২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১১:৩৫

‘এই স্কুল না থাকলি মেয়িডার লেখাপড়া হইতু না’

অনলাইন ডেস্ক

‘এই স্কুল না থাকলি মেয়িডার লেখাপড়া হইতু না’

কুষ্টিয়ায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের উদ্বোধন করেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন

কুষ্টিয়ার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের রাতুলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রিপন কুমার দাস। ছোটবেলায় আগুন লেগে শরীরের বেশির ভাগ পুড়ে যায় তাঁর। ভিটামাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় তাঁর পরিবার। তবু স্বাভাবিক হয়নি রিপনের জীবন।

একটি পা বেশি পুড়ে যাওয়ায় খুঁড়িয়ে হাটেন তিনি। সেভাবেই হেঁটে ছোট মেয়ে শুভশ্রীর হাত ধরে  এসেছেন বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে। অভাবের সংসারে নিজে পড়ালেখা করার সুযোগ না পেলেও সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন তাঁর। স্কুলের পাঠ শেষে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
বাবা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী। বৃদ্ধ মা-বাবাকে গ্রামে রেখে জীবিকার তাগিদে কুষ্টিয়া শহরে চলে এসেছেন রিপন। থাকছেন থানাপাড়ায় হরিপুর ব্রিজের নিচে একটি ভাড়া বাড়িতে। শরবত বিক্রি করে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কোনো রকমে চলে সংসার।

বড় ছেলেটিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেও অর্থাভাবে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর সাহস করেননি। এ সময় খোঁজ পান বসুন্ধরা শুভসংঘের বিনা মূল্যের স্কুলের। মেয়েকে ভর্তি করেন সেই স্কুলে। মেয়েকে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে ভর্তি করানোর কারণ জানতে চাইলে রিপন বলেন, ‘একুন বৃষ্টির দিনি সেরোম শরবত বেচতি পারিনি। ছেলিডারে স্কুলি ভর্তি করিছি।
উর বই-খাতা ম্যালা কিছু কিনি দিতি হয়। মেয়িডারে আর স্কুলি দিতি পারিনি। এই স্কুলিত্তে বই-ব্যাগ ফিরি ফিরি দিছে। স্যাররা কইছে সব খরচা তারাই দিবি। এই জন্যি মেয়িডারে একেনে ভর্তি করিছি। এই স্কুল না থাকলি মেয়িডার একুন লেখাপড়া হইতু না।’
রিপনের মতোই আরো ২০ থেকে ২৫ জন অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের নিয়ে এসেছেন স্কুলে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বসুন্ধরা শুভসংঘের বন্ধুরা। 

গত ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের উদ্বোধন করা হয়। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে শহরের ছয় রাস্তা মোড়ে বসুন্ধরা শুভসংঘের জেলা কার্যালয়ে স্কুলের উদ্বোধন করেন দুই বাংলার নন্দিত কথাসাহিত্যিক, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ও কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। 

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক লেখক নাজমুল হুদা, কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নাদিরা খানম, বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান, কালের কণ্ঠ’র কুষ্টিয়ার নিজস্ব প্রতিবেদক তারিকুল হক তারিক, নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি হাসান জাহিদ, বসুন্ধরা শুভসংঘ কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি মর্জিনা খাতুন, নির্বাহী সভাপতি এস এম জামাল, সাধারণ সম্পাদক কাকলী আক্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল হোসেনসহ জেলা শুভসংঘের অন্যান্য সদস্য।

ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশের, একটি আলোকিত বাংলাদেশের। শিক্ষিত জাতিই পারে আমাদের আলোকিত বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে। বসুন্ধরা শুভসংঘ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সারা দেশে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের স্বপ্নপূরণের সারথি হয়েছেন বসুন্ধরা গ্রুপের মাননীয় চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। তাঁর সহযোগিতায় আমরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় আমরা বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল প্রতিষ্ঠা করব। জায়গা কিনে আলাদা ভবন করব। সেখানে স্কুল, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, পাঠাগার থাকবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখানে আমরা শিশুদের স্কুলড্রেস, ব্যাগ, বই সব দেব। শিক্ষকের বেতনসহ স্কুলের যা যা খরচ সবই বহন করা হবে। এখানেই শুধু তাদের পড়ানো নয়, বরং যখন তারা হাই স্কুলে যাবে, তখন তাদের মাসিক বৃত্তি দেওয়া হবে। এরপর যত দূর সে পড়তে চায়, তত দূর বৃত্তি দেওয়া হবে; যেন অভাবে পড়ে কোনো শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই কারণে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যত কষ্টই হোক, আপনাদের সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে পাঠাবেন। এই শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। এরা বড় হয়ে দেশকে বদলে দেবে। আপনাদের পরিবারের অবস্থাটাও বদলাবে। আমরা বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে আপনাদের পাশে আছি। সব সময় সুখে-দুঃখে আমাদের পাবেন আপনারা। একটাই অনুরোধ, সন্তানদের ঠিতমতো স্কুলে পাঠাবেন। তাদের পড়ালেখা করানোর সব দায়িত্ব আমাদের। সবাই বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মহোদয় ও তাঁর পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।’

শুভসংঘ স্কুলের শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা অনেক দুষ্টুমি করবে, কিন্তু কখনোই রাগ করা যাবে না। তাদের দুষ্টুমির মাঝেই ভালোবাসা দিয়ে শেখাতে হবে। শুরুতেই তারা বইয়ের পড়া শিখবে বিষয়টা এমন নয়। তাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করাটাও একটা বড় শিক্ষা। এখানে এসে বাচ্চারা সুন্দর করে বসতে শিখবে, শৃঙ্খলার সঙ্গে পড়াশোনা করবে—প্রথমে এই শিক্ষাগুলো দিতে হবে। তাদের মাঝে স্কুল ও ক্লাসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।’

শিক্ষক ঈশিতা পারভীন বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে বাচ্চাদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে পড়াচ্ছি। ওরা অনেক দুষ্টুমি করলেও আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে যত্নসহকারে পড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা যেভাবে পড়াই, তাতে বাইরে অন্য কারো কাছে আর পড়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ এখানে যারা পড়ে সবাই খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বই ও ব্যাগ পেয়ে শিক্ষার্থীরাও স্কুলে আসার ক্ষেত্রে খুবই আগ্রহী।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর