শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের বিজয়

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের বিজয়

৫২ বছর আগে আজকের দিনে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিল। পাকিস্তানের পক্ষে লে. জেনারেল একে নিয়াজি ভারতের পক্ষে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে সই করলেন। পাকিস্তানের সামরিক পোশাকে লাগানো ব্যাজগুলো এক এক করে লে. জেনারেল অরোরার হাতে খুলে দিলেন। তার আগে পাকিস্তানি হানাদার, রাজাকার, আলবদর, আল শামসের মতো জঙ্গি দলকে সঙ্গে নিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল।  এ বিজয় দিবস শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের নয়, গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের জয়।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারকে একটি চিঠি দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিলেন। মুজিবনগর সরকারের স্বীকৃতির চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী লিখেছিলেন- প্রিয় প্রধানমন্ত্রী (তাজউদ্দীন আহমদ) আপনাদের কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনার চিঠিতে আমি এবং ভারত সরকার অভিভূত। পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশকে আপনারা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তা রীতিমতো চমকপ্রদ। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত সরকার পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মনস্থ করেছে। এ ব্যাপারে ভারতের সংসদে আজ সকালেই আমি আমার বক্তব্য পেশ করেছি। তিনি আরও লেখেন- অসীম অত্যাচার সহ্য করে দেশের যুব সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লক্ষ্য নিয়ে যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তা আমাদেরও উদ্বুদ্ধ করেছে। ভারতও একই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী হবে এবং চির অটুট থাকবে।

১৬ ডিসেম্বরের পরে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা নিজেদের দেশে পালিয়ে যান। আমি তখন ঢাকার কন্টিনেন্টাল হোটেলে সকাল থেকে বসে থাকতাম। সুট-টাই পরা এক ভদ্রলোক কাউন্টারে কথা বলছিলেন। আমি তার হাতে একটি ভিজিটিং কার্ড তুলে দিয়ে বললাম, আমি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার। তিনি তার একটি কার্ড দিয়ে বাংলায় বললেন, আমি বাংলা জানি। আমি কলকাতায় পড়াশোনা করেছি। তার নাম মাধব রিমল। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আমলে দূতাবাসগুলোর প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন। তিনি বললেন, আপনি তো খবর চাইছেন। দুপুর ২টার সময় আমার ঠিকানায় চলে আসুন। তখন আমার সঙ্গে ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার অন্যতম প্রধান অরূপ সরকার (যিনি কাগজের মালিক)। বিদেশি দূতাবাসগুলোর মধ্যে চীন ও আমেরিকা আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ২৮টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রস্তাব নিলেন নিজ নিজ সরকারকে জানিয়ে দেবেন তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে যে সরকার চলছে সেটাই সঠিক সরকার। তাদের অভিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

মাধব সাহেব আরও বললেন, মার্কিন ও চীনের দূতাবাস প্রধানরা এ বৈঠকে ছিলেন না। কারণ তারা ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। যেহেতু খবরটা সেদিনের এক্সক্লুসিভ- তাই দ্রুত হোটেলে ফিরে টাইপ করে অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। তার দুই দিন আগেই তাজউদ্দীন সাহেব ঢাকা পৌঁছে তার মন্ত্রিসভা রদবদল করে সিলেটের আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। কাগজে ওই খবর দেখে সামাদ সাহেব সোজা আমার হোটেলে চলে এলেন। তিনি বললেন, আমি জানতে পারলাম না, আপনি এতবড় ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন? আমি বললাম, আমি কিছু ঘটাইনি। ঘটিয়েছেন মাধব রিমল।

যখন নিয়াজি আত্মসমর্র্পণ করল ঢাকার ঘড়িতে তখন বিকাল ৫টা। ওয়াশিংটনে সকাল ৭টা। গর্জে উঠলেন আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি সাংবাদিকদের সামনে বিবৃতি দিয়ে বললেন, এই প্রথম আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি ভারতের এক মহিলার হাতে পরাস্ত হলো। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ওই মহিলা আর শেখ মুজিবকে আমরা উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। শিক্ষা দিয়েছিলেন সপরিবার মুজিব ও ইন্দিরাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু ৫২ বছর আগেকার ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে কলকাতায় বসে খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিনরা ষড়যন্ত্র করছিল বাংলাদেশ যাতে স্বাধীন না হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিল্লিতে কী ঘটেছিল তা উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। ভারতের লোকসভায় তখন ৫৪২ জন সদস্য উপস্থিত। ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় যখন ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছে, ৫৪২ জন সদস্য টেবিল চাপড়ে জয়ধ্বনি করতে শুরু করেন। ইন্দিরা গান্ধী সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, একটা বড় কাজ বাকি আছে। আপনারা গত ৯ মাস যেমন আমার পাশে ছিলেন, তেমনি পাশে থাকুন। সংসদ থেকে পেরিয়ে তিনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ, ব্রিটিশ প্রাইমমিনিস্টার উইলসন, জার্মান চ্যান্সেলর, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান প্রেসিডেন্ট- সবাইকে ফোন করে বলেন, এবার আপনারা পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর