সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

বাঙালির নববর্ষ

সেলিনা হোসেন

বাঙালির নববর্ষ

নববর্ষ একটি নতুন, অন্যরকম সূর্যোদয় উদ্ভাসিত করে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে। আমরা নতুন আলোয় দেশটাকে দেখতে চাই। বড় বেশি জঞ্জালে ভরে গেছে এ দেশের মানুষের জীবন। আমরা নতুন সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই- এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।

আমরা তোমাকে চাই বৈশাখ। তোমার রুদ্র তাণ্ডব, বৈশাখী ঝড়, জীর্ণ পাতা উড়িয়ে নেওয়ার অমিত শক্তি, শান্ত-স্নিগ্ধ তারাভরা আকাশ, বৃষ্টির অপরূপ ছোঁয়া। দহন এবং স্বস্তির সমন্বয়ে আমরা ভরে তুলতে চাই জীবনের বিশাল ক্যানভাস।

তোমার কাছে প্রার্থনা বৈশাখ। রংধনুর সাত রং দিয়ে একটি ফুল বানিয়ে দাও আমাদের। আমরা এ দেশের জন্য জীবনদানকারী লক্ষ শহীদের স্মরণে ভরে দেই স্মৃতিসৌধ, দেশজুড়ে গড়ে ওঠা স্মৃতিস্তম্ভ এবং গণকবরগুলো। আমরা শহীদের পবিত্র আত্দাকে বলতে চাই, আমাদের হৃদয়ের সবকটি জানালা ওদের জন্য খোলা আছে। ফুলের রঙে ভরে উঠুক দিগন্ত রেখা পর্যন্ত টানা স্বদেশের সীমানা- সৌরভে ভরে উঠুক প্রতিটি মানুষের হৃদয় এবং ১৫ কোটি মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখুক শহীদদের। এই স্মরণ যেন কোনো দিনের বেড়াজালে বন্দী না থাকে। বৈশাখ দেবে কি সাত রঙের একটি ফুল?

বাংলার নববর্ষ বাঙালির জীবনে শুধু একটি মাত্র দিন নয়। একটি মাত্র উৎসবও নয়। এই দিনকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হয়েছে বহুমাত্রিক অর্থ। জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার যে মৌল দর্শন একটি জাতির চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করে সেই অর্থের সবটুকু ধারণ করে আসছে বাংলা নববর্ষ দিন। এই উৎসব বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌল অনুপ্রেরণা। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির আকর আধার। মনুষ্যত্ব বিকাশের শুভ শক্তি। আত্দপরিচয় বৃদ্ধির মূল ক্ষেত্র। বিশ্বজোড়া মেলবন্ধনে মানবিকতার মৌলিক শর্ত।

বাংলা নববর্ষের উৎসব আছে বলে বাঙালির পরাজয় নেই। জাগরণের ঘণ্টাধ্বনি বাজায় এই উৎসব। মানুষ জড়ো হয় আপন নিয়মে। এই উৎসব শহরের ইট-কাঠ থেকে গ্রামের মেঠোপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য অর্থে বলা যায় এই উৎসব বয়ে এনেছে শস্যদানা। জলবর্তী মেঘ। রুপালি ইলিশ। বিনয় বাঁশির ঢোল। এখন এর সবটুকু শহরের প্রতিটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন। স্পন্দিত হয় পুরো দেশ। মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় তার সংস্কৃতির বিবর্তন গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন- 'আমরা ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম করছি যে দেশকে স্বাধীন করাই যথেষ্ট নয়। দেশের মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে, সৃষ্টি করতে, নির্মাণ করতে শেখাতে হবে। পশ্চিমের সঙ্গে, আধুনিকের সঙ্গে পা মিলিয়ে নিতে হবে। পশ্চাতের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করতে হবে। জনগণের সঙ্গে লোক-সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। সার্থক সংস্কৃতির এই তিনটি ডাইমেনশন।'

বাংলা নববর্ষ সংস্কৃতির এই তিনটি ডাইমেনশনকে বাঙালির মর্মমূলে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। বাঙালি বুঝতে পেরেছে এই গোড়াটুকু আছে বলেই কোনো অপশক্তি তাদেরকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। পাকিস্তান আমলের পুরো সময় ধরে এই চেষ্টা করেছে পাকিস্তান সরকার। এই শক্ত বাঁধনটুকু ছিল বলেই দন্ত-নখর বিস্তৃত করেও কিছুই করতে পারেনি তারা। বরং বাঙালি আত্দশক্তি সঞ্চয় করেছে আরও প্রবলভাবে।

ঢোল বাঙালির প্রাচীনতম লোকনাট্য-যন্ত্র। উৎসবে বেজেছে-আনন্দের ধ্বনি হয়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়েছে। প্রয়োজন বেজেছে-ঢোল পিটিয়ে মানুষকে জড়ো করা হয়েছে, মানুষের কাছে খবর পৌঁছানোর জন্য সংকেত দেওয়া হয়েছে। প্রাচীনকালে হাট-বাজারে ঢোলের বাড়ি পড়লে মানুষ দৌড়ে আসত, বুঝে নিত যে তাদের জন্য কোনো জরুরি বার্তা আছে।

বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে মৌলবাদী জঙ্গিরা বোমা ফাটায়। যখন যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে কিংবা নেত্রকোনার অনুষ্ঠানে বোমা ফাটে। অশুভ শক্তির বার্তায় মানুষ পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে আর একটি নববর্ষ উৎসব উদযাপন করে।

বাঙালি পথচলায় নববর্ষ বাতিঘর। বিভ্রান্তির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই বাঙালির। অমোঘ শক্তির দীপ্ত তার মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নববর্ষ প্রবন্ধে বলেছেন, 'এই মহিমান্বিত জগতের অদ্যকার নববর্ষ দিন আমাদের জীবনের মধ্যে যে গৌরব বহন করিয়া আনিল, এই পৃথিবীতে বাস করিবার গৌরব, আলোকে বিচরণ করিবার গৌরব, এই আকাশতলে আসীন হইবার গৌরব, তাহা যদি পরিপূর্ণভাবে চিত্তের মধ্যে গ্রহণ করি, তবে আর বিষাদ নাই, নৈরাশ্য নাই, ভয় নাই, মৃত্যু নাই।'

বাংলাই এই গৌরবের জায়গাটি তৈরি করেছে। মাতৃভাষার জন্য প্রাণদান করে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা ভাষার স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করে উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দিয়েছে। তারপরও বলতে হবে দুটো গভীর ও ব্যাপক অর্জন বাঙালির সামনে পাহাড় সমান উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক. যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী পরাধের বিচার এবং দণ্ড প্রদান। দুই. হতদরিদ্র মানুষের জীবন থেকে দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে তাদের মানসম্মত জীবনযাপনের ব্যবস্থা প্রদান করা। নইলে রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে নববর্ষকে মূলে রেখে যে আনন্দের কথা বলেছেন তা প্রকাশ্যের যথার্থতা এই দেশে থাকবে না, যারা বাংলা নববর্ষের উত্তরাধিকারী। রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে একটি ঋষিবাক্য উল্লেখ করে বলেছেন, 'কেই বা শরীরচেষ্টা করিত, কেউ বা প্রাণধারণ করিত যদি এই আকাশে আনন্দ না থাকিত। আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া তিনি আনন্দিত, তাই আমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত, আমার রক্ত প্রবাহিত, আমার চেতনা তরঙ্গিত। তিনি আনন্দিত, তাই সূর্যলোকের বিরাট যজ্ঞহোমে অগি্ন-উৎস উৎসারিত; তিনি আনন্দিত, তাই পৃথিবীর সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া তৃণফল সমীরণে কম্পিত হইতেছে। তিনি আনন্দিত, তাই গ্রহে নক্ষত্রে আলোকের অনন্ত উৎসব। আমার মধ্যে তিনি আনন্দিত, তাই আমি আছি, তাই আমার গ্রহতারকার সহিত লোকলোকান্তরের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তাহার আনন্দে আমি অমর, সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অসাধারণ বাক্য সংযোজন করেছেন সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার সমান মর্যাদা।' বাঙালির সামনে আজ এই চ্যালেঞ্জ। বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে বাঙালিকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।

বৈশাখ, বাঙালিকে একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে দাও। বাঙালি যেন বলতে পারে 'হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।' বৈশাখী ঝড় অনৈক্যের জায়গাটিকে উৎখাত করে ঐক্যের জায়গাটি সমান করে দিক। মানুষ হিসেবে বাঙালির শুভবুদ্ধি একাত্তরের চেতনার মতো দীপ্র হয়ে উঠুক। স্বদেশ যেন বাঙালির চেতনায় সবটুকু জায়গায় অমলিন থাকে, যেন সে বোধে কোনো ফুটো তৈরি না হয়- যেন ব্ল্যাক হোলের মতো সে ফুটো স্বদেশকে গ্রাস না করে। বৈশাখ বড় মিনতি তোমার কাছে- তুমিই তো পারও বলতে 'মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা।' তুমিই পার জাতির জীবনের জমে যাওয়া আবর্জনা দূর করতে- বাঙালিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তুমি শক্তি দাও।

কেন তোমার কাছে প্রার্থনা বৈশাখ? স্বাধীনতা-পরবর্তী জীবনের যাত্রাপথে সামনে এগোনোর বদলে আমরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছি বলে কি? যে সুষম জীবনব্যবস্থা আমাদের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিলে আমরা প্রকৃত মানুষের জনগোষ্ঠী হতে পারতাম বলে কি?

বৈশাখ বড় গভীর প্রার্থনা তোমার কাছে। বৈশাখ তুমি কি এমন একটি বোধের চেতনায় বদলে দিতে পার ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডটিকে।

 

সর্বশেষ খবর