২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০১:৩২
ছিল না জনপ্রতিনিধি হওয়ার আইনি যোগ্যতা

মিথ্যায় ভর করে মন্ত্রী-এমপি

দ্বৈত নাগরিকত্ব ২৫ জনের, লুকিয়েছেন তথ্য, অনুসন্ধানে দুদক

মাহবুব মমতাজী

মিথ্যায় ভর করে মন্ত্রী-এমপি

প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের অন্তত ২৫ জন এমপি-মন্ত্রীর দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তারা তথ্য গোপন কিংবা মিথ্যায় ভর করে জনপ্রতিনিধি হন। এদের প্রত্যেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ এবং বাড়ি কিনেছেন। ওই ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জনই আওয়ামী লীগ আমলে কোনো না কোনো সময়ে মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। 

সাধারণদের প্রশ্ন, দ্বৈত নাগরিক হয়েও কীভাবে দেশের জনপ্রতিনিধি কিংবা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন তারা? তবে এই উত্তর সংবিধানেই দেওয়া আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের সদস্যতা লাভের জন্য বাংলাদেশের নাগরিক হওয়াসহ বয়সসীমা অবশ্যই ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে। আর কোনো ব্যক্তি যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব লাভ করেন, তাহলেও তিনি সংসদ     সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না। দ্বৈত নাগরিক ওই মন্ত্রী-এমপিদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সূত্র জানায়, যাদের নামে দ্বৈত নাগরিকত্বের তথ্য পাওয়া যায় তাদের মধ্যে আছেন- যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেওয়া মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি আবদুস সোবহান গোলাপ, ঢাকা-৩ আসনের সাবেক এমপি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, নাটোর-৩ আসনের সাবেক এমপি ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, দিনাজপুর-৫ আসনের সাবেক এমপি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, মৌলভীবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি ও কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা, ঢাকা-১৭ আসনের সাবেক এমপি ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নেওয়া কুমিল্লা-১০ আসনের সাবেক এমপি ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সাবেক এমপি ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, দিনাজপুর-২ আসনের সাবেক এমপি ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কুমিল্লা-৯ আসনের সাবেক এমপি ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি ও বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, নাটোর-২ আসনের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল, ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রহমান, ঢাকা-১৮ আসনের সাবেক এমপি হাবিব হাসান, বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব নেওয়া চট্টগ্রাম-৭ আসনের সাবেক এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নেওয়া ঢাকা-১ আসনের সাবেক এমপি সালমান এফ রহমান, সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব নেওয়া ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়া টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক এমপি তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির, ভারতের নাগরিকত্ব নেওয়া ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক এমপি ও পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, জাপানের নাগরিকত্ব নেওয়া রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক এমপি ও রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব নেওয়া নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি ও হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু এবং একই দেশে নাগরিকত্ব নেওয়া ঢাকা-৫ আসনের সাবেক স্বতন্ত্র এমপি মশিউর রহমান মোল্লা সজল, পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নেওয়া ময়মনসিংহ-১১ আসনের সাবেক এমপি এম এ ওয়াহেদ।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দ্বৈত নাগরিক হয়ে এমপি-মন্ত্রী হলে দুই ধরনের অপরাধ। এটির জন্য জনগণের সঙ্গে প্রতারণার দায়ে শাস্তি হতে পারে। আবার তথ্য গোপন করারও অভিযোগে শাস্তি হতে পারে। এমন অপরাধে কেউ নির্বাচিত হলেও তা বাতিল হতে পারে। 

সূত্র জানায়, ২০১০ সালের পর যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নেন সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এরপর থেকে তার স্ত্রী মোসাম্মৎ রশীদুন আরা হাসনিন এবং একমাত্র মেয়ে তুষারাদ্রী মাহমুদ ওই দেশেই বসবাস করে আসছেন। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে তার স্ত্রী মোসাম্মৎ রশীদুন আরা হাসনিন দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার ডকচাই গ্রামে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ময়মনসিংহ-১১ আসনের এমপি হন এম এ ওয়াহেদ। তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হয়েছিলেন। ওয়াহেদ অনেক আগেই পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সে দেশের পাসপোর্টও রয়েছে তার, যার নম্বর ই-২২৯৫২৩। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার পাসপোর্টও রয়েছে তার। তবে সেসব তথ্য গোপন করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। হলফনামায় তিনি নিজেকে শুধু বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৮৬৭২৩৬৯৫৫৩। পাসপোর্ট নম্বর এ-০৩৩০৭৬৩২।

নাগরিকত্ব নেওয়ার পর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ যুক্তরাজ্যে কমপক্ষে ২৬০টি সম্পত্তি গড়েছেন, এর জন্য তিনি প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড বা ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। এসব যুক্তরাজ্যে সরকারের ওয়েবসাইটেও রয়েছে।

নাগরিকত্ব নেওয়ার পর ড. হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামের লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে একটি বাড়ি করেছেন। এখন ওই বাড়িতেই একমাত্র ছেলে আর স্ত্রী নুরান ফাতেমাকে নিয়ে আছেন। 

ড. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে নিউইয়র্ক সিটিতে ৯টি সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। সেখানে জ্যাকসন হাইটের একটি আলিশান ভবনে ৫টি কনডোমনিয়াম কিনেছিলেন, ওই সময়ে যার দাম ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ কোটি টাকা)। এর কাছাকাছি কয়েকটি ভবনে তিনি আরও ৩টি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার দাম ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় ৭ কোটি টাকা)। ৭০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই মোহাম্মদ আবদুস সোবহান ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নরওয়েতে পড়াশোনা করার পর তিনি ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্ক চলে যান। সেখানে থাকাকালীন তিনি দেশটির নাগরিকত্বও পান। 

২০২১ সালের মার্চে দ্বৈত (দুই দেশের) নাগরিক হিসেবে ১৩ হাজার ৯৩১ বাংলাদেশির তথ্য পাওয়া যায়। সেসময় হাই কোর্টে দাখিলের জন্য পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী সর্বমোট ১০৪ দেশের নাগরিক তারা। এর মধ্যে আমেরিকারই ১০ হাজার ৭৭৪ জন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) কার্যালয় থেকে এই তথ্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর