে সময় কলেজ থেকে ফেরে রুবিনা। দুই বোন পরস্পরের দিকে তাকায়। রুবিনা হাতের মুঠি খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, আমিও তোমার শহীদ বাবার জন্য এক মুঠি বকুল এনেছি। এবারও বুঝি তুমি ছবিটা বাঙ্ েরেখেই ফুল দিয়েছ? বলতে বলতে রুবিনা বাঙ্রে ডালা খোলে। ছবিটা বের করে দুই বোনের পড়ার টেবিলের ওপর রাখে। এখন থেকে ছবিটা এখানে থাকবে। যদিও আমি জানি আমার বাবা পছন্দ করে না। আর আমার বাবার ভয়ে তুমি তোমার শহীদ বাবাকে আড়াল করে রাখো। সামিনা কথা বলতে পারে না। রুবিনার আচরণ ওকে হতবাক করে দেয়। কবে রুবিনা এত বড় হয়ে গেল। হা করে দেখছ কী? এখন থেকে ছবিটা এখানে থাকবে। আমি স্টুডিওতে নিয়ে এর একটি বড় সাইজ করে বাঁধিয়ে নিয়ে আসব। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কি জানো, আমিও যদি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হতাম! রুবিনা! দুই বোন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। দুই বোনের জড়াজড়ির মধ্যে যুদ্ধের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে যুদ্ধ ওরা দুজনের কেউই দেখেনি। সামিনার মনে হয়, রুবিনার রাজনীতি অনেক শক্ত। অনেক জোরালো। রুবিনা মিছিলে না গিয়েও রাজনীতি বোঝে, আজ থেকে এই বাড়িটার প্রতিপক্ষের সঙ্গে রুবিনার লড়াই। সামিনা যে পারিবারিক শাস্তির ভয়ে বাবাকে বুকের ভেতরে, পুরে রেখেছিল তার এমন প্রকাশ্য হয়ে ওঠাটাই তো সবচেয়ে ন্যায্য পাওয়া ছিল। এত দিন হয়নি। এবার হয়েছে। একজন রুবিনা দায়িত্বটা কাঁধে নিয়েছে। লড়াইটা এখন ওর নিজেরও এবং ওর মায়েরও। বাড়িতে লড়াইটা বেশ জমে উঠেছে। রুবিনা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অন্য ভাইবোনেরা রুবিনার পক্ষে। বাবা একা। তর্জন-গর্জন সার। কেউ পাত্তা দেয় না। আমিনা বেগম একদম চুপচাপ, নির্বাক হয়ে আছে। সামিনা বেশ ফুর্তিতে আছে। এত বড় একটা বিজয় দেখা হবে এই জীবনে এই স্বপ্ন নিয়েই তো ওর রাজনীতি। সামনে পল্টনে জনসভা। শুক্রবার বিকেলে। সেদিন বিকেলে সভায় যাওয়ার আগে মুশফিক ওর পথ আটকায়। সামিনা বুঝতে পারে মুশফিক আশপাশে কোথাও ছিল। ওর অপেক্ষায়। একটু দ্রুত কণ্ঠেই ও বলে, সামিনা, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। এখন যে সময় নেই। জরুরি তাড়া। জানি। আমিও তোমার সঙ্গে জনসভায় যাব। আমি তো মিছিল নিয়ে যাব। আমি ওই মিছিলে যাব। আমি ওই মিছিলে থাকব। সামিনা বুঝতে পারে মুশফিক ছাড়বে না। ও বুঝতে পারে মুশফিক কী বলতে চায়। মুশফিকের দৃষ্টিতে সোনালি আকাশ। ওখানে স্বপ্ন এবং ভালোবাসার রং আছে। কেন মুশফিক আজকের দিনটি বেছে নিল? ওর নিজেরও তো প্রস্তুতি আছে মুশফিকের জন্য। ও মুশফিককে হ্যাঁ বলবে। বাবার ছবির সামনে শুকিয়ে যাওয়া দুটি বকুল এনে হাত দিয়ে বলবে, এটা আমার ভালোবাসা। আরেক দিন হবে। আজ সময় নেই। পল্টনে জনসমুদ্র। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। প্রবল রোদ। মুশফিক ঈগলের মতো আকাশে হারিয়েছে। সামিনা ওর খোঁজ রাখতে পারেনি। তখন নেতাদের উদ্দীপক বক্তৃতা হচ্ছে। ও ওর দল নিয়ে মঞ্চের কাছাকাছি বসেছে। কতটা সময় চলে গেছে ও জানে না। ওর ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। যার যার হাতে পানির বোতল ছিল তা শেষ। অকস্মাৎ মনে হয় পানির পিপাসা নয়, আসলে ও মুশফিককে খুঁজছে। মুশফিক কাছে থাকলে ওই জনসমুদ্রে আস্তে করে বলতে পারত, আমি তোমার হৃদয়টা দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তখন প্রচণ্ড শব্দে জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। কিছু বোঝার আগেই আরেকটি। সামিনার একবার মনে হয় কেউ ওকে ওপরে উড়িয়ে ফেলল। মানুষের আর্তনাদ শুনতে শুনতে ও দেখতে পায় ওর শাড়ি রক্তে ভেসে গেছে। ও নড়তে পারছে না। ওর কোনো অনুভূতি নেই। পায়ের দিকটা কেমন শূন্য মনে হচ্ছে। ও দুই হাতে শাড়ি টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলে, আমার পা কোথায় গেল জুলিয়া! আমার দুই পা-ই উড়ে গেছে। ওর আর কিছু মনে থাকে না। সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ও প্রাণপণে অদেখা বাবার মুখ স্মরণ করার চেষ্টা করে। এত বছর ধরেও নানাভাবে বাবার চেহারা কল্পনা করেছে। মা ওকে বলেছিল, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে রণক্ষেত্রে গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওর বাবার দুই পা উড়ে গিয়েছিল। প্রবল রক্তক্ষরণে...। বুজে আসে সামিনার চোখ।

সর্বশেষ খবর