৩ এপ্রিল, ২০২৪ ০১:৩৯
মেয়াদ শেষ জুনে

ইভিএমের ভবিষ্যৎ অন্ধকার

প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা

গোলাম রাব্বানী

ইভিএমের ভবিষ্যৎ অন্ধকার

প্রতীকী ছবি

হোঁচট খাচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ ব্যবস্থা। প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ালে জুনের পরেই নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা ইভিএম ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের আগেই ইভিএমের নতুন প্রকল্প নাকচ করে দিয়েছে সরকার। আগামীতে চলমান প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়লে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ভবিষ্যৎ অন্ধকার। 

অর্থ সংকটের কারণে নতুন করে ইভিএম না কেনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার হয়নি এ মেশিন। তবে ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় সরকার ও সংসদ নির্বাচনের উপনির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। ইসির হাতে থাকা ইভিএমগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন সরকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। 

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুনে। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষের পর আর্থিক জোগান না থাকলে ইভিএমগুলো ডিসপোজালের ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন আমরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে চিঠি দেব। সরকারের ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত পেতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এ চিঠি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

অকেজো ইভিএমের জন্য প্রতি বছর ভাড়া গুনতে হবে। সে ক্ষেত্রে শুধু টাকা খরচই হবে, ইভিএমে কোনো কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে ইভিএমগুলোর নিষ্পত্তি করার কোনো বিকল্প নেই। দেড় লাখের মধ্যে ৭০ হাজার ইভিএম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) সংরক্ষিত রয়েছে। বাকি ৮০ হাজার মেশিন মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার হয়েছে। সংসদের উপ-নির্বাচন, স্থানীয় সরকারের সাধারণ ও উপনির্বাচন মিলে প্রায় ১ হাজার ৪০০টি নির্বাচন হয়েছে ইভিএমে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কেনা দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম নষ্ট হয়ে গেছে। এসব অকেজো ইভিএম ধ্বংস করার তথা পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন (ইসি)। 

ইভিএম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয়নি বলেই ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এসব ইভিএম ধ্বংস না করা হলে বার্ষিক ২৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। ইসি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ৪১ জেলায় মাসিক ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৯ টাকা হারে ২৯ হাজার ৯০২টি ইভিএম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বিএমটিএফ-এর ওয়্যারহাউজে ১ লাখ ২৭ হাজার ৬২টি ইভিএম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইভিএম সংরক্ষণে বার্ষিক ভাড়া গুনতে হবে প্রায় ২৪ কোটি ২৪ লাখ। 

নির্বাচন কমিশন বিগত সময়ে সংসদ, স্থানীয় ও উপনির্বাচন মিলে প্রায় ১৪০০ নির্বাচন করেছে ইভিএমে দিয়ে। আর ভোট দিয়েছে প্রায় আড়াই কোটি ভোটার। এদিকে ইভিএম সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) ওয়্যারহাউস ব্যবহার করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু প্রকল্পের ডিপিপিতে ইভিএম সংরক্ষণের বিষয়টি না থাকায় এখন ওয়্যারহাউসের ভাড়া পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় পড়েছে সংস্থাটি। 

জানা গেছে, বিএমটিএফের ওয়্যারহাউসে ইভিএম রাখার ভাড়া বাবদ প্রায় ৫২ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে ইসির। এ ছাড়া ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৬০ কোটি এবং র‍্যাকের বকেয়া বাবদ ৩১ কোটিসহ মোট প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু জটিলতার কারণে এই অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না ইসি।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতিটি ইভিএম সংরক্ষণে সম্ভাব্য বার্ষিক ব্যয় হচ্ছে ১৩৪৪ টাকা। সেই হিসেবে মাঠপর্যায়ে ৪১ জেলায় মাসিক ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৯ টাকা হারে ২৯ হাজার ৯০২টি ইভিএম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যার বার্ষিক ভাড়া ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। 

ইসি বলছে, ৬৪ জেলায় র‌্যাকসহ ইভিএম সংরক্ষণের জন্য দ্বিগুণ জায়গা প্রয়োজন হবে। সে অনুযায়ী ইভিএম ও র‌্যাক সংরক্ষণের জন্য সম্ভাব্য বার্ষিক ব্যয় হবে ১২ কোটি ৫৪ লাখ ৫৮ হাজার ১৯৪ টাকা। এ ছাড়া বিএমটিএফ-এর ওয়্যারহাউসে ১ লাখ ২৭ হাজার ৬২টি ইভিএম রাখার জন্য মাসিক ভাড়া ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা হিসেবে বার্ষিক ব্যয় হবে প্রায় ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে ইভিএম প্রতি ব্যয় হবে ১১৪২ টাকা। 

নির্বাচন কমিশন বলছে, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ দেড় লাখ ইভিএম সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬৪ জেলায় র‌্যাকসহ ইভিএম সংরক্ষণ ও বিএমটিএফ এ ইভিএম সংরক্ষণের জন্য বার্ষিক ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ২৪ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ১৯৪ টাকা। 

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি কাজী রকিব কমিশন। পরবর্তীতে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্পমূলের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলে উন্নতমানের ইভিএম তৈরির সিদ্ধান্ত রেখে যায়। 

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেওয়া হয়। এতে মেশিন প্রতি ব্যয় হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। হাতে নেওয়া হয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প। সেই নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেড় শ আসনে ইভিএমে ভোট করতে চেয়েছিল ইসি। বরাদ্দ চেয়েছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু টাকাও পায়নি, ইভিএমে ভোটও হয়নি। 

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এসে প্রায় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। তখন বলা হয়েছিল, প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়েছে পড়ে। অবশিষ্ট ১ লাখ ১০ হাজার মেশিনের মধ্যে অধিকাংশগুলোতে ধরা পড়ে নানা ধরনের ত্রুটি। কিন্তু মেরামতের জন্য নেই নতুন কোনো প্রকল্পের অর্থের জোগান। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। সেই শঙ্কাই এখন সত্য হতে চলেছে। কেননা অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য সাড়ে ১২০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলে সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। বর্তমানে নষ্ট ইভিএমগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছে ইসি। 

এদিকে জুনে শেষ হচ্ছে ইভিএম প্রকল্প। তাই নষ্ট ইভিএমগুলো আর টেনে নিতে চায়না নির্বাচন কমিশনও। গত ৬ ফেব্রুয়ারির ইসির ২৭তম বৈঠকে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, প্রকল্প খাতে সংস্থাপন না থাকায় ইভিএমের ওয়্যারহাউসের ভাড়া পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগের কাছে বরাদ্দ চাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যয়বহুল ও ইভিএমের মেয়াদ ইতোমধ্যে উত্তীর্ণ হওয়ায় একটি কারিগরি কমিটি গঠনপূর্বক অচল ইভিএম শনাক্ত করে তা বিনষ্ট করা যেতে পারে।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর