সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

গ্রামীণ শহুরে নববর্ষ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

গ্রামীণ শহুরে নববর্ষ

বাঙালির জীবনে নববর্ষের সংস্কৃতি বরাবরই ছিল গ্রামীণ জনজীবননির্ভর। সে সংস্কৃতির উৎপত্তি এবং বিকাশ ছিল নগরায়ন-পূর্ব ঘটনা। বাংলাদেশের নগরায়ন বলতে যা ঘটেছে, সে হচ্ছে প্রধানত ক্ষমতা-কেন্দ্রের ভৌত সম্প্রসারণ এবং (শাসন) ক্ষমতা প্রয়োগ ও তার সংরক্ষণের স্বার্থে একটি শ্রেণী-বিন্যস্ত জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক বিস্তার। পশ্চিমের মতো শিল্প উৎপাদন ও পুঁজি বিকাশের অনিবার্যতা হিসেবে এখানে নগরের উদ্ভব হয়নি। এ জন্য বাংলাদেশের নগর বলতে রাজধানী শহরের বাইরে সংঘবদ্ধ শহুরে লোকালয়ের অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না। গ্রামই ছিল প্রধান সংঘবদ্ধ লোকালয়। গ্রামই নিয়ন্ত্রণ করত বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন। ক্ষমতাকেন্দ্ররূপী নগর হয়তো তার রাজনৈতিক জীবনটা নিয়ন্ত্রণ করত এবং গ্রামের সঙ্গে দূরত্ব রচনার জন্য এক সময় একটি নিজস্ব সংস্কৃতিও গড়ে তুলেছিল নগর। সে সংস্কৃতি সচেতনভাবে ইলটধর্মী হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত শহুরে সংস্কৃতি বলে যে জীবনাচরণ এদেশে ঊনিশ শতক থেকে গড়ে ওঠে, সেটি ছিল ক্ষমতার আরও পাশে থাকা মানুষজনের সংস্কৃতি; তাকে ক্ষমতাবাদী বলা যায়, সামন্তবাদীও বলা যায়; তাতে গ্রামের সঙ্গে পার্থক্য রচনার একটি প্রয়োজন দাঁড়িয়ে যায়, যেহেতু গ্রাম ছিল প্রান্তিক অবস্থানে।

গ্রামে বাস করত চাষা-ভুষা এবং নিম্নকোটির মানুষজন। গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত জীবনচর্চাকে 'গ্রাম্য' আখ্যায়িত করে একটি নেতিবাচক অবস্থানে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। শহুরে সংস্কৃতির এই উন্নাসিকতা, বিশেষ করে গ্রাম সম্পর্কে, এখনো বিদ্যমান।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে বাংলাদেশের শহুরে সংস্কৃতি ছিল শাসকশ্রেণীর জীবনাচরণ প্রভাবিত। মোগল, পাঠান ও সুলতানি শাসকদের সুবেদার বা তার অধস্তনরা বাস করত ঢাকায়। তাদের আনুগত্যে ও আনুকূল্যে থাকত নওয়াব, জমিদার, ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য শ্রেণী। তাদের সংস্কৃতিতে বাইরে থেকে আসা শাসক-প্রশাসকদের সংস্কৃতির প্রভাব ছিল প্রচুর। যেমন ঊনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটলে ইংরেজদের সংস্কৃতির অনুকরণটা প্রিয় হয়ে দাঁড়ায় একশ্রেণীর মধ্যবিত্তের কাছে। কলকাতায় এটি বেশ তীব্র ছিল ঢাকার তুলনায়; কারণ সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি ছিল বিস্তৃত এবং ইংরেজি শিক্ষায় তারা ছিল যথেষ্ট উৎসাহী।

'গ্রাম্য' আখ্যা লাভের পরও অবশ্য গ্রামের মানুষের, অর্থাৎ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির বিকাশ থেমে থাকেনি। থেমে থাকলে সেটি সংস্কৃতি হয় না; সংস্কৃতি কখনো স্থবির হয় না। এই একটি শর্তই হচ্ছে চলমানতা এবং বহমানতা। সংস্কৃতি হচ্ছে নদীর মতো; নদীকে যে নামেই ডাকা হোক, সে মুখ লুকোবে না। কেন লুকোবে?

তবে সংস্কৃতির বিকাশের জন্য কিছু অবস্থা, কিছু পরিস্থিতির প্রয়োজন। সেসব না হলে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, অথবা তাতে বাইরের নানান উপাদান জমতে থাকে- নদীতে যেমন পলি পড়ে নদীর বুকটা ভরাট হয়ে যায়। যদি গ্রামের অর্থনীতি সংকটগ্রস্ত হয়, ফসল না ফলে; খরা ও বন্যায় এবং মহামারিতে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয় এবং এসবের সম্মিলিত প্রভাবে যদি গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ শহরে চলে যায় উদ্বাস্তু হয়ে, তাহলে তার সংস্কৃতিতে একটা স্পর্শ পড়ে এসবের, অনেক উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হারিয়ে যায়। বাঙালি সংস্কৃতির আদি রূপটি- যে কোনো সংস্কৃতির মতোই, বস্তুত খুবই মানবিক উদার এবং ধর্মনিরপেক্ষ যদিও ধর্মের একটা উপস্থিতি অনিবার্যভাবেই সে সংস্কৃতিতে থেকে যায়। যেমন, গ্রামের বয়াতি গান ধরেন আল্লাহ-রসূলের নামে এবং তাতে মাথা দুলিয়ে সায় দেন হিন্দু শ্রোতারা। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা যদি উদারনৈতিকতার জায়গা দখল করে নেয়, তাহলে ওই সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশ থেকে বহু হিন্দু ভারতে চলে গেলেন, কিন্তু অনেকে থেকেও গেলেন। তাতে শুরুতে যে আশঙ্কাটি দেখা গিয়েছিল, বাঙালি সংস্কৃৃতিতে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুপস্থিতিজনিত একটা শূন্যতা, সেটি বাস্তবে পরিণত হয়নি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ওই রকমই একটি আশঙ্কার সৃষ্টি করল। তারপরও দীর্ঘদিন সেই আশঙ্কাটি মূলতবি ছিল; কিন্তু আশির দশক থেকে বাংলাদেশে যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আবির্ভাব ঘটেছে, সেটি এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে উদারনৈতিক জীবনাচরণের প্রতি। এখন নানান গ্রামীণ জনপদের নাম পরিবর্তন করার ফতোয়া দিচ্ছে মৌলবাদীরা যেহেতু সেগুলো হিন্দু কোনো ব্যক্তির বা দেবদেবীর নামে।

গ্রামীণ সংস্কৃতির আরও বিপদ ঘটে যখন তাতে শহুরে মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ সেটি ঘটেছে খুবই সামান্য, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মিডিয়ার, বিশেষ করে সিনেমা ও অন্যান্য দৃশ্য মাধ্যমের বদৌলতে। গ্রামের সমাজেও এখন মধ্যবিত্তের উদ্ভব হয়েছে, পড়ালেখা লিখে এখন তারাও প্রতিষ্ঠিত। গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে, সিনেমা হল তৈরি হয়েছে; গ্রামে এখন প্রচুর টেলিভিশন যন্ত্র। গ্রামের মানুষ এখন অভ্যস্ত শহুরে সংস্কৃতির চর্চায়। সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন লিখেছিলেন তার এক প্রতিবেদনে- গ্রামের গরুর গাড়ির চালক এখন প্রায়শই সিনেমার গান গায়, ভাওয়াইয়া গায় না। সেই ভাওয়াইয়া গাওয়া হয় শহরের নানান সংগীতানুষ্ঠানে।

বাঙালি সংস্কৃতির একটি ক্রান্তিকাল যাচ্ছে এখন- এ কথাটি সহজেই বলা যায়। বাঙালি সংস্কৃতিতে এখন এত কিছু ঘটছে একসঙ্গে, এত উপাদান জড়ো হয়েছে এর ভেতরে- সেগুলোর কোন্টা উপকারী, কোন্টা নয় সে চিন্তাটি এক মহা উদ্বেগ সৃষ্টি করার কথা যে, বাঙালি সংস্কৃতি বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি, সে বিষয়ে মতৈক্যে পেঁৗছানোটা এখন এক কঠিন ব্যাপার। এই নববর্ষের সংস্কৃতির কথাই ধরা হোক। এক সময় এটি কৃষিকাজের সঙ্গে এবং জমিদারদের খাজনা আদায়ের সঙ্গেই সম্পর্কিত ছিল। আর ছিল ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে কেনাবেচার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের হালখাতা বন্ধ ও শুরুও উৎসবের সঙ্গে জড়িত। বাদশা আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেন বাংলার শস্য উৎপাদন এবং খাজনা আদায়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের জন্য। তুলনায় ইউরোপে পোপ গ্রেগরি যখন গ্রেগরি বর্ষের প্রচলন করেন সেই ১৫৮২ সালে, তার উদ্দেশ্যটা ছিল প্রকৃতই একটি বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য। বাংলা নববর্ষ তার শুরুর উদ্দেশ্যটি ভালোই রক্ষা করে এসেছে। নববর্ষ মানে নতুন এক ফসল চক্রের শুরু এবং শাসকদের তরফ থেকে একটি নতুন হিসাব শুরুর সময়। ব্যবসায়ীরা হালখাতা শুরু করেছে নতুনভাবে। এখনো বাংলার গ্রামে নববর্ষের এই দ্বিবিধ প্রকাশটি মানুষ কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে। আগে এই চর্চাটি ছিল আরও পরিব্যাপ্ত, স্বাভাবিকভাবেই, এখন কতদিন সেটি থাকে সেটাই ভাবনার বিষয়।

কিন্তু শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে কোথাও যেন ছন্দপতন ঘটেছে। এখন খাজনার ব্যাপারটি সাংবৎসরিক : অর্থাৎ খাজনা দিতে হলে তার কোনো বিশেষ সময়-অসময় নেই। প্রান্তিক যেসব চাষির জমি বাঁধা পড়ে আছে মহাজনের কাছে তাদের কাছে নববর্ষই বা কি, পুরনো বর্ষই বা কি! বর্গা চাষির জন্যও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রামের চাষি এখন অনেক বেশি পরিমাণ ভূমিহীন। যাদের জমি আছে, তারা এক ফসলের পরিবর্তে প্রায়শই দুই, এমনকি তিনটি ফসল জন্মাচ্ছে- তবুও, কিছুসংখ্যক সফল চাষি ছাড়া, সচ্ছলতা তাদের আসছে না। যেটুকু আনন্দ অথবা তৃপ্তি গ্রামের কৃষকের, সেটি হেমন্তের শেষে, শীতের শুরুতে, যখন ফসল কাটা হয়। বৈশাখে প্রায়ই অনাবৃষ্টিতে ধুঁকে বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর ফেটে চৌচির হয়। পানির অভাবে বোরো ধান শুকিয়ে যায় ক্ষেতে। এ অবস্থায় নববর্ষ কি আনন্দ বয়ে আনবে সেসব কৃষকের জন্য?

ব্যবসায়ীরাও আজকাল খুব একটা আপ্লুত হন না নববর্ষ নিয়ে। ত্রিশ বছর আগেও নববর্ষে দোকানে দোকানে হালখাতার উৎসব হতে দেখেছি। বাতাসা, মিষ্টি বিতরণ করতে দেখেছি দোকানিদের। এখন হালখাতা রাখে এ রকম দোকানের সংখ্যাই বা কটি, জানতে ইচ্ছা করে। লাল সালুর মলাট দেওয়া খেরো খাতা, যাতে হিসাব লিখছে দোকানি- এখন এই বস্তু জাদুঘরের দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই তো মনে হচ্ছে। এখন দোকানিদের ভ্যাটের ভয় আছে; এখন ভাউচার রাখতে হয়, বিল জমাতে হয়, চেকের কাউন্টার ফয়েল সংরক্ষণ করতে হয়। পুরনো আমলের হালখাতা দেখলে এখন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্মগুলোর নবিসরাও হাসাহাসি করবে। এখন অডিট হতে পারে যখন তখন। নববর্ষের জন্য কি বসে থাকবে এসব ফার্ম অথবা আয়কর বিভাগের লোকজন, বা ভ্যাটের পেয়াদারা?

গ্রামের দিকে বিশেষ করে কার্তিকের মঙ্গা থেকে কোনো রকমে বেঁচে উঠতে উঠতে যেসব জনপদ অঘ্রাণের প্রত্যাশা পূরণ হতে না দেখে হতাশ হয়েছে এবং পুড়েছে ফাল্গুন-চৈত্রের দাবদাহে, যেসব জনপদে নববর্ষ এখন কি বাণী বা কি আনন্দ নিয়ে আসবে? এখন অনেক গ্রামে সম্পন্ন কৃষকের বাড়িতে অথবা গঞ্জের সফল দোকানির গদিতে নববর্ষের অনুষ্ঠান- যদি আদৌ হয়, খুব ফিকে হয়ে দেখা দেয়।

এখন শহুরে মানুষ বরং নববর্ষের সংস্কৃতিকে খুব ধরেছে। এখন নববর্ষের উৎসব হয় শহরে এবং গ্রামের মানুষ টেলিভিশনে তার প্রতিবেদন দেখে অবাক হয়।

 

দুই

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল একটা নস্টালজিয়া থেকে এবং একটা প্রতিবাদ হিসেবে। পাকিস্তান আমলে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা জেহাদ চলছিল। গলা টিপে ধরেছিল পাঞ্জাবিরা আমাদের সংস্কৃতির। বাঙালি প্রতিবাদে এবং প্রতিরোধে সিদ্ধহস্ত, যদিও এতে জয়ী হলে সে বিপদে পড়ে যায়, জয়টা ধরে রাখতে অপারগ হয় যেমন সমস্ত আশির দশকে সামরিক শাসনবিরোধী এবং গণতন্ত্র সমর্থক যে আন্দোলন হয়েছে, তাকে তীব্রতা এবং কমিটমেন্টের দিক থেকে এবং আন্দোলনকারীদের একতার দিক থেকে আদর্শই বলা যাবে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত যে কোনো জাতির জন্য একটা আদর্শ হয়ে দেখা দিতে পারে আমাদের আশির দশকের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু গণতন্ত্র যখন এলো, তখন দেখা গেল, একে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। নিজেরাই কুড়াল মারছি নিজেদের পায়ে, একে অপরের পায়ে। নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা পণ্ড করছি, আবার অপরের নাকও কাটছি একইসঙ্গে। যাহোক, পাঞ্জবির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হতেও খুব দীর্ঘ সময় লাগেনি আমাদের। কিন্তু ষাটের দশকে এই সংগ্রামের একটি অংশ ছিল আমাদের সংস্কৃতির সব দিকে একটা পুনর্জাগরণ সৃষ্টির আন্দোলন শুরু করা। নববর্ষের সংস্কৃতি এখন নতুন করেই প্রাসঙ্গিক হয়েছে আমাদের জীবনে। হঠাৎ করেই আমাদের মনে হয়েছে, প্রতি পহেলা বৈশাখে আমাদের জেগে উঠতে হবে। এবং উঠেছিও আমরা।

প্রথমে ছায়ানটের একটা সামান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষের পুনর্জাগরণ শুরু হয়। ঢাকার রমনা উদ্যানে একটি অশ্বথ গাছের নিচে সূর্যোদয়ের সময়ে যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো, সেটি রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গেল অচিরেই। শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মেজাজ দিয়েই। কিন্তু শীঘ্রই তাতে একটা নস্টালজিয়া যুক্ত হলো। হঠাৎ যেন বাঙালি মধ্যবিত্ত আবিষ্কার করল, আহা, গ্রামটা কোথায় কোন পেছনে ফেলে এসেছি। গ্রামটা এখন আর নেই আমাদের জন্য; শহর তার একশ' জটিল সুতোয় বেঁধে ফেলেছে আমাদের। কাজেই সেই গ্রামকে চাই, কেউ কেউ পহেলা বৈশাখের ভোরে রমনা মাঠে পান্তাভাত অথবা পাটিসাপটা খেয়ে নস্টালজিয়া নিরসন করলেন, কেউ কেউ আরও গভীরে গিয়ে গ্রামীণ-জীবনের প্রশান্তি, অথবা তার সংগীত ও শব্দ, দৃশ্য ও দ্রষ্টব্য নিজের চিত্তে ধারণ করতে শুরু করলেন।

শহর যখন সিদ্ধান্ত নিল নববর্ষকে বরণ করে নিতেই হবে, নানাবিধ কারণের জন্য, তখন গ্রামের কিছুই করার থাকল না। আর থাকবেই বা কি? একটি স্থানান্তরিত প্রায়-নিমর্ূল জনগোষ্ঠী যখন শিকড়ে ফিরে যেতে চায়, তখন কার কি করার থাকে?

কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, যখন গ্রাম ধরে নিল শহরের নববর্ষ সংস্কৃতিটি খুবই উত্তম এবং এখন একে অনুকরণ করা যায়। গত বছর কাগজে পড়েছিলাম, বাংলাদেশের অনেক ছোট শহরে এমনকি গ্রামেও ভোরবেলা নববর্ষের উৎসব হয়েছে। এবং এসব উৎসব রমনার অশ্বত্থমূলে মতান্তরে বটমূলে উপস্থাপিত অনুষ্ঠানের মতো। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের সময় একটা বটবৃক্ষের নিচে সম্মিলিত গান হবে, আবৃত্তি হবে ইত্যাদি। তারপর একটা মিছিল হবে যেখানে কাগজের মুখোশ পরে নৃত্য করে বেড়াবে অনেক তরুণ-তরুণী। তারপর একটা মেলা হবে, যেখানে মাটির পুতুল থেকে নিয়ে হাতের কাজ করা পাঞ্জাবি এবং বইপত্র সব পাওয়া যাবে।

গ্রামে আগেও গান-নাচের অনুষ্ঠান হতো, মেলা হতো। মিছিল হতো কি না জানি না, অনেক বইপত্র ঘেঁটেও এমন কোনো মিছিলের সংবাদ পাইনি, যাতে কাগজের নানান মুখোশ পরে মানুষজন নাচত আর গান গাইত। অর্থাৎ এখন গ্রাম দেশের নববর্ষ উৎসবের রূপ ও প্রকৃতি ঠিক করে দিচ্ছে শহর। আর মিডিয়া, বিশেষ করে দৃশ্য মাধ্যমের কল্যাণে অনেক আগেই শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামের আদর্শ।

টেলিভিশনে গ্রামের জীবন নিয়ে নাটক করলে শহরের নয়- গ্রামের দর্শকই সবচেয়ে বেশি মুখ ফিরিয়ে নেয়- সেসব নাটক থেকে এ তথ্যটি একটি ভিডিও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আমাদের জানিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানটি সফল, তার জরিপ-কাজটিও নিখুঁত। তিনি জানান, এখন যে নাটকে নায়ক ধনী, নায়িকা ধনী, তাদের গাড়ি আছে, বিশাল বাড়ি আছে এবং তাদের হাতে মোবাইল ফোন থাকে সব সময়, সে নাটকই গ্রামদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়। হতেও পারে, হওয়াটা স্বাভাবিক।

 

তিন

গ্রামে যে শহরের দিকে মুখ ফিরাচ্ছে সব কিছুর জন্য এটিই স্বাভাবিক, বলা যায় অনিবার্য। বাঙালির জীবন এখন মোটাদাগে, বস্তুভিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরে যারা থাকে, তাদের এক বড় অংশ অর্থবিত্তের অথবা নিদেনপক্ষে সচ্ছলতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ভোগ্যপণ্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা-চট্টগ্রামে এমনকি সিলেট বগুড়ায় এত বিপণিবিতান এখন, মনেই হয় না দেশটা আছে পৃথিবীর দরিদ্রতমের তালিকায়। পাঁচ হাজার টাকা বেতন যিনি পান, তিনি আরও পনেরো হাজারের জন্য ছোটেন। যিনি পনেরো পান তিনি ছোটেন পঁয়ত্রিশের পেছনে। খুব দূরে যেতে হয় না, ঘরের পাশে কলকাতায় পাঁচ ও পনেরো উপার্জনকারীরা ওই পাঁচ ও পনেরোর মধ্যেই জীবনযাপন করছেন। তারা ট্রামে বাসে যাতায়াত করছেন, পালা-পার্বণে কাপড়-চোপড় কিনছেন- এমনকি টাকা জমিয়ে বই কিনছেন। কিন্তু আমরা কোনোক্রমেই কোনো প্রাপ্তিতেই সন্তুষ্ট নই। তাই ঘুষ খাই দুর্নীতি করি। বাংলাদেশে যে এত দুর্নীতি- পৃথিবীর সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় উপরের দিকে- পাঁচ কি দু'নম্বর- আসনটি আমাদের- তার কারণ এই 'খাচ্ছি-খাব-আরও খাব' মনোবৃত্তিটি। এ জন্য রাস্তাঘাটে এত নতুন গাড়ি, রাস্তার পাশে এত নতুন বাড়ি। এ দেশে পুলিশের সার্জেন্ট বাড়ি বানায়, আয়কর দফতরের কেরানি পাজেরো চড়ে। সংস্কৃতিতে এই খাদক মনোবৃত্তির একটা প্রভাব অজান্তেই তাই পড়ে যায়। সংস্কৃতি- অর্থাৎ আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের শিল্পিত রূপ হয়ে ধরা দেওয়ার কথা যার। নববর্ষের সেসব অনুষ্ঠান হয় ঢাকায় অথবা চট্টগ্রামে তাতে চাকচিক্যটাই যেন প্রধান, যেন জাঁকজমকটাই গুরুত্বপূর্ণ। রমনার বটমূলে মানুষজন খুব ধোপদুরস্ত কাপড়চোপড় পরে যায়, ওই একদিন মূল্যবান রেশমি পাঞ্জাবি না পরলে নববর্ষের অনুষ্ঠান যেন ম্লান হয়ে যায়। বাংলা নবর্ষের মূল চিন্তাটি এই প্রদর্শন মনোবিৃত্তর বিপরীত।

গ্রামের সংস্কৃতিকে এখন আবার 'গ্রাম্য' ও 'গ্রামীণ' এই দুই বিশেষণে ভূষিত করা হচ্ছে। 'গ্রামীণ' ভালো জিনিস; যেমন বয়াতির গান; 'গ্রাম্য' অনুকরণযোগ্য নয়, যেমন বলী খেলা। গ্রামীণ জিনিসের ওপর আমার শহর তার মেকআপ লাগিয়ে দিচ্ছে। গ্রামের মেলার কেনাবেচার দিকটা ছাড়াও সবার সঙ্গে সবার মেলামেশার একটা ব্যাপার আছে; ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে বন্ধনের একটা ব্যাপার আছে। শহুরে মেলার ব্যবসাটাই বড়। সেই ব্যবসা আবার সফল হয় শহরের মানুষের নস্টালজিয়াকে পুঁজি করে। শহরের মেলা ঝকমক করে, জিনিসপত্র চকচকে বলে, মানুষ সব সেজেগুঁজে আসে বলে। গ্রামের মেলা চকচক করে মানুষের আনন্দিত অংশগ্রহণে, তাদের হাসিতে, শিশুদের কলকাকলিতে।

যত দিন যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে, নববর্ষের অনুষ্ঠানগুলোকে আমরা খুব চকচকে করে ফেলেছি। 'গ্রামীণ' করে তোলার জন্য তার ভিতরে আনন্দ আর তৃপ্তিটাকে এড়িয়ে গিয়ে বাহ্যিক একটা জৌলুস আনার চেষ্টা করছি- এতে কৃত্রিমতাই বাড়ছে। আর বড় সর্বনাশের বিষয় যেটি, এই 'গ্রামীণ' ও কৃত্রিম নববর্ষকে গ্রামের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি আমরা। এক সময় হয়তো দেখা যাবে, বাংলার সব গ্রামে ঢাকার অনুকরণে নববর্ষ হচ্ছে এবং সেগুলোতে অংশ নিতে ঢাকার 'টিভি-আর্টিস্ট'রা গ্রামে যাচ্ছেন। হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে, পাজেরোতে চড়ে। শুভ নববর্ষ।

 

 

 

সর্বশেষ খবর