সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা

আহমদ রফিক

পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা

বাংলা নববর্ষ, শুভ নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ- রাজধানী ঢাকায় বেশ কিছুকাল থেকে মহাউৎসবের এক চালচিত্র। বৈশাখী তাপে সমান মাত্রায় বাঙালিয়ানার আবেগ ঝরে পড়তে থাকে। গান, বাজনা, নৃত্যগীত, চিত্রকলার ছাত্র-শিক্ষকদের কল্যাণে রংবেরঙের সাজসজ্জা ও মিছিল। রমনা উদ্যানে অশ্বত্থতলে (ভুলে বটমূল শব্দটি এখনো বহুল প্রচলিত) ভোরের আর্দ্র হাওয়ায় সুরের মাতামাতি : 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো'। বৈশাখী নববর্ষের প্রকৃত রূপের একটি নিখুঁত চিত্র ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের ওই গানে। এ উৎসব রাজধানী ঢাকায় মূলত তরুণ ও যুবকদের হলেও নানা বয়সের মানুষ এ উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন। এমনকি কিছুসংখ্যক আমলা-মুৎসুদ্দি বা পেশাজীবী শ্রেণীর সংস্কৃতিমনস্ক মানুষও একদিন্কা বাঙালিয়ানার টান তারা এড়াতে পারেন না, যে বাঙালিয়ানা ঊনসত্তর-সত্তরে হঠাৎ জাগা প্রবল জোয়ারি ঢেউয়ের মতো দেখা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই যথারীতি মিলিয়ে যায়।

এ দিনটিতে শুধু ঢাকার রাজপথই সরগরম হয়ে ওঠে না, অনেক বাড়িতেই আয়োজন দই, মিষ্টি ও বৈশাখী মৌসুমের ফল, বিশেষ করে তরমুজ, বাঙ্গি, খিরা, যে যেমন ভালো বোঝেন। সংস্কৃতিমনস্ক বাড়িতে গানবাজনার আয়োজন এবং তা প্রাতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের বাইরে। একটি আবেগতক্ত সংগীতমুখর দিন বৈশাখী নববর্ষ। এ সমাপন যতই আনুষ্ঠানিক হোক এর তীব্রতা ও নাগরিক ব্যাপকতা অস্বীকারের উপায় নেই।

পাকিস্তানি আমলের শুরুতেই ঢাকায় বাংলা নববর্ষের উদযাপন ছিল দ্বিধাজড়িত পদে। এর কারণ রাজনৈতিক-সামাজিক, অংশত ধর্মীয় চেতনার প্রভাবে। পাকিস্তানি শাসকদের বড় অপছন্দের ছিল বাঙালিয়ানা ও তার সাংস্কৃতিক প্রকাশ। তা ছাড়া শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের বড়সড় অংশে পাকিস্তানি চেতনার প্রভাব তখন যথেষ্ট। তার আত্মপরিচয়ের ধোঁয়াশা তখনো কাটেনি (এখনো কতটা কেটেছে, কত শতাংশের মধ্যে কেটেছে তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ যথেষ্ট)।

তাই একাধিক কারণে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় বৈশাখী নববর্ষ উদযাপন অনেকটা হাঁটি হাঁটি পা পা করে, সীমিতসংখ্যক পরিবারে বা ব্যক্তিমানসে। তবে গ্রামাঞ্চলে বৈশাখী নববর্ষ তার ঐতিহ্য অনুযায়ী পালিত হয়েছে। যেমন চলেছে বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী গ্রামীণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা বা পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠান। এদিক থেকে খাঁটি বাঙালিয়ানার প্রকাশ ছিল পাকিস্তানি আমলের গ্রামবাংলাতে এবং তা সম্প্রদায়-নির্বিশেষে।

আরও আগে অবিভক্ত বঙ্গের গ্রামাঞ্চলে বৈশাখী নববর্ষ পালন ছিল মূলত হালখাতার দই-মিষ্টি ও দেনা-পাওনা মেটানো এবং জমজমাট বৈশাখী মেলার উৎসবে। ওই মেলায় কী ছিল না? রংবেরঙের জিনিসপত্র, যেমন ছোটদের তেমনি বড়দেরও উপযোগী। অশ্বত্থতলা বা বটতলা সরগরম হয়ে উঠত নানারকম বাঁশি ও ঢোলের আওয়াজে, নানা রং বেলুনের ঝলমলে রূপে। চুড়ি, ফিতা, কাঁটা, পোড়ামাটির ছোট্ট রঙিন পুতুল, বিচিত্র চেহারার দেশি-বিদেশি বাঁশি, নানারকম মিষ্টিমিঠাই মণ্ডা, মায় বিদেশি সোডাওয়াটার বোতল, কী না পাওয়া যেত ওই মেলায়। বড়দের জন্য আয়োজনও কম ছিল না- শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, চাদর থেকে কৃষি সরঞ্জাম পর্যন্ত। সম্প্রদায় চেতনার কোনো প্রকাশ সেখানে দেখা যেত না। গ্রামীণ বৈশাখী নববর্ষের উদ্যাপন ছিল যেমন সর্বজনীন তেমনি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের। রাজধানীতে কোথায় কি ঘটল তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না।

পাকিস্তানি চেতনার বিরূপ পরিবেশেই ঢাকায় পঞ্চাশের দশক থেকে আটপৌরে রূপ নিয়ে বৈশাখী নববর্ষের যাত্রা। দু-একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন সাহস করে বৈশাখী নববর্ষকে আনুষ্ঠানিক রূপে প্রকাশের চেষ্টা চালিয়েছে। যেমন ১৯৫১ সালে ঢাকার 'লেখক শিল্পী মজলিশ' আমন্ত্রণপত্র ছেপে 'শুভ নববর্ষ' উদ্যাপনের আয়োজন করেছিল। বেশ ঘটা করে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, দেশাত্দবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তির মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ষ শুরুর জমজমাট উদ্যাপন। ঢাকা বেতারের জনাকয়েক সংগীত শিল্পী এতে অংশ নিয়েছিলেন কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে।

এর এক বছর পরই তো একুশে ফেব্রুয়ারি তথা বিস্ফোরক ৮ ফাল্গুন গোটা পরিবেশ, পরিস্থিতি পালটে দেয়। যতটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তার চেয়ে অনেক বেশি সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে। বাঁকফেরা ওই প্রভাবে শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিই উচ্চারিত হয়নি, ভাষিক জাতীয়তার আভাসও ফুটে ওঠে অনেকটা আত্দপ্রত্যয় নিয়ে। সেখানে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে ছিল প্রগতিচেতনার মেলবন্ধন। বৈশাখী নববর্ষ ওই আয়োজনে কিছুটা হলেও জ্বালানি যোগ করতে পেরেছিল। রক্ষণশীলতার দেয়ালগুলো একে একে ভেঙে পড়েছে।

১৯৫৪ সাল এদিক থেকে নানারূপে নিজেকে দেখতে চেষ্টা করেছে আত্মচেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে। ওই বছর যেমন শহর ঢাকায় নববর্ষের জমজমাট উদ্যাপন (যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেবের অসাধারণ একটি অভিনন্দনমূলক বৈশাখী ভাষণ স্মর্তব্য) তেমনি দেশের সর্বত্র বিশেষ করে জেলা শহরগুলোতে বৈশাখী উদ্যাপন ছিল লক্ষ্য করার মতো। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিচারে ১৯৫৪ সাল ছিল এক ধরনের দিকনির্দেশক, অসাধারণ একখণ্ড সময়। প্রবল আবেগ-উদ্দীপনা নিয়ে ওই বছর উদ্যাপিত হয়েছিল পহেলা বৈশাখ তার নানামাত্রিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে এসব ঘটনা সুনজরে দেখেনি, তার প্রমাণ বাঙালি পেয়েছিল মাস কয়েকের মধ্যেই।

সময়টা ছিল মূলত সাংস্কৃতিক কিন্তু খুবই স্বল্প পরিসরে বাঙালি রাজনীতির জন্য বিজয়ের। আর শুভ বৈশাখী নববর্ষের জন্য দেশভাগের (১৯৪৭ আগস্ট) পর সেই প্রথম দেশজুড়ে আনুষ্ঠানিক উৎসব অনেকটা বিজয় উৎসবের মতো। যেমন শহর ঢাকার ছাত্রাবাসগুলোতে, শিক্ষায়তনে তেমনই পুরান ঢাকার কোনো কোনো মহল্লায় বৈশাখী অনুষ্ঠান- গান, আবৃত্তি, বক্তৃতা ও গীতিবিচিত্রা নিয়ে। যেন হঠাৎ আবেগের উৎসার।

এ সমাপনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস, পূর্ববঙ্গ লেখক সংঘ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, আজিমপুর ছাত্রসংঘ বা কলতাবাজার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মতো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলোও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। প্রধানত যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক বিজয় ওই বছর সাংস্কৃতিক উদ্দীপনা প্রকাশের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে বাঙালি চেতনার সাংস্কৃতিক প্রকাশ অনেককেই বিস্মিত করে। পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে সেই প্রকাশের কেন্দ্রবিন্দু।

পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের যাত্রাপথে রাজনৈতিক পরিসরে বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রকাশ যত শক্তিমান হয়েছে বৈশাখী নববর্ষের মুখে আলোর আভা তত উজ্জ্বল হয়েছে। ওই আভায় ছিল জাতি চেতনার আবেগ, তথা বাঙালিয়ানার প্রতিফলন। এর সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ছিল এক ধরনের নিশ্চিত আত্দিক সম্পর্ক, যা ঐতিহ্যবাহীও বটে। মূলত গ্রামীণ বৈশাখী নববর্ষের ধারাবাহিকতা নিয়ে নাগরিক নববর্ষের প্রকাশ ও বিকাশ, যদিও এক্ষেত্রে রাজনীতির একটি লক্ষণীয় ভূমিকা ছিল প্রেক্ষাপট বিচারে। রাজনৈতিক চেতনা এ জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব-অনুষ্ঠান বিকশিত হতে সাহায্য করেছে।

অন্যদিকে সেক্যুলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তাও সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে সহায়ক হয়েছে। প্রসঙ্গত, রমনার অশ্বত্থতলায় ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের বৈশাখী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা এবং পরবর্তীকালে এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা উল্লেখ করার মতো। ওই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গণসংস্কৃতির প্রকাশ। 'ক্রান্তি' নামক গণসংস্কৃতির সংগঠনের জনপ্রিয় যাত্রাও বিশেষ ঘটনা।

তারুণ্যের এ সাংস্কৃতিক পথচলা শহরবাসীর জন্য ছিল জাতীয়তাবোধ ও প্রগতি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার অবকাশ। আর সেই সূত্রে এক দিনের জন্য হলেও বৈশাখী নববর্ষ উপলক্ষে বাঙালিয়ানার বন্ধনে বাঁধাপড়া, নিজেকে দেখা। জাতিচেতনার আবেগ যে কতটা প্রখর হতে পারে তার প্রমাণ মেলে রমনায় 'এসো হে বৈশাখ'-এর ক্রমবর্ধমান বিপুল জনপ্রিয়তা, যা নানা বাধাবিপত্তি পার হয়ে এগিয়ে চলে।

এ আবেগ গণসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঊনসত্তর-সত্তরে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চেতনার বিপুল প্রকাশ ঘটায়। আর সত্তর দশকে রমনার অশ্বত্থতলার আবেগ দ্রুতবেগে এগিয়ে চারুকলার বকুলতলায় গিয়ে ঠাঁই নেয়, যা রাজনৈতিক ভিন্ন বাঁকফেরা সত্ত্বেও বৈশাখী আবেগের প্রকাশে পিছু হটে না। এখনো হটেনি। পহেলা বৈশাখে ঢাকার রাজপথে মানুষের ঢল ও নানা চরিত্রের সংগঠনের উপস্থিতি তেমনই প্রমাণ দেয়। নানা কলার সমন্বিত উদ্যোগে বৈশাখী মিছিল ও লোকশিল্পের মডেলে তৈরি নানা রং হাতি-ঘোড়া ও মুখোশ প্রাচীন বাঙালি ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।

পহেলা বৈশাখ যেমন জাতীয় ছুটির দিন, আনন্দ, উৎসবের দিন তেমনি জাতীয় চেতনা প্রকাশেরও দিন। সেসব বিচারে দিনটি 'জাতীয় উৎসব' হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। এ প্রস্তাব এযাবৎ বহুবার রাখা হয়েছে, রেখেছেন আরও কেউ কেউ, কিন্তু বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনি। অথচ পহেলা বৈশাখের জনমুখী চরিত্র একে জাতীয় উৎসবের অঙ্গনেই পৌঁছে দেয়, বিশেষ করে এর সর্বজনীন, সম্প্রদায় নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য বিচারে। মনে রাখার মতো ঘটনা যে, স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় পাখি, জাতীয় ফল ইত্যাদি সবই আছে, নেই শুধু জাতীয় উৎসব দিবস। ক্ষমতাবানদের কেউ ভাবছেন না এ বিষয়টি নিয়ে।

 

সর্বশেষ খবর