বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের অন্তরের কথা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের অন্তরের কথা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্তরে একটা চেতনা ছিল। আমরা বলাবলি করি এর কথা, মনে হয় জিনিসটা কি তা জানি, কিন্তু থেমে যেতে হয় সংজ্ঞায়িত করতে গেলে। অনেক সময় ধারণা হয় প্রয়োজনইবা কি সংজ্ঞার, চেতনাটা তো আছেই আমাদের সঙ্গে, তাকে তো চলেছি বহন করে। কিন্তু অনুভূতি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে ঘটনা পরম্পরায়। নতুন প্রজন্মের কোনো অভিজ্ঞতা নেই মুক্তিযুদ্ধের, তারা অনুভব করবে কী? ওই যুদ্ধ তাদের জন্য দূরের ঘটনা। সেদিনের বিজয় যেহেতু নব নব বিজয়ের অভিমুখে ধাবিত হয়নি, বরং বিরুদ্ধ পক্ষ প্রবল হয়েছে, পক্ষের লোকেরা হয়েছে বিভক্ত, কেউ কেউ বিচ্যুত, তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টা স্পষ্ট থাকছে না তাদের কাছেও যারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে যুদ্ধের।

সংজ্ঞা দেওয়ার কাজটা সহজ নয়। সব ক্ষেত্রেই কঠিন। সীমানা দাঁড় করাতে হয়, চিহ্ন রাখতে হয় পুঁতে। যে জমি জরিপ হয়নি তার সীমানা নিয়ে বিবাদ থাকাও খুবই সম্ভব। কিন্তু তবু মুক্তিযুদ্ধের একটা সংজ্ঞা পাওয়া যাবে এক জায়গায়, ’৭২-এর সংবিধানের চিহ্নিত চারটি রাষ্ট্রীয় মূল নীতিতে : জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই সম্মিলনে। জাতীয়তাবাদের পরেই বরং উল্লেখ ছিল সমাজতন্ত্রের, তারপরে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার।

জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন ছিল না। বাঙালি সেদিন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসে ওই প্রথমবার দেখা গেল হিন্দু-মুসলমান নেই, গরিব-ধনী নেই, শহুরে-গ্রাম্য নেই, দিনাজপুর-সন্দ্বীপ নেই, সবাই বাঙালি। সব বাঙালি এক হলো, অভিন্ন হলো। সেটাই ভিত্তি। ব্যাপারটা এত স্পষ্ট ছিল যে প্রথমে এ নিয়ে কথা বলার দরকারও হতো না। বলতে হতো না যে, এটা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, সবাই জানত কেন এবং কোন প্রাথমিক অনুপ্রেরণায় শুরু হয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যাপারটা; তার গান যে আমাদের জাতীয় সংগীত হবে এ জানা ছিল সবার, কোন বিশেষ গানটি ওই মর্যাদা পাবে সেটিও অজানা ছিল না। তবু সংবিধানে প্রথমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা এসেছে; কেননা সংবিধান একটা দলিল বটে, দলিলে প্রয়োজনীয় সব কথাই লিখে রাখা নিয়ম। বাঙালির ওই জাতীয়তাবাদ অবশ্যই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। কোন অর্থে? এই স্পষ্ট অর্থে যে, এই জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক নয়। পুরনো রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ছিল, ছিল খুব বেশি করে। ইংরেজ আমলেই এর সৃষ্টি। আগে সম্প্রদায়ক ছিল কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না; ইংরেজের শাসনকালে জাতীয় শত্রুকে চিহ্নিতকরণে বিভ্রান্তির এবং হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিকাশের ক্ষেত্রে তারতম্যের দরুন সাম্প্রদায়িক দেখা দিল, এমনকি জাতীয়তাবাদ নিজেই সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়ল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে আমরা পেয়ে গেলাম হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এ রাজনীতির পরিণতিতে বাংলা ভাগ হয়েছে। না, দুই বঙ্গকে এক করার জন্য নয়, বরং পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে পরিপূর্ণরূপে বাঙালি করার জন্যই দরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা বায়ান্ন সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শুরু হয়ে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল একাত্তরের যুদ্ধে সেটাই একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়— এ যেন মাতৃগর্ভে শিশুর বেড়ে ওঠা, জন্মলাভের উদ্দেশ্যে।

কিন্তু কেবল অসাম্প্রদায়িকতা নয়, রাষ্ট্রকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ করতে চেয়েছিলাম আরও একটি গভীর অর্থে। সেটি হলো ইহজাগতিকতা। ভাষা একটি ইহজাগতিক বিষয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও এগোচ্ছিল সেই পথ ধরেই এবং তারই ধারাবাহিকতা মুক্তিযুদ্ধ চেয়েছে রাষ্ট্রে ইহজাগতিকতার প্রতিষ্ঠা ঘটাতে। ধর্ম যে থাকবে না তা নয়; কিন্তু সে থাকবে তার নিজের জায়গায়, ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ও আচরণে, রাষ্ট্রের সঙ্গে সে মিশে যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ যে রাষ্ট্র চেয়েছিল সেটি অবশ্যই গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের মাত্রা একটি নয়, একাধিক। গণতন্ত্রের প্রথম কথা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা; দ্বিতীয় কথা রাষ্ট্রের নাগরিকের স্বাধীনতা। নাগরিকের স্বাধীনতার জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন। একদিকে প্রয়োজন সামন্তবাদের নিগড় থেকে বের হয়ে আসা। সে কী করে স্বাধীন হবে বাস করে যে অন্ধকারে, সন্ত্রস্ত থাকে ভূত-প্রেতের ভয়ে, আচ্ছন্ন থাকে কুসংস্কার ও অদৃষ্টবাদে। অন্যদিকে প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ন্যূনতম চাহিদা নিশ্চিত করা। এগুলো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকলে গণতন্ত্র হচ্ছে আকাশকুসুম কল্পনা। গণতন্ত্রের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সমাজও আবশ্যক। আর সেই সমাজই হচ্ছে গণতান্ত্রিক যেখানে প্রত্যেকটি থাকবে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সেই সঙ্গে থাকবে সাম্য।

এই সাম্য নিশ্চিত করা করণীয় হিসেবে যত বড়, দায়িত্ব হিসেবে তার চেয়েও কঠিন। যেমন ভোটের কথাই ধরি। ভোট সবার থাকবে, কিন্তু তাই বলে ভোট কি সবাইকে সমান করে দেবে? কোটিপতির ভোটাধিকার আর ক্ষেতমজুরের ভোটাধিকার কি এক হবে কখনো? কোটিপতি যে সে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে এবং তার সম্ভাবনা থাকবে নির্বাচিত হওয়ার। এই কোটিপতিটি না হোক আরেক কোটিপতি নির্বাচিত হবে, পরস্পরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে কোন দল জিতবে ঠিক নেই, এদলও পারে— ওদলও পারে জিততে। কিন্তু যে দলই বিজয়ী হোক জিতবে টাকাওয়ালারাই; দলের ত্যাগী ও গরিব কর্মীরা প্রার্থী হতে পারবে না, তারা মনোনয়নই পাবে না— দরিদ্র বলে। নির্বাচিত হবে যারা তারা এমনিতেই বড় লোক, রাষ্ট্র ক্ষমতার ভাগ পেয়ে তারা আরও বড় লোক হবে। ক্ষমতায় যেতে পারলে তো ভালোই, সোনায় সোহাগা, না পারলেও ক্ষতি নেই, ভাগ পেয়ে যাবে। অনেক সময় বিরোধী দলে থাকা বরং ভালো, বদনাম হয় না, দায় থাকে না জবাবদিহিতার, অথচ টাকা করা যায় ঠিকই, ভাগ না দিলে ফাঁস করে দেবে এই ভয়ে সরকারি লোকেরা বখরা দেয়, সন্তুষ্ট রাখে। নির্বাচন মোটেই প্রহসন নয়, খুব জরুরি ব্যাপার, কেননা এর মধ্য দিয়ে ঠিক হয়ে যায় সামনের পাঁচ বছর জনগণের মাথায় কাঁঠাল রেখে কারা ভেঙে ভেঙে খাবে। জনগণই ঠিক করে দেবে কারা তাদের বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও শোষিত করবে। কিন্তু এই জরুরি ঘটনাকে আর যাই হোক গণতন্ত্র তো বলা যাবে না। অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করে তারা জনগণের সম্মতি নেয় না, বৈধভাবে যারা দখল করে তারা সম্মতি নিয়ে আসে। কাজ একই, পথ আলাদা। একটি যদি অগণতান্ত্রিক হয়, তবে অপরটিও অগণতান্ত্রিক বটে।

প্রকৃত গণতন্ত্রে অবশ্যই অধিকার ও সুযোগের সাম্য থাকতে হবে। না, সব মানুষ সমান হবে না। কারও মাথা কাটা যাবে না, মেধা কেড়ে নেওয়া হবে না; বৈচিত্র্যও থাকবে, অবশ্যই। কিন্তু অধিকার থাকতে হবে কেবল ভোট দেওয়ার নয়, ভোট পাওয়ারও। সুযোগ থাকতে হবে আপন আপন মেধাকে বিকশিত করার এবং বিকশিত মেধার সম-স্বীকৃতি প্রাপ্তির।

সমাজতন্ত্রের দাবিও ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। অনেকে মনে করেন এই দাবি স্বাভাবিকভাবে আসেনি, একে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আসলে খুবই স্বাভাবিক ছিল, একদিন না একদিন সে আসতই, যেভাবেই আসুক না কেন। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে তারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না এটা অবশ্য সত্য; কিন্তু সে হিসেবে বলতে গেলে তো বলা যাবে যে তারা মুক্তিযুদ্ধও চায়নি, চেয়েছিল ছয় দফার বাস্তবায়ন। সত্তরের নির্বাচনের পরে ছয় দফা যেমন এক দফায় পরিণত হয়েছিল এবং দফা রফা করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানের; একাত্তরের ২৬ মার্চের পরে তেমনি সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার ছিল অনিবার্য। সে কারও ষড়যন্ত্রে আসেনি, করুণাতেও নয়, এসেছে একেবারে স্বাভাবিকভাবে।

হ্যাঁ, সমাজতন্ত্রই চাইছিল মানুষ। স্পষ্ট করে বলতে পারেনি কোন রকমের সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র বলতে কিন্তু তারা ঠিকই বুঝেছে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র এবং সেটাই চেয়েছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে তারা দেখেছে। সে ছিল বৈষম্য দিয়ে ঠাসা। সবচেয়ে বড় বৈষম্যটা ছিল পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের। লোকে নিজের চোখে দেখেছে কীভাবে পশ্চিম শোষণ করছিল পূর্বকে এবং দিনকে দিন পরিণত করছিল শ্মশানে। সে রুখে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধ করে হটিয়ে দিয়েছে। হটিয়ে দেওয়ার পরে কি দাঁড়াবে সমাজের ছবি সে নিয়ে তার এই বোধ ছিল যে, সেখানে বৈষম্য থাকবে না ধনী ও দরিদ্রের; পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার ব্যবহার পুনরুত্পাদিত হবে না গরিব ও বড়লোকের ব্যবধানে। সেই আকাঙ্ক্ষাতেই সে ছিল সমাজতন্ত্রী। স্বাধীনতা যুদ্ধ ধনীদের যুদ্ধ ছিল না, যুদ্ধ ছিল সাধারণ মানুষের; কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রের। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভোটের ঐক্যে কাজ হয়নি, যুদ্ধের ঐক্যে কাজ হয়েছে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক এ যুদ্ধে যে তরুণ ছাত্র ও শিক্ষিত যুবক ছিল সেও সমাজতন্ত্রী ছিল, আগে না থাকলে যুদ্ধক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল, কৃষক ও শ্রমিকের সঙ্গে একত্র হয়ে, এক হয়ে। কৃষক ও শ্রমিক ভেবেছে সে এবার মুক্ত হবে এবং মানুষের মতো বাঁচার অধিকার পাবে। কত শত বছর ধরে সে শোষণ সহ্য করছে, সহ্য করেছে নিপীড়ন; এবার সে বাঁচবে; আর তাকে পোহাতে হবে না জমিদারের, মহাজনের দারোগার কিংবা কাটমোল্লার নিপীড়ন। একটি শোষণের ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আরেকটি শোষণের ব্যবস্থার শেকল গলায় পরার আশঙ্কাকে সে নিশ্চয়ই তার স্বাধীনতার স্বপ্ন মনে করেনি।

এই তো সংজ্ঞা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। লোকে শত্রুকে চোখের সামনেই দেখেছে। যুদ্ধের রণাঙ্গন বিস্তৃত ছিল দেশজুড়ে। শত্রুকে কেবল কতগুলো অস্ত্রধারী লোক হিসেবে দেখেনি মানুষ; উর্দু বলে কেবল এ কারণেই শত্রুকে শত্রু মনে করেনি; তাকে চিনেছে ও বুঝেছে একটি ব্যবস্থার রক্ষাকারী হিসেবে। রাজাকার আল বদররা বাংলাই বলত, উর্দু জানত না; হানাদারদের সঙ্গে তাদের দৃশ্যত কোনো মিলই ছিল না— না চেহারায়, না আকৃতিতে, না কথাবার্তায়। ও যদি নেকড়ে হয় এ তবে ফেউ। কিন্তু নেকড়ে ও ফেউ এক হয়ে গিয়েছিল একটি অভিন্ন লোভে। লোভটা হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করা, যে ব্যবস্থা ছিল সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমূলক; মানুষকে যা বিভক্ত করে রাখতে চেয়েছে শোষক ও শোষিতে। পাকিস্তানি রাষ্ট্র ছিল আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। অস্তিত্বের চব্বিশ বছরে সেখানে একটিও সাধারণ নির্বাচন হয়নি। ক্ষমতা সবসময় ছিল আমলাদের হাতে। সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রই শাসন করেছে এই রাষ্ট্র, একাধিক নামে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদ গড়ে তোলা; ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা প্রথমে শোনা গিয়েছিল মৃদুমন্দ, পরে সবটাই ছিল ঐক্য ও শৃঙ্খলার বোলচাল; ঐক্য ও শৃঙ্খলা অর্থ মালিকের সঙ্গে দাসের ঐক্য, শৃঙ্খলার অর্থ দাসের পক্ষে শোষণকে নির্বিচারে মেনে নেওয়ার নিশ্চুপতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এ চারটি সীমানাচিহ্ন দিয়ে সংজ্ঞায়িত করলে তাকে চেনা সহজ হবে, নইলে সে কেবল অনুভবের বিষয় হয়ে থাকবে, যে অনুভব কেবলই দুর্বল হচ্ছে— আমরা দেখতে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লাঞ্ছনা ঘটছে যখন বলি আমরা, কোন অর্থে বলি? বলছি এই অর্থেই যে, ওই চার মূলনীতির লাঞ্ছনা ঘটছে। ধাপে ধাপে বেড়েছে সেই ঘটনা। জিয়াউর রহমান এসে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে, ছেঁটে ফেললেন সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদকে, বিকৃত করলেন বাংলাদেশি লেবাস তার গায়ে পরিয়ে দিয়ে। এরশাদ এসে ব্যাপারটিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন আরেক ধাপ। পুরোদমে পুনর্বাসন শুরু করলেন মৌলবাদীদের; প্রবর্তন করলেন রাষ্ট্রধর্মের; গণমাধ্যমে সারা দিনমান জয়গান চলল মৌলবাদের।

কেন করলেন তারা এসব কাজ? করলেন এ জন্য যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ছিলেন না। তাদের স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ এক ছিল না। তারা এসেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে, অভ্যস্ত ছিলেন আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে। তাদের সুবিধা হলো ওই পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ায়; বিদেশি সমর্থন পাওয়া গেল, দেশের ভিতরে উঠতি ধনীদের সমর্থন আসতে থাকল। জনগণকে ধর্মের নামে শাসন করার পুরনো পন্থাটাই তাদের জন্য সহজ ছিল, জনগণকে সচেতন করলে বিপদ ছিল জবাবদিহিতার, আশঙ্কা থাকত বিদ্রোহের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো আছে। সেটা কেবল ইতিহাসে ও ঐতিহ্যে নেই, রয়েছে আমাদের স্বপ্নে। এককথায় বলতে গেলে স্বপ্নটা হলো সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের। রূপান্তরের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। সেটা ঘটেনি বলেই আমাদের এত দুঃখ এবং বিপদ।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর