রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

সুন্দরবন

হাসনাত আবদুল হাই

সুন্দরবন
বাঘিনীটা কুমারখালী গ্রামে ঢুকে পড়েছে বিকালে, ক্ষেতমজুর জবেদালী জমির ধান কাস্তে দিয়ে কাটতে গিয়ে হঠাৎ সরসর শব্দ শুনে চোখ তুলে দেখেছে একটা কিছু অদূরে এগুচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটার মতো করে। উবু হয়ে বসেছিল, ভালো করে দেখার জন্য ঘাড় উঁচু করতে গিয়েই চোখে পড়ল পুরো শরীর। বাঘ! বাঘিনীও হতে পারে, দূর থেকে দেখে বলার উপায় নেই। পাকা ধানের রঙের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। জবেদালী কাস্তে ফেলে ক্ষেত মাড়িয়ে গ্রামের দিকে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকে, বাঘ, বাঘ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের লোকজন কেরোসিনের টিনের ওপর লাঠির আঘাত করতে শুরু করলে এক বিশাল কোলাহলের সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ লাঠির মাথায় কাপড়ের ত্যানা জড়িয়ে মশাল তৈরি করে মাথার ওপর উঁচু করে ধরে লাফাতে থাকে গ্রামের সীমানা থেকে। বল্লম, কোঁচ, সড়কি নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে জোয়ান পুরুষরা। মেয়েরা ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দিনমজুররা গরু-ছাগল নিয়ে তাড়াতাড়ি ঢোকায় গৃহস্থের খোঁয়াড়ে। একটা টানটান উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কুমারখালী গ্রামের ভেতর। জবেদালীকে নিয়ে এরপর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। গ্রামের মুরবি্ব যারা চেয়ারে, বেঞ্চে বসে তার কাছ থেকে বাঘটার বিবরণ শোনে। শুনতে শুনতে কেউ মুখের দাড়িতে বিলি কাটেন, কেউ মাথার টুপি ভাঁজ করে নেন। আসরের নামাজের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, কিন্তু এখন বাঘটা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কেউ এদিক-সেদিক যেতে সাহস করে না। এই তো সেদিন মাগরিবের সময় এসে মুসলি্লকে পা কামড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এক বুড়ো বাঘ। লোকের তাড়া খেয়ে লোকটাকে ছেড়ে পালিয়েছে। অন্য এক বাঘের কপালে সেই সুযোগ ঘটেনি। গ্রামের লোক বল্লম, সড়কি দিয়ে ঘায়েল করে মেরে ফেলেছিল ক্ষেতের মধ্যেই। বাঘটা ছিল একেবারেই বুড়ো। গ্রামের ভেতর আসার সুযোগ হয়নি তার। শেখ মোনাজাতউদ্দিন গ্রামের ইউপি মেম্বার। তিনি জবেদালীর মুখ থেকে সব শুনে বললেন, সাবধানে থাকা লাগবি। এতদূর যহন আইছে, বাকি পথটুকু পার হয়ে গ্রামে আসবি নে। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা কোনো কিছুতে বাধা মানে না। আড়তদার খলিলুর রহমান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, এত মানুষ গ্রামে বাঘ আসলি সুবিধে করতে পারবি নে। তারপর তৃপ্তির সঙ্গে বলে, আমার লোকরাও সজাগ আছে। গ্রামে বাঘ-টাঘ ঢুকতি দেবে না। গ্রামের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাওয়ার পর শেখ মোনাজাতউদ্দিন ইশারায় খলিলুর রহমানকে ডেকে কাছে আসতে বলেন। খলিলুর রহমান ঢিলেঢালা ভাব নিয়ে প্রায় অমান্য করার ভঙ্গিতে তার কাছে আসে। আড়তদার মানুষ, তার টাকার গরম। ইউপি মেম্বার হলে কি শেখ মোনাজাতউদ্দিনকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। বাইরে অবশ্য ভান করে থাকে। শেখ মোনাজাতউদ্দিন তাকে বলেন, খলিল মিয়া তোমার লোকদের কও বাদায় গিয়া যেন বাঘ, হরিণ না মারে। এ গ্রামের বড় বদনাম হয়ি যাতিছে। ফরেস্টের লোক আসি প্রায়ই নালিশ করে। খলিলুর রহমান আকাশ থেকে পড়বার মতো করে বলে, কি নিয়ে নালিশ করে? কিসের কথা কন মেম্বার সাহেব? শেখ মোনাজাতউদ্দিন গলার স্বর নামিয়ে বলেন, ফরেস্টের লোক আসি কয়ে গেল পর পর কয়েকদিন। তোমার লোকজন নাকি বাদার ভেতরে ঢুকি বাঘ মারে, হরিণ ধরে। তাদের চামড়া ছিলায়ে ঢাকায় পাঠায়। কয়েকজন ধরা পড়ি তোমার নাম কয়িছে। তোমার নাম যদি জড়ায় তাহলি কুমারখালী গ্রামের নামও জড়ায়ে পড়ে। তাই কই বাঘিনীটা যদি গ্রামের কাছে আসি থাকে, জবেদালী যদি সত্যি দেখি থাকে, তাহলি ওডারে খ্যাদায়ে দেবার ব্যবস্থা কর। মারি ফেলার কি দরকার? কয়ি দাও তোমার লোকদের। খলিলুর রহমান অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, এইডা কি কথা কলেন আপনি? আমি আমার লোক বাদায় বাঘ, হরিণ মারতে পাঠামু ক্যান? আমার কি ব্যবসার কমতি হয়িছে? কাঠের ব্যবসা, মধুর ব্যবসা, নৌকার ব্যবসা। এইসব প্রতিবছর বাড়তিছে। আমি বাঘ, হরিণ মারতি যামু ক্যানে? শেখ মোনাজাতউদ্দিন বলেন, লোকে কয়। ফরেস্টের মানুষও তাই কয়ে গেল। যা কর গ্রামের ইজ্জতখানা রাইখ। ফরেস্টের রেস্ট হাউসে ক্যাম্প করে আছে তিনজন, শর্বরী, মুহিত আর এনাম। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের এক প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে তারা শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জে। পনের দিন হলো এসেছে, মোট তিন মাস থাকবে তারা। ফরেস্টের লোকদের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে তাদের কাজে। ফরেস্টের সবাই যে সাধু না, সৎভাবে চলে না সে বিষয়টা তারা জেনে গিয়েছে। ফরেস্টের লোকজন সব দিকে তাল দিয়ে চলে। ডাঙ্গাতেও আছে, পানিতেও আছে। বাঘ, হরিণ রক্ষার জন্য খুব আগ্রহ আর সংকল্প দেখা যায় তাদের সঙ্গে কথা বলার সময়। দুষ্ট লোকে বলে তলে তলে ডাকাত দলের সঙ্গে যোগসাজশ করে হরিণ মারে, বাঘ মেরে চামড়া পাচার করে। সুন্দরবনের কাঠ কাটা আর মাছ ধরার ব্যাপারেও অনিয়মে তারা অংশীদার। কাঠ আর মাছ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তারা তিনজন সুন্দরবনে আসেনি। তাদের দায়িত্ব বাঘ রক্ষা করা। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শেষ যে জরিপ হয়েছে তাতে দেখা গেছে বাঘের সংখ্যা কমছে। এতদিন জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে মারা হতো বাঘ, প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে। এখন গ্রামের ভেতর বাঘ ঢুকে পড়ায় আত্দরক্ষার জন্য বাঘ মারছে গ্রামের মানুষ দল বেঁধে। এ সুযোগে খলিলুর রহমানের মতো চোরাকারবারিরাও গ্রাম রক্ষার অজুহাতে বাঘ মারছে। তাদের তিনজনকে পাঠানো হয়েছে গ্রামের লোকদের বোঝাতে যে না মেরেও বাঘ গ্রাম থেকে তাড়ানো যেতে পারে। বাদায় বাঘ ফেরত পাঠাবার ফন্দি আর কৌশল জানাবার জন্য তারা এসেছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লাইফ প্রকল্পের পক্ষ থেকে। মুহিত আর এনাম লোকাল রিক্রুট, ঢাকায় চাকরির নিযুক্তি পেয়েছে। শর্বরী এসেছে নিউইয়র্ক থেকে, প্রকল্পের হেড অফিসে কাজ করে সে। সেই সঙ্গে পিএইচডিও করছে। সেই শরণখোলা প্রকল্পের লিডার। মুহিত আর এনামের সমবয়সীই হবে, তবে বিদেশে থাকার জন্য তাকে অনেক সপ্রতিভ, আত্দবিশ্বাসী আর সাহসী দেখায়। দেখতে শুনতেও চৌকস। সুঠাম, সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারিণী। হুটহাট করে নিজেই একা একা নৌকার মাঝি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাদার ভেতর নোনা পানির আনাগোনা দেখার জন্য, সঙ্গে থাকে পানি টেস্ট করার যন্ত্র। মুহিত আর এনাম নিষেধ করেছে একা না যেতে। শুনে শর্বরী হেসে বলেছে, ভয় করছ বাঘে খাবে? শোননি বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। আজ সকাল থেকে শর্বরী বারান্দায় তার ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। ল্যাপটপের তথ্যের সঙ্গে তার হাতের কাগজে যা লেখা তা মিলিয়ে দেখছে। মুহিত আর এনাম টর্চলাইটের বাঙ্গুলো সাজিয়ে রাখতে সাহায্য করছে রেস্ট হাউসের পিয়নকে। কিছুক্ষণ আগে নৌকা দিয়ে টর্চলাইটের নতুন সাপ্লাই এসেছে। ল্যাপটপে চোখ রেখেই শর্বরী এনাম আর মুহিতের উদ্দেশে বলল, আগামী এক মাসে সমুদ্রের নোনা পানি আরও এক মাইল বাদার ভেতর ঢুকে পড়বে। আমার হিসাব তাই বলছে। তার মানে বুঝতে পারছ? দুজন চুপ করে থাকে। শর্বরী বলে, তার মানে নোনা পানি থেকে আত্দরক্ষার জন্য বাঘ আরও উত্তরে সরে আসবে। এভাবে তারা ক্রমে ক্রমে উত্তরের গ্রামে ঢুকে পড়বে মিঠে পানির জন্য। তখন তারা গরু-ছাগল খাবে, কেননা গ্রামে তো হরিণ নেই। সামনে পেলে মানুষকেও ছাড়বে না। ক্ষুধার্ত বাঘ সাংঘাতিক জীব। কোনো বাধা মানে না, ভয় করে না কোনো কিছুকে। শর্বরীর হাতের কব্জিতে স্পেশাল একটা ঘড়ি। বেশ বড়। ভেতরে অনেক কাঁটা ঘুরছে। এই ঘড়ি শুধু সময় জানায় না, এ থেকে অনেক রকমের খবর পাওয়া যায়। আবহাওয়া, উষ্ণতা, ঝড়ের আভাস, জীবজন্তুর অবস্থান, নদী-খালের হদিস সব ঘড়ির ভেতর রয়েছে। বোতাম টিপ দিলেই অক্ষর আর সংখ্যা ভেসে ওঠে। ছোটখাটো কম্পিউটার যেন। ওদের দুজন প্রথম দিন ঘড়িটা দেখে অবাক হয়েছিল খুব। শর্বরী বলেছিল, নিউইয়র্ক থেকে আমার হেড অফিস এই ঘড়ির জন্য জেনে নিতে পারবে এ মুহূর্তে আমি কোথায় আছি। আর আমিও জানাতে পারব। অনেকটা রোমিং মোবাইলের মতো। বলতে পার এটা একটা স্মার্ট ফোন। সর্বাধুনিক। এনাম বলেছিল, অনেক দাম হবে। শর্বরী বলেছিল, সে তো বটেই। তবে আমি কিনিনি। অফিস থেকে দিয়েছে। আড়তদার খলিলুর রহমান যখন ঘড়িটা দেখে তার চোখের পলক পড়ে না। তাজ্জব হয়ে তার দুই চোখ ছানাবড়া। ঢোক গিলে বলেছিল, এমুন ঘড়ি এই দেশে নাই। শর্বরী বলেছিল, থাকতে পারে। যাদের প্রয়োজন তারা নিশ্চয়ই জোগাড় করেছে। খলিলুর রহমান তার আড়তের গদিতে শর্বরীকে বসতে দিয়ে তার কাছ থেকে ঘড়িটার অন্ধি-সন্ধি সব জেনে নিতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। তার মাথায় ঢোকেনি। হেসে বলেছিল, মনে হয় দু-একদিনে শেখা যাবে না। কয়েকদিন লাগবে। শর্বরী হেসে বলেছে, আমাদের কাজে সাহায্য করেন। শুনেছি আপনার অনেক লোকজন, নৌকা। আপনার সাহায্য পেলে আমাদের কাজ এগিয়ে যাবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আপনাকে ঘড়িটার সবকিছু ব্যাখ্যা করে জানাব। তারপর হেসে বলেছে, এসব জেনে লাভ কি আপনার? আপনাকে তো আমার মতো ব্যবহার করতে হবে না। খলিলুর রহমান চকচকে চোখে তাকিয়ে থেকে বলেছে, জানতি পারলি আনন্দ হবে। এটা তো একটা খেলনার মতো। দেখন নাই ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন খেলনা দেখলি ভাঙি ফেলি দেখবার চায় ভেতরে কি আছে? সেই রকম হাউস হয়িছে আমার কতি পারেন। ফরেস্ট অফিসার কথায় কথায় সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, খলিলুর রহমান লোকটা ভালো না। সাবধানে থাকবেন। ওর মুখে এক কথা, মনের ভেতর অন্য। অনেক বাঘ মেরে চামড়া চালান করেছে সে। ধরতে পারেননি তাকে? শর্বরী জিজ্ঞাসা করেছে। তাকে ধরা সোজা না। আমার অফিসের অর্ধেক লোককে হাত করে ফেলেছে। টাকা ছড়ালে যা হয়। খলিলুর রহমানের টাকার অভাব নাই। তারপরও বাঘ মারতে চায়? সামান্য টাকার জন্য? শর্বরী অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করেছে ফরেস্ট অফিসারকে। সামান্য কোথায়? হাজার হাজার টাকা। চোরাচালানের বিশাল এক চক্রের নেতা সে। সবাই জানে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। মুখ বন্ধ। বললে নিকেশ হয়ে যাবে। আর বলবে কি করে? সে তো সামনে থাকে না। তার লোকদের দিয়ে সব অপরাধ করায়। খলিল শর্বরী, এনাম আর মুহিতকে বলেছে, আসেন না আমার বাড়ি একদিন। ডাল-ভাত খাবেন। তারপর শর্বরীর দিকে তাকিয়ে বলেছে, বাড়ির লোকদের আপনার ঘড়িটা দেখাতে পারতাম। তারা তাজ্জব হয়ে যাবে। শর্বরী বলেছে, যাব। এখানে আমরা তো আপনাদেরই অতিথি। কাজ একটু গুছিয়ে নিই, তারপর যাব। গ্রামের লোকদের সঙ্গে আমাদের বেশ কয়েকটা মিটিং করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে। সঙ্গে আপনারাও থাকবেন। আপনাদের কথাই ওরা বেশি শুনবে। শর্বরী ফরেস্ট রেস্ট হাউসের বারান্দায় আজ সকাল থেকে ল্যাপটপ খুলে তথ্যগুলো নতুন করে জেনে নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে শরণখোলা রেঞ্জের এক বন কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনে বাঘসহ অন্যান্য শিকার কমেছে। টাইগার রক্ষা প্রকল্প নামে একটা প্রকল্প ১৯৮০ সাল থেকে আটকে আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। ফলে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বনবিভাগ। আন্তর্জাতিক বাজারেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার মূল্য চড়া থাকায় এখন চোরাচালানিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ সাল থেকে বাঘের চামড়া বাজারজাত শুরু হওয়ার পরই বোঝা গেল, বাজারে এর মূল্য আকাশচুম্বী। ২০০৪ সাল পর্যন্ত বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে শতাধিক বাঘের চামড়া। কিন্তু পাচারকারী দলের নেতারা ধরা পড়েনি। আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আদি পেশা হারিয়ে সুন্দরবনে ক্রমেই বাড়ছে চোরা শিকারির দল। এ ছাড়া খাবারের অভাবে গ্রামে ঢুকে পড়া বাঘ হত্যার ঘটনাও বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। কেবল সরকারি হিসাবেই গত ৯ বছরে গণপিটুনিতে সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে ২০টি। বেসরকারি পরিবেশবিদদের মতে, এই সংখ্যা তিরিশের কম নয়। বনবিভাগ যখনই খবর পায় যে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে তখনই বাঘটিকে নিরাপদে বনে ফেরত নিয়ে আসার জন্য ঘটনাস্থলে ছুটে যান। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পেঁৗছে বাঘটিকে জীবিত পান না। শর্বরী মুহিত আর এনামের উদ্দেশে বলল, আমাদের প্রকল্প আরও আগে বাস্তবায়িত হলে গ্রামের মানুষ বাঘগুলো মারত না। মুহিত সন্ধিহান হয়ে বলে, দেখেন এখনো তাদের পরামর্শ দেওয়ার পর গ্রামে বাঘ এলে তাকে বাঁচানো যায় কিনা। শর্বরী আপত্তির স্বরে বলে, তুমি এমন অবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলো না মুহিত। আমরা পারব, এ কথাই মনে করতে হবে। তাদের দুজনের কথা শুনে এনাম কিছু বলে না। সে আড় চোখে শর্বরীর জিন্স পরা সুডৌল নিতম্ব দেখে। তার ভেতর অন্য উত্তেজনা শুরু হয়। এই এক মুশকিল। শর্বরী এমনভাবে কাপড় পরে যে চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না সে। শরীরের ভেতর ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। রক্তের ভেতর আগুন লাগে যেন। সে জন্য যখন যে শর্বরীর সঙ্গে কথা বলে মাথা নিচু করে রাখে। মনে হয় মুহিতের এ সমস্যা নেই। সে বেশ স্বাভাবিক হয়েই শর্বরীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে। হয়তো তার লিবিডো তার মতো নয়। কুমারখালী গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মিটিং করে সবার হাতে টর্চলাইট দেওয়া হলো। শর্বরী বলল, আপনারা তো বাঘ মারতে চান না, নিজেদের বাঁচাতে চান। বাঘ দেখলেই টর্চের আলো ফেলবেন তার মুখের ওপর দেখবেন পালিয়ে যাবে। তাদের মারার দরকার হবে না। আমরা প্রত্যেক পরিবারকে টর্চলাইট আর ব্যাটারি দেব বিনামূল্যে। জোয়ান পুরুষদের অবশ্য সন্ধ্যার পর থেকে পালা করে পাহারা দিতে হবে। খলিলুর রহমান আর শেখ মোনাজাতউদ্দিনও ছিলেন গ্রামের মিটিংয়ে। শর্বরীর কথা শেষ হলে খলিলুর রহমান বলল, বাঘ যদি দিনের বেলায় দেখা যায়? তখন? শর্বরী কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে রেখে বলেছে, কেরোসিন টিনে লাঠি দিয়ে শব্দ করবেন। কয়েকটা টিনের শব্দ শুনলে বাঘ ভয় পাবে। গ্রাম ছেড়ে পালাবে। রাতের বেলায়ও কেরোসিন টিন বাজানো যেতে পারে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য, বাঘ দেখা না গেলেও। কেরোসিন টিন বাজাতে তো কোনো খরচ নেই। শুধু আপনাদের একটু পরিশ্রম করতে হবে। শেখ মোনাজাতউদ্দিন বলেন, নিজেদের স্বার্থে এটুকু পরিশ্রম করতে আপত্তি করবে না মানুষ। খলিলুর রহমান গলা খাকারি দিয়ে বলে, মানুষের প্রাণের দাম বেশি, না বাঘের? আপনারা বাঘের জন্য এত কষ্ট করতিছেন ক্যান? শর্বরী বলে, জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য। সব বাঘ শেষ হয়ে গেলে প্রকৃতির একটা সম্পদ শুধু না, বৈচিত্র্যও হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। সে হবে মস্তবড় এক ক্ষতি। খলিলুর রহমানকে দেখে মনে হয় না সে শর্বরীর কথা বুঝতে পেরেছে অথবা তাকে বিশ্বাস করেছে। সে ভালো মানুষের মতো তাকিয়ে থাকে। গ্রামের মানুষ প্যান্ট-শার্ট পরা শর্বরীকেই বেশি করে দেখে। বিশেষ করে পুরুষরা। তাদের চোখে কৌতূহল, আগ্রহ আর রিরংসা। এমন তাজা মেয়ে মানুষ তারা দেখেনি কখনো। নিজেদের ঘরের মেয়েদের মনে হয় এই মেয়ের তুলনায় কাপড়ের গাট্টি অথবা ত্যানা জড়ানো কাঠি। আরে, মেয়ে মানুষ যদি হবি তো এই রকম হ। শর্বরীকে দেখতে দেখতে কেউ কেউ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার মধ্যে আড়তদার খলিলুর রহমান একজন। শেখ মোনাজাতউদ্দিন নামাজ পড়েন পাঁচ ওয়াক্ত, তিনি শর্বরীর সঙ্গে কথা বলার সময় অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। টর্চলাইট আর কেরোসিন টিন বিতরণ করে তিনজনে ফরেস্টের রেস্ট অফিসে ফেরে। সামনে-পেছনে যারা সেসব মানুষ এমনিতেই ফুর্তির সঙ্গে কেরোসিন টিন পেটায়। এখন বিকাল বেলা বাঘিনীটা কুমারখালী গ্রামে থাকলেও এখান থেকে অনেক দূর। এ ছাড়া এত লোক দেখে আর শব্দ শুনে কাছে আসতে সাহস করবে না। সবাই বেশ ফুর্তির সঙ্গে হাঁটে। পেছন থেকে এনাম বারবার শর্বরীর জিন্স পরা সুডৌল নিতম্ব দেখে। তার পেছনে খলিলুর রহমান। তার চোখও একই দিকে। শর্বরী কয়েকবার খলিলুর রহমানকে বলেছে কষ্ট করে তাদের সঙ্গে না আসার জন্য। খলিলুর রহমান বলেছে, কি যে কথা কন। আপনারা হলেন মেহমান। রেস্ট হাউসে পেঁৗছায়া দিয়া যামু না? এইডা একটা কথা হইল? আসলে তো উচিত ছিল আমাদের বাড়িতেই রাখা। তারপর অদূরে দেখিয়ে বলে, ওই দিকে বলেশ্বর নদী। বাদায় মিঠা পানি ওই নদী দিয়াই আসে। তার লগে যোগ দিছে সুপতি আর ভোলা নদী। পশ্চিমে হরিণটানা, পাথারিয়া, উত্তরে ভোলা ও শাপলা খালে যাওয়া যায়। সুপতি নদীর পুব দিয়া মোজাহের খাল, চাঁন্দেরশ্বর খাল বাদায় ঢুকিছে। পশ্চিমের খালগুলো হইলো কচিখালী, সুলকাপাড়া, ছিটে কটকা, ডোরা এসব। সুপতির মোহনার পশ্চিম পাড়ে পড়ছে কচিখালী, তার উত্তরে বিখ্যাত টাইগার পয়েন্ট। এই পশ্চিম পাড়েই টাইগার পয়েন্টের ভারানী। দুটা নদীকে যোগ করছে ওই ভারানী। ওই খানে ট্রলার নিয়া যাওয়া যায়। আমরা একবার বড় লঞ্চ দিয়া গুতায়া গুতায়া কেওড়ার ডাল ভাঙি কটকা যাতি পারছিলাম। আপনাদের সময় থাকলি নিয়া যেতে পারি। শর্বরী হাঁটতে হাঁটতে খলিলুর রহমানের কথা শোনে। তার বলা নামগুলো ল্যাপটপের তথ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে। সে এক সময় বলে, হ্যাঁ। যাব আমরা। আমাদের কাজ একটু গুছিয়ে নিই। এই তো প্রথম গ্রামে মিটিং হলো। এ রকম আরও হতে হবে অন্যান্য গ্রামে যেখানে বাঘ মিষ্টি পানি আর গরু-ছাগলের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে আসছে। তারপর সে খলিলুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি দেখি সুন্দরবনের অনেক কিছু জানেন। খলিলুর রহমান মুখে তৃপ্তির হাসি এনে বলে, জানমু না? এহানকার মানুষ। শর্বরী বলে, সুন্দরবনের বাঘ আপনার মতো লোকই রক্ষা করতে পারবে। দেখবেন কুমারখালী গ্রামে ঢুকে পড়েছে যে বাঘিনী তাকে যেন গ্রামের লোক মেরে না ফেলে। আমরা যেভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেলাম সেই রকম করলেই চলবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। খলিলুর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হু হু। দেখা যাক। সকাল থেকে রেস্ট হাউসে শর্বরী নেই। মুহিত দেখল এনামও নেই। সে চিন্তিত হয়ে ফরেস্ট অফিসারকে মোবাইলে ফোন করল। তিনি মিটিং করছিলেন, বললেন মিটিং শেষ হলেই আসবেন। থানাতেও খবর দেওয়া হবে। দুপুরের দিকে এনাম এলো। তাকে বেশ বিপর্যস্ত দেখা যাচ্ছে। কাপড়ে কাদা, কোথাও কোথাও ছেঁড়া। খোঁচা লেগে রক্ত বের হচ্ছে হাত থেকে। মুহিত অস্থির হয়ে বলল, কি হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলি? শর্বরী কোথায়? এনাম হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, টাইগার পয়েন্ট দেখতে গিয়েছিলাম। ভোর বেলায় খলিলুর রহমান তার লোক পাঠিয়েছিল ইঞ্জিন বোট দিয়ে। তুই ঘুমোচ্ছিলি দেখে আমরা ডাকিনি। মুহিত বলল, শর্বরী কোথায়? তোর এই অবস্থা কেন? জানি না। ইঞ্জিন বোট উল্টে গেল কোনো রকমে সাঁতরে ডাঙ্গায় উঠে প্রাণ বাঁচালাম। মনে হলো জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। শর্বরীকে দেখলি নে? তার কি হলো? মুহিতের স্বরে উদ্বেগ। এনাম বলল, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য এত ব্যস্ত ছিলাম আর কিছু ভাবতে পারিনি। ওই অবস্থায় কে কার দিকে তাকায়? এনামকে ভীতসন্ত্রস্ত এবং চঞ্চল দেখায়। দারোগা সাহেব খলিলুর রহমানের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, এবার থানায় যেতে হয় খলিল মিয়া। আর পার পেলেন না। খলিলুর রহমান পান চিবুতে চিবুতে বলে, ক্যান কি হয়িছে? বসেন না। খাড়ায়া ক্যান? কতদিন পর আইলেন গরিবের বাড়ি। না। বসতে আসিনি। খুব সিরিয়াস কেইস। ঢাকা থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে। একটা অ্যাকশন না নিলে হবে না। আপনি চলেন আমাদের সঙ্গে। কেইসটা কি? খলিলুর রহমান কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচায়। আপনার লোকরা বাঘের চামড়াসহ ধরা পড়েছে। কুমারখালী বাঘিনীর চামড়াও আছে তার মধ্যে। তা থাকতি পারে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? আপনার লোকরা সব বলেছে। আপনার কথা মতোই সব কাজ করেছে তারা। দারোগা সাহেব হাতের ব্যাটন ঘুরাতে ঘুরাতে বলেন। কইলেই হইল? শত্রুতা করিও তো কতি পারে তারা? তাদের দিয়ে আমার শত্রুরা এমুন কওয়াতে পারে। সেই মিথ্যা কথা সত্যি হয়ি যাবি? কি যে কন ওসি সাহেব। এত বুদ্ধি আপনার? এমন দুর্বল কেইস নিয়া আসিছেন। কোর্টে মামলা টিকাতি পারবেন না। ওসি সাহেব গম্ভীর হয়ে বলেন, শহর থেকে আসা মেয়েটাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার লোকরা বলেছে তাকে আপনি জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। কি সব আজগুবি কথা কন? লোকে বানায়া কবি আর তাই আমাকে শোনাবেন? মিথ্যা কথা সত্যি হয়ি যাবে? দেশে কি আইন-কানুন নাই? সাক্ষী-সাবুদ লাগবি না এসব প্রমাণ করতি? তারপর সে স্বর নামিয়ে বলে, আমার শত্রুরা আমার ইজ্জত নষ্ট করার জন্যি এই সব কথা বানায়া বানায়া কতিছে। বুঝতে পারলেন না? আমার তো শত্রু কম নাই। কিন্তু মুখে কলি তো হবি না? সাক্ষী-প্রমাণ কই? এই সময় ঘরের ভেতর থেকে খলিলুর রহমানের ছোট নাতনি এসে ঢোকে, তার হাতে একটা বড় হাতঘড়ি। ভেতরে অনেক কাঁটা রয়েছে। তার পাঁচ বছরের নাতনি ঘড়িটা ওপরে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করে, এইডা কি নানা?

সর্বশেষ খবর