সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

পহেলা বৈশাখ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখে নতুন একটি বছরের শুরু। আমরা চাই নতুন বছর পুরাতন বছর থেকে ভিন্ন হবে; নতুন বছরে সুখ আসবে, উন্নতি দেখা দেবে। আমরা এগোতে পারব নতুন একটি সমাজের দিকে। সেখানে আনন্দ থাকবে, এক দিনের নয়। প্রতিদিনের। আর সেই সুখের অন্তরে থাকবে আত্মপরিচয়ের গৌরব ও আশ্রয় লাভের স্বস্তি এবং তা পূর্ণ হবে ঐক্যের। কেবল মিলন নয়, ঐক্যও। অন্যসব বাঙালির সঙ্গে স্থায়ীভাবে মিলব আমরা, ঐক্যবদ্ধ হবো প্রকৃতি এবং পরিবেশের সঙ্গেও।

পহেলা বৈশাখ অসাম্প্রদায়িক। তার মেলা হিন্দু মেলা নয়, যেমন সে মোহররমের মেলও নয়। তার মেলাটা বাঙালির। যেখানে ক্রয়-বিক্রয় অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা স্থানীয়, আন্তর্জাতিক নয়। বিদেশি পণ্য আসে যদি বা তবু নিতান্ত অল্প। এই মেলা মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্তর্গত নয়। এই অঙ্গনে মেলামেশাটা বিপণি কেন্দ্রের মতো নৈর্ব্যক্তিক ও হৃদয়হীন হয় না। অন্যদিকে আবার পহেলা বৈশাখ ধনী-দরিদ্রের এক সমান করতে চায়। ভাবে সবাইকে সে এক পরিচয়ে পরিচিত করবে। ভাষার পরিচয়। সেটাতো গেলো আকাঙ্ক্ষার পহেলা বৈশাখ। বলা যাবে স্বপ্নের। কিন্তু বাস্তবতাটা কি? বাস্তবে সুখ কোথায়? বাস্তবের পহেলা বৈশাখ তো গ্রীষ্মের। গ্রীষ্মকাল বাঙালির মিত্র নয়। কোনো কালে ছিল না, এখনো নয়। বাঙালির নিজস্ব ঋতু হলো বর্ষা। নরম ও গার্হস্থ। গাঁয়ের মতো। আর সবচেয়ে উপভোগ্য ঋতু যদি বলতে হয় কোনোটিকে তবে সেটি হলো শীত। গ্রীষ্মের ঠিক বিপরীতে যার দাঁড়ানো। পহেলা বৈশাখ তো খরতাপের সূচনা। কোথাও কোনো করুণা নেই, আশ্রয় নেই, কেবল দাহ। দুঃসহ। আতঙ্কজনক। আর যদি কালবৈশাখী আসে তবে স্বস্তি না এনে ধ্বংসই আনে। তাহলে কেন আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ দিন বলব পহেলা বৈশাখকে। বলব একটি মাত্র কারণে, সে হলো নতুন বছরের সূচনা। এ আমাদের নিজেদের বছর। আত্দপরিচয়ের এবং আশ্রয়ের। এখানে আমরা স্বতন্ত্র, সারা পৃথিবী থেকে। আমরা আশা করি নতুন বছর পুরাতন বছরের মতো হবে যা পৃথক হবে অগ্রগতিতে ও সুখে এবং অবশ্যই আমাদেরকে জাতীয়তাবাদী করবে।

পহেলা বৈশাখে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যেই যা চাঞ্চল্য। অত্যন্ত ধনীরা তার ধার ধারে না। তারা নিউ ইয়ার ডে করে। ইয়ার বন্ধু বান্ধবীদেরকে নিয়ে হুল্লোড়ে মাতে। পহেলা বৈশাখ কবে এলো কবে গেলো খবর রাখে না। দরিদ্ররা রাখে খবর। তবে ভিন্নভাবে। আনন্দে নয়, আতঙ্কে। জমিদার গেছে, তবে পাওনাদার আছে। তারা সুদ চায়, পাওনা দাবি করে। খরা নামছে দেখে কৃষকের অন্তরাত্দা শুকিয়ে যায়, তৃষ্ণায়, ঘামে ভয়ে। অভাব ঘটে পানীয় জলের। কঠিন হয় পরিশ্রম করা। গুমোট দেখা দেয় চতুর্দিকে। আশঙ্কা থাকে ঝড়ের। শহরেও সুখ নেই। গলতে থাকে রাস্তার পিচ। দুর্বিষহ হয় তাপ।

যে মধ্যবিত্ত আনন্দ করে পহেলা বৈশাখে সেও ভরসা করে না দীর্ঘস্থায়ী স্বস্তির। দুপুরেই শেষ। বড়ই ক্ষণকালীন। আকজাল পেঁয়াজ মরিচ ইলিশ মাছভাজা দিয়ে পান্তাভাত খাওয়াও তেমন জমে না। ভেজাল জুটেছে তাছাড়া অনভ্যাসের দরুন এক দিন খেয়ে ১০ দিন কাটাতে হয় হজমের অশান্তিতে। তাহলে জরুরি কেন পহেলা বৈশাখ? জরুরি ওই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্যই। জরুরি আকাঙ্ক্ষার কারণে। আকাঙ্ক্ষা তাকে সুখের, সুখের প্রয়োজনে মিলনের, অতীতের সঙ্গে প্রকৃতিও পরিবেশের সঙ্গে, সর্বোপরি মানুষের সঙ্গে। বিচ্ছিন্নতা কাটাতে চায়, ঐক্যবদ্ধ হবার ইচ্ছা রাখে।

২.

কেবল মানুষের নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টাও উঠে আসে পহেলা বৈশাখে। বিশেষ করে এই জন্য যে, আমাদের জীবন অনেক দিক দিয়েই প্রকৃতিনির্ভর এবং পহেলা বৈশাখ ঋতুর যে পরিক্রম ঘটে বাংলাদেশে তারই অংশ। কেবল অংশ নয়, প্রধান অংশ। কেননা ঠিক কবে আসবে প্রথম তারিখ সেটা যারা খেয়াল রাখে না, অথবা প্রয়োজন মনে করে না রাখবার, তারাও বৈশাখ যে এসেছে সেটা টের না পেয়ে পার পায় না। বৈশাখ বড়ই প্রচণ্ড, ভীষণ উগ্র, সে হচ্ছে বাঘের মতো। বাংলাদেশ বাঘের জন্য বিখ্যাত ছিল, বাঘ এখন বিলুপ্তপ্রায়, কিন্তু বৈশাখ আছে, সে থাকবে এবং জানিয়ে দেবে যে, সে আছে।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা হওয়া উচিত দ্বান্দ্বিক। বৈরী নয়, অবৈরী দ্বন্দ্ব। প্রকৃতিকে জয় করেই মানুষের সভ্যতা এগোয়, সংস্কৃতি এগোয়। কিন্তু জয় করা মানে ধ্বংস করা নয়। এমনকি পদানত যদি করে রাখা হয় প্রকৃতিকে, যদি তাকে জব্দ করা হয় পদে পদে, তাহলে কেবল যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তা নয়, প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। নীরবে। যেমন এখন নিচ্ছে। পৃথিবী এখন বিপন্ন। ধরিত্রী তপ্ত। পরিবেশ দুষ্ট। আশঙ্কা এই যে, পানির নিচে ডুববে কোনো অংশ আর কোথাও দেখা দেবে প্রচণ্ড খরা। লক্ষণ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

আমাদের দেশে অবশ্য উল্টোটা ঘটেছে, প্রকৃতিকে আমরা জয় করব, পদানত করব ইত্যাদি মনোভাব নিয়ে বের হই। আমরা চেয়েছি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। প্রকৃতির কৃপাপ্রার্থী হয়েছি অনেক সময়। বৃষ্টি পড়লে তবেই ফসল হয়েছে। প্রার্থনা করেছি ঝড় যাতে না হয়, অথবা বন্যা কিংবা খরা। প্রকৃতির উর্বরতা আমাদের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। একদিকে দেখা দিয়েছে অল্পে সন্তুষ্টি। সহজেই পাওয়া যায় এবং বেশি না পেলেও চলে যায়- এই চেতনা দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হয়ে গেছে। তা ছাড়া বর্বরতাকে মানবিক গুণ হিসেবেও আদর্শায়িত করা হয়েছে। বিশেষ করে সন্তান প্রজননের ক্ষেত্রে। জনসংখ্যার এই যে প্রচণ্ড আধিক্য, এটি এমনি এমনি ঘটেনি, এর পেছনে একটি দার্শনিক কারণও রয়েছে বৈকি। সেটি হচ্ছে এই যে, উর্বরতাই শ্রেয় এবং প্রমাণ দেওয়া প্রয়োজন ধারণ করার শক্তির। বন্ধ্যত্বের চেয়ে অভিশপ্ত আর কিছু আছে বলে মনে করা যায়নি। প্রকৃতির ওপর নির্ভরতা দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকেও পুষ্ট করেছে, পরগাছা হওয়ায় প্রকৃতিকে উৎসাহিত করেছে সে ভেতর থেকে। সন্তানের দায়িত্ব নেয় না যে পিতা, অপারগ হয় সেক্ষেত্রে, সে অন্য কোনো দায়িত্ব নেবে?

কিন্তু এখন প্রকৃতি আর আগের মতো নেই। সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। ক্রমাগত বৈরী হয়ে পড়ছে। তাছাড়া তার ধারণক্ষমতাও কমে এসেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ অসুস্থ। খাবার পানিতে আর্সেনিকের বিষ। খরা দেখা দিচ্ছে অনেক এলাকাতে। মশার উৎপাত বাংলাদেশের সর্বত্র। মানুষ শত্রুতা করেছে প্রকৃতির সঙ্গে, ফলে প্রকৃতি বিরূপ হয়েছে, এ রকম কথা বলা যাবে। বলা সহজ বটে, স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু মানুষতো নয়, প্রকৃতির আসল শত্রু হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট পুঁজিবাদ। সে-ই ধ্বংস করেছে প্রকৃতিকে, আসল কুড়াল তারই হাতে। মানুষের হাতেই এই পুঁজিবাদের সৃষ্টি কিন্তু এখন মানুষের চেয়ে সে অনেক বড়, অনেক শক্তিশালী। সে হচ্ছে দৈত্য, বলা যায় দানব। সামন্তবাদের অনেক দোষ ছিল; সে ছিল সীমাবদ্ধ, কিন্তু ওই সীমাবদ্ধতাই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার একটা গুণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। কৃষিকে সে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করত এবং সেই কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার জানত না, জেনেছে যখন তখনো যন্ত্রের ব্যবহার করেনি। কৃত্রিম সার দেওয়ার কথাও তার ধারণাতে আসেনি।

কিন্তু পুঁজিবাদ ভিন্ন স্বভাবের। তার অনেক গুণ, মানুষকে সে মুক্তি দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের গ্রাম্য সংকীর্ণতা থেকে, মানুষের উদ্ভাবন ক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতাকে অবারিত করে দিয়েছে। কিন্তু তার অন্তরে আছে দস্যুতা। সে ভালোবাসে লুণ্ঠন করতে। মুনাফা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এই মুনাফার লোভে পৃথিবীময় প্রকৃতির সঙ্গে তার শত্রুতা প্রকৃতিকে দিচ্ছে নষ্ট করে। ক্রমাগত পৃথিবীকে অনুপযুক্ত করে তুলেছে মনুষ্য বসবাসের পক্ষে।

পুঁজিবাদী ইংরেজ বণিক এ দেশে নীল চাষের প্রবর্তন করেছিল। তাতে ধান চাষের ক্ষতি হয়েছে। সর্বনাশ হয়েছে নীল চাষে বাধ্য করা হয়েছে যে কৃষক তাদের। পাট চাষও ওই বণিকদেরই স্বার্থে। পাট চাষের স্বার্থে ডোবা-নালা-খালের পানি বিপন্ন হয়েছে, পচা পাট ধুতে গিয়ে পানি নষ্ট হয়েছে। চাষি মরেছে জোঁক ও মশার কামড়ে। দুর্গন্ধে ছেয়ে গেছে গ্রাম ও গৃহ। মুনাফা হয়েছে বিদেশি বণিক ও তাদের দেশি অনুচরদের। এখন এসেছে চিংড়ি। চিংড়ির ঘের বিপন্ন করছে বাংলাদেশের উপকূল, মুনাফা করছে বণিক। রপ্তানি করো নয়তো ধ্বংস হও, এই আওয়াজ তোলা হয়েছে, আসলে যা ঘটেছে বাংলাদেশে তা হলো রপ্তানি করো এবং ধ্বংস হও।

প্রকৃতি এক ধরনের সাম্যে বিশ্বাস করে, তার মূলনীতিকে সাম্যবাদী বলা অসম্ভব নয়। তার আকাশ সবার জন্য, সমুদ্রও তাই। প্রকৃতি যখন বৃষ্টি বর্ষণ করে তখন আলাদা করে দেয় না, সবাইকেই দেয়। রোদও তাই। মানুষকে সে বৈচিত্র্য দিয়েছে, কিন্তু কাউকে মানুষ কাউকে দৈত্য করতে চায়নি। পতঙ্গও নয়। মানুষের নিজস্ব স্বার্থ দানবীয় আকার নিয়ে, আবার কখনো লুকানো কীটপতঙ্গ হয়ে প্রকৃতির সাম্যনীতিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। দেয়াল উঠেছে মস্ত মস্ত, অন্তর্ঘাত চলছে গোপনে গোপনে। তাই, পহেলা বৈশাখ এমনি এমনি আসবে না, তাকে সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বৈষম্য দূর করার সংগ্রাম। অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

 

সর্বশেষ খবর