৩০ মে, ২০২৪ ১৪:৫৬

এমপি আনার হত্যার যৌথ তদন্ত সফল : হারুন অর রশিদ

দীপক দেবনাথ, কলকাতা :

এমপি আনার হত্যার যৌথ তদন্ত সফল : হারুন অর রশিদ

‌‌‘ওয়াটার থিওরি’ অনুসরণ করেই কলকাতায় খুন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে সফলতা এসেছে। আলোচিত এই খুনের মামলা নিয়ে কলকাতায় তদন্ত করতে গিয়ে এই থিওরিই সফলতা দিয়েছে বলে মনে করেন ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ। এমপি আনার হত্যার যৌথ তদন্ত সফল হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আনার হত্যার ঘটনায় ডিবির ভারত সফর শতভাগ সফল হয়েছে। বৃহস্পতিবার কলকাতা ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের একথা বলেন ডিবি প্রধান।

কলকাতায় খুন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে ইতোমধ্যেই এক নারীরসহ তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা। তাদের এক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ‌‌‘ওয়াটার থিওরি’তে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অর্থ তিনি উপর থেকে পানির শব্দ শুনেছিলেন। এরপর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডিকে অনুরোধ করে কমোড, সেপটিক ট্যাংক ও সুয়ারেজ লাইন পরীক্ষা করা হয়। এরপরেই সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েক কেজি মাংস। 

ডিবি প্রধান হারুন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া এই মাংস এমপি আনারের মনে করা হলেও এ ব্যাপারে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হতে ফরেনসিক এবং ডিএনএ টেস্ট জরুরি।’ আনুষ্ঠানিকভাবে সিআইডিকে চিঠি দিয়ে এখানকার লাশের টুকরো নিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও এদিন জানান ডিবি প্রধান। 

উদ্ধারকৃত এই মাংস এমপি আনারের লাশের টুকরো কিনা, তা পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই সেই নমুনা পাঠানো হয়েছে সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে (CFSL)। প্রয়োজনে করা হবে ডিএনএ টেস্টও। সেক্ষেত্রে কলকাতায় ডাকা হয়েছে এমপি আনারের কন্যা মুমতারিন ফিরদৌস ডরিনকে। ডিবি প্রধান বলেন, ‘আমরা সিআইডিকে অনুরোধ জানিয়েছি এই পরীক্ষাগুলো যেন খুব দ্রুততার সাথে করা হয়।’

ডিএনএ টেস্ট করার জন্য এমপি আনারের কন্যা ডরিনা খুব শিগগিরই কলকাতা আসবেন। ভারতে আসার জন্য সম্ভবত তিনি ভিসাও পেয়ে গেছেন। গত বৃহস্পতিবার কলকাতায় পৌঁছান গোয়েন্দা প্রদানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল। কলকাতা থেকে তারা যান নিউটাউন থানায়। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও)-কে সাথে নিয়ে তারা কৃষ্ণমাটি বাগজোলা খাল পরিদর্শন করেন। এরপর যথাক্রমে নিউটাউনের সঞ্জীবা আবাসন, সিআইডি ভবন, হাতিশাল খালসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করার পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল, সিআইডি এডিজি আর রাজাশেখরণের সাথেও কথা বলেন গোয়েন্দা প্রধান। 

একথা জানিয়ে হারুন অর রশিদ জানান, ‘এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে কলকাতায় এবং বাংলাদেশে দুটি জায়গায় মামলা হয়েছে এবং সেই কারণেই তদন্ত করতে আমরা কলকাতায় এসেছি এবং সিআইডির প্রতিনিধি দলও তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশে গেছে। আমরা ইতিমধ্যে মূল ঘাতককে গ্রেফতার করেছি। তারা অনেক কিছুই স্বীকার করেছে। কিভাবে তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল, বাংলাদেশের কোথায় কোথায় তারা বৈঠক করেছে, কলকাতায় এসে কোন কোন বাসায় ছিল, তারা কি কি কাজ করেছিল, এগুলো যাচাই-বাছাই করার দরকার ছিল।’

গোয়েন্দা প্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশের পিনাল কোডের ৩৬২, ৩৬৪ ধারা অনুযায়ী। লাশ বা লাশের টুকরো, খুনির ঘড়ি বা অন্য কোন অংশ বিশেষ উদ্ধার না হলে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হয়। আর সেই কারণে আমরা এসেছি আমাদের মূল কাজটি ছিল বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালানো, কলকাতায় যে আসামি গ্রেফতার হয়েছে তাকে নিয়েই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা, পাশাপাশি যে জায়গাগুলোতে তারা গিয়েছিল সেই সমস্ত জায়গায় অভিযান চালানো। এমপি আনারের লাশ বা লাশের টুকরো যাতে পাওয়া যায় সেই কারণেই আমাদের এই তদন্ত। কারণ একটা মামলার নিষ্পত্তি করতে গেলে সুরতহাল, মেডিকেল রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্ট ও আলামতের দরকার হয়।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য কলকাতা পুলিশকে শেয়ার করা এবং উনাদের কাজে সহযোগিতা করা। আমরা মনে করি, তাদের সহযোগিতা করতে পেরেছি। আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল আলামত সংগ্রহ করা, সিআইডিকে সহযোগিতা করা, ডিজিটাল এভিডেন্স নিজে চোখে দেখা, কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া জিহাদ হাওলাদার সাথে কথা বলে আমাদের দেশে গ্রেফতার হওয়া আসামিদের বয়ান মিলিয়ে নেওয়া, আসামিরা কোথায় কোথায় গেছে সেগুলো খোঁজখবর নেওয়া- সেক্ষেত্রে আমরা ১০০ ভাগ সফল।’
 
ডিবি প্রধান জানান, ‘কলকাতা পুলিশের সাথে যে হৃদ্যতা, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে কোন অপরাধী বাংলাদেশ থেকে অপরাধ করে কলকাতাকে স্বর্গীয় আশ্রয় বলে মনে করলে- সেটা আর সম্ভব হবে না। এর ফলে আরো দ্রুততার সহিত কলকাতা থেকে গ্রেফতার করতে পারব।’ 

গত ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনে শেষবার দেখা গিয়েছিল এমপি আনারকে। মনে করা হচ্ছে ওই দিনই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আসামিদের মধ্যে অন্যতম হলো এমপি আনারের বাল্যবন্ধু শাহীন। ইতোমধ্যেই তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে শাহীন নেপাল হয়ে দুবাই, তারপরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। অন্যদিকে আরেক অভিযুক্ত সিয়াম বর্তমানে নেপালে অবস্থান করছে। তাদের উভয়কে ফিরে পেতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ডিবি হারুন।

তিনি বলেন, ‘একজন আসামি কাঠমান্ডুতে রয়েছে, আরেকজন আমেরিকাতে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশ কমিশনার, সিআইডি প্রধানের সাথে কথা হয়েছে। কাঠমান্ডুতে সিয়ামের অবস্থানের বিষয়টি সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। নেপালের কর্তৃপক্ষকেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।’

হারুন বলেন, ‘আমাদের ধারণা এই কাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান করছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সিআইডি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। যেহেতু ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যার্পণ চুক্তি রয়েছে, তাই শাহিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনতে যেন তারা কথা বলেন। পাশাপাশি আমরাও বাংলাদেশের পুলিশের আইজির সাথে কথা বলেছি। তাকে ফেরত পেতে ইন্টারপোলকে একটি চিঠি দিয়ে অবহিত করা হবে। আবার বাংলাদেশে যে আমেরিকান দূতাবাস আছে সেখানেও চিঠি দিয়ে অবগত করার পাশাপাশি সরাসরি গিয়ে কথা বলে আখতারুজ্জামান শাহীনের বিষয়টি জানানো হবে।’

অন্যদিকে কাঠমান্ডুতে সিয়ামের অবস্থানের বিষয়ে আমরা জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যে একটি চিঠি নেপালে পাঠিয়েছি। নেপালের সমস্ত সংস্থাকে আমরা অবগত করেছি যে সিয়াম বর্তমানে নেপালে অবস্থান করছে। আমরা মনে করছি খুব শিগগিরই একটা ভালো খবর আসবে বলেও ডিবি প্রধান জানান।

উল্লেখ্য, গত ১২ মে ভারতে এসে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার কাছে বরানগরে দীর্ঘদিনের পরিচিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন এমপি আনার। আর পরদিন ১৩ তারিখ চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। সেই ঘটনায় ইতিমধ্যেই গোপাল বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে নিউ টাউন থানার পুলিশ ও সিআইডির কর্মকর্তারা। আপাতত পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে এই গোপাল বিশ্বাস। সেই গোপাল বিশ্বাসের সাথেও কথা বলেছেন ডিবির গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল। 

বিডি-প্রতিদিন/শআ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর