শিরোনাম
২ জুন, ২০২৪ ০৮:৩৯

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ইটভাটা দখলে নেন বেনজীরের শ্যালক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ইটভাটা দখলে নেন বেনজীরের শ্যালক

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দক্ষিণ আলীপুর গ্রামে ৪৮ বিঘা জমির ওপর একটি আধুনিক ইটভাটা স্থাপন করে জীবনের নতুন স্বপ্ন বুনেছিলেন আনারুল ইসলামের ছেলে আশরাফুজ্জামান হাবলু। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ইটভাটাটি যাত্রা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই দখল করে নেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের শ্যালক মির্জা আনোয়ার পারভেজ। ভগ্নিপতির ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাবলুর কাছ থেকে ইটভাটাটি দখল করেন পারভেজ।

আইজিপি হওয়ার আগে টানা প্রায় পাঁচ বছর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক ছিলেন বেনজীর আহমেদ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাঁর ক্ষমতার দাপট ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরায়ও। সীমান্তবর্তী এই জেলায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি। ভগ্নিপতির ক্ষমতার দাপটে সাতক্ষীরায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তাঁর শ্যালক আনোয়ার পারভেজ। ২০১৮ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় হাবলুর ইটভাটাটি দখল করেন তিনি।

এ জন্য চারবার তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় বেনজীর র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাবলুর ইটভাটার নাম ‘নিউ আলীপুর ব্রিকস’। এলাকার ৪০ জন জমির মালিকের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৪৮ বিঘা জমি লিজ বা ভাড়া নেন তিনি।

বিঘাপ্রতি ২৫ হাজার টাকায় ১০ বছরের চুক্তি করেন। ২০১৮ সালের ২২ জুলাই হাবলুর নামে ইটভাটাটি ইস্যু করে আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদ। একই বছরের ১৪ জুন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও ছাড়পত্র পান তিনি।

আশরাফুজ্জামান হাবলু বলেন, “২০১৭ সালে ইটভাটার কাজ শুরু হয়। শুরুর দিকে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত সেখানে বিনিয়োগের অঙ্ক দাঁড়ায় পাঁচ কোটি টাকায়। এক পর্যায়ে আমার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখান মির্জা আনোয়ার পারভেজ। এলাকার ‘বড় ভাই’ হিসেবে না করতে পারিনি। তৎকালীন র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদের শ্যালক পরিচয়ে এলাকায় বেশ প্রভাব বিস্তার করেন পারভেজ। ফলে সব কিছু বিবেচনায় কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই পারভেজকে ইটভাটার অংশীদার করে নেওয়া হয়।”

তিনি আরো বলেন, ‘ইটভাটার নির্মাণকাজ শেষ হলে বদলে যেতে থাকে পারভেজের চরিত্র। প্রশাসনকে দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে থাকেন।’ ‘চারবার ডিবি ও পুলিশ দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যান,’ এ কথা বলে হাউমাউ করে ডুকরে ওঠেন আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘মুখে কালো কাপড় বেঁধে ইটভাটা লিখে দেওয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকেন। দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে জীবন বাঁচাই। সেই সঙ্গে থানায় বসে আনোয়ার পারভেজকে ইটভাটা লিখে দিয়ে চলে আসি। অতীতের রাজনৈতিক পেন্ডিং মামলায় আমাকে আসামি করে। ভগ্নিপতি বেনজীর আহমেদের ক্ষমতার দাপটে এসব করেন তিনি।’

হাবলুর ইটভাটা দখলে নেওয়া প্রসঙ্গে আলীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মশিউর রহমান ময়ূর বলেন, ‘আইজিপি বেনজীর সাহেব যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন হাবলুর ইটভাটাটি জোর করেই দখলে নেন মির্জা আনোয়ার পারভেজ। সেই ইটভাটা এখনো ফেরত পাননি হাবলু।’

সদর উপজেলার আলীপুরের গোলার আটি গ্রামে সরেজমিনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে, পুলিশে চাকরি দেওয়ার কথা বলেও বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চাকরি না দিয়ে নয়ছয় করতে থাকেন। চাকরিপ্রার্থীরা টাকা ফেরত চাইলে পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে করা হতো নির্যাতন। দেওয়া হতো মিথ্যা মামলা। এই হয়রানি থেকে বাদ যাননি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাও।

আলীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মন্টু বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের স্ত্রীর বড় ভাই মির্জা আনোয়ার পারভেজের হয়ে প্রশান্ত কান্তি দাস নামের এক যুবক এলাকার অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেন। এর মধ্যে আমার এক আত্মীয়ও ভুক্তভোগী।’

তিনি আরো বলেন, ‘বেনজীরের মাধ্যমে তাদের পুলিশে চাকরি দেবেন বলে টাকা নিলেও কারোরই চাকরি হয়নি। টাকা ফেরত চাইলে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। এসব বিষয়ে আমি প্রতিবাদ করলে আনোয়ার পারভেজ আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। এরপর বেনজীরের ক্ষমতায় মিথ্যা মামলায় আমাকে দুইবার জেল খাটান। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মামলা দেন প্রথমবার। তখন পুলিশ ধরে নিয়ে জেলে দেয়। এরপর ২০১৯ সালের শেষ দিকে আবারও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। ভিত্তিহীন বিভিন্ন মামলায় দেড় মাস জেল খাটতে হয় আমাকে। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ী হাবলুর কোটি টাকার ইটাভাটা জোর করে দখল করেন সাবেক আইজিপির শ্যালক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বলেন, মীর্জা পরিবারের অত্যাচারে এলাকার সবাই অতিষ্ঠ। এই পরিবারের জামাই বেনজীর আহমেদের ক্ষমতার দাপটে এলাকার সব মানুষকে তটস্থ থাকতে হয়। বাদ যায়নি প্রতিবেশীরাও। তিনি জানান, বেনজীরের শ্যালক পারভেজ জোর করে প্রতিবেশী নজরুলের জমিতে সীমানাপ্রাচীর দেন। প্রতিবাদ করলে পুলিশ এসে নজরুলকে ধরে নিয়ে যায়। বিনা বিচারে দেড় মাস জেলও খাটতে হয় তাঁকে।

সাতক্ষীরায় বেনজীরের শাশুড়ির নামে শত বিঘার মাছের ঘের

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ১ নম্বর শোভনালী ইউনিয়নের শরাফপুর গ্রামে বেনজীর আহমেদের নানাশ্বশুরের বাড়ি। ওই গ্রামে রয়েছে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার শাশুড়ি লুত্ফুন নেসার নামে শতাধিক বিঘার ওপর চারটি মাছের ঘের। এ ছাড়া আরকুনি মৌজায় দুটি, পশ্চিম বিল আর পাশের পুঁটিমারি বিলেও আরো কয়েকটি মাছের ঘের রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, এই মাছের ঘেরগুলোর জমির পরিমাণ শত বিঘার বেশি।

সরেজমিনে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদের শাশুড়ির সম্পদ দেখাশোনা করতেন বশির আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। এই বশির আহমেদ গত ১৫ বছরে বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রভাব খাটিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। এলাকাবাসীর ধারণা, বশিরের সব সম্পদে বেনজীরের শাশুড়ি লুত্ফুন নেসার অংশীদারি রয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হয় বশির আহমেদের বাল্যবন্ধু শরাফপুর গ্রামের শিক্ষক নিত্যানন্দের সঙ্গে। তিনি বলেন, একসময় এলাকায় বশির ছোট আকারে মাছের ঘেরের ব্যবসা করতেন। তবে গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ মাছের ঘেরের মালিক বনে যান তিনি। জনশ্রুতি রয়েছে, এসব মাছের ঘেরে বেনজীর আহমেদের শাশুড়ি লুত্ফুন নেসা মুনসুরের অংশীদারি রয়েছে।

শরাফপুর গ্রামের কার্ত্তিক চন্দ্র দাস বলেন, ‘বেনজীরের শাশুড়ির নামে শরাফপুর পূর্ব বিলে ১০ বিঘা জমিতে মাছের ঘের আছে, যা অন্যরা দেখাশোনা করে। এ ছাড়া আশপাশে আরো জমি কেনা আছে। তার পরিমাণ কত, তা বলতে পরব না।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য (৩ নম্বর ওয়ার্ড) আলমগীর হোসেন সরদার বলেন, বেনজীরের আহমেদের শাশুড়ির চার বিঘা জমিতে মাছের ঘের আছে। এ ছাড়া তাঁর ছোট ছোট কয়েকটি মাছের ঘের কেনা আছে। এই ঘেরগুলো গ্রামবাসীর কাছে বর্গা দেওয়া রয়েছে।

এদিকে লুত্ফুন নেসার কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়েছেন স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি রেজাউল ইসলাম। বেনজীরের শাশুড়ির কাছ থেকে তিনি সাত বিঘা জমি বর্গা নিয়ে মাছের ঘের করেছেন বলে স্বীকার করেন।

শরাফপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সানজিত দাস বলেন, পশ্চিম বিল এবং পাশের পুঁটিমারি বিলে বেনজীরের শাশুড়ির নামে আরো মাছের ঘের আছে, যা স্থানীয় লোকজনের কাছে বর্গা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা পুলিশের স্বজন। আমরা যতটুকু শুনেছি, তাদের নামে-বেনামেও বিপুল সম্পদ আছে। এসব জমিতে মাছের ঘের করে রাখা হয়েছে।’

৩০ বছর ধরে বেনজীরের নানাশ্বশুরের বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করছেন আবুল বাশার শিমুল। তিনি বলেন, ‘সারা জীবন শুনে আসছি কপ্পুর বেগমের (বেনজীর আহমেদের শাশুড়ির ডাকনাম) ২০ বিঘা সম্পত্তি আছে। তবে নতুন কী পরিমাণ জমি হয়েছে তা আমার জানা নাই।’

শোভনালী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘বেনজীরের শাশুড়ি, স্ত্রী ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে কিছু বলে আমরা বিপদে পড়তে চাই না।’


সূত্র: কালের কণ্ঠ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর