সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেশ কয়েকটি ধারা হয়রানি ও নিপীড়নমূলক উল্লেখ করে আইনটি বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, দেশের প্রচলিত অপরাধের সঙ্গে বিদ্যমান আইনের সংজ্ঞা, বিচার পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে ত্রুটি রয়েছে। আইনটি করাই হয়েছিল কর্তৃত্ববাদি সরকারের কর্তৃত্ব বিকাশের জন্য। এই আইনের মাধ্যমে মূলত বিরোধী মতকে দমন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ সংশোধন বিষয়ক একটি মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনরা এসব কথা বলেন। পরে আইনটি বাতিলই করা হবে বলে উপস্থিত সবাইকে জানান অনুষ্ঠানের সভাপতি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম; টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির, ইংরেজি দৈনিক দ্যা ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল আইন বিভাগের শিক্ষক কাজী মাহফুজুল হক সুপন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম ভিকটিম খাদিজাতুল কোবরা প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।আসিফ নজরুল বলেন, আমার মনে হয় আইনটি বাতিল করা উচিত। সেদিকে আমরা যাবো। ঠিক এই মুহূর্তে পুরো আইনটা বাতিল করবো নাকি স্পিচ অফেন্স সব বাতিল করবো সে ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নিবো। আল্টিমেটলি আইনটি বাতিল হবে।
তিনি বলেন, পরবর্তীকালে যখন নতুন আইন হবে এর মূল উদ্দেশ্য থাকবে সাইবার সুরক্ষা দেওয়া, বিশেষ করে নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া। সেখানে অবশ্যই নারী এবং শিশুদের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করা হবে। তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা রাখার ব্যবস্থা করবো। এআই প্রযুক্তি কাভার করার চেষ্টা করবো। আমরা এরকম মতবিনিময় সভা অব্যাহত রাখবো।
তিনি আরও বলেন, আমরা সাইবার নিরাপত্তা বা আগের আইনের সব মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু নাগরিক পরিসরে একটি ধারণা আছে, আইন মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলেই সব মামলা প্রত্যাহার করতে পারে। এটা সত্যি না। একটি মামলার বিভিন্ন স্তর থাকে। সব মামলা ইচ্ছা করলেই প্রত্যাহার করা যায় না। যে মামলায় রায়ের মাধ্যমে দণ্ড হয়ে যায়, সেসব মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে দণ্ডিতের আবেদন ছাড়া মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ নাই।
আসিফ নজরুল বলেন, আপনাদের কথা দিতে পারি আমরা পর্যায়ক্রমে সকল ধরনের কালাকানুন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করবো। আজকে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে, বৈষম্যহীন-শোষণহীন বাংলদেশের স্বপ্ন নিয়ে, রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন নিয়ে আইন সংস্কারের মধ্যে তার প্রতিফলন থাকবে।
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম নিজের বক্তব্যে বলেন, এই আইনটা দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হচ্ছিল। আলোচনায় এসেছে আইনটিকে কিভবে অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। আমি বলবো, অপপ্রয়োগ করার জন্যই আইনটি করা হয়েছিল। ফলে এটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ছে।
তিনি বলেন, এ আইনের পেছনের মনস্তত্বটা এখন আমাদের কাছে স্পষ্ট। ফলে আইনটিকে আমরা যতভাবেই সংশোধন করি না কেন, এই মনস্তত্বের কারণে মানুষের কাছে অনাস্থাটা থেকে যাবে। এটি একটি বড় সমস্যা। আমি কোনোভাবেই এই আইনটা সংশোধন করে নামটাও যদি রেখে দেই তাহলেও কিন্তু মানুষ এই আইনটাকে বিশ্বাস করবে না। এই মনস্তত্বটা পরিবর্তন করে সুরক্ষার জন্যই আইনটি পরির্তন করা দরকার।
নাহিদ বলেন, এখানে অনেক প্রস্তাবনা এসেছে, এসব প্রস্তাবনা আমলে নেওয়া উচিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব আমলে নিয়ে নতুনভাবেই আইনটা করা উচিত। আমরা যেহেতু একটি সমাধান চাচ্ছি, টেকসই একটি সমাধান করা উচিত। ততদিন পর্যআন্ত এই আইনটির কি হবে? এই সিদ্ধান্তটা আমাদের দ্রুত নেওয়া উচিত। সংশোধন করি বা নতুন ভাবেই করি, এখনো এই আইনটা আছে। এই আইনে আমাদের পক্ষেও দুইটা মামলা হয়েছে। আমাদের নিয়ে কটূক্তি করার জন্য দুটি মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। কারা করেছে, কোন উদ্দেশ্যে করেছে.. এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর। স্বাধীন বাংলাদেশে যদি এই আইনে আরেকটি মামলা হয় তবে সেটি আমাদের সবার জন্যই বিব্রতকর হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সবার আলোচনায় ঐক্যমত্য হয়েছে যে, এই আইনটা থাকা উচিত না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি তুলে এসেছি। আমরা মনে করেছি, এটা এমন একটা আইন যে সংশোধনের অযোগ্য। বাতিল করা উচিত। এ ধরনের আইগুলো কর্তৃত্ববাদি সরকারের কর্তৃত্ব বিকাশে অন্যতম হাতিয়ার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তৈরি করার অন্যতম হাতিয়ার তৈরি হয়েছে এবং ব্যবহৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি আইন পরবর্তীতে ডিজিটল নিরাপত্তা আইন এবং সর্বশেষ সাইবার নিরাপত্তা আইন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, আইনটি সংশোধনের অযোগ্য, বাতিল করা উচিত। আমি মনে করি এই ধরনের আইন আরও সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় ইন্টারনেট সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাহলে তা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার আলোকে করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, সাইবার নিরাপত্তা নামে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে পুরো সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। ফলে এই ধরনের নামও থাকা উচিত না বলে আমি মনে করি। এই আইনের মাধ্যমে পুলিশকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই না, এই আইনের মাধ্যমে চারটি কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করে তাদের অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের পাশাপাশি দণ্ডবিধি থেকে মানহানি সংক্রান্ত ধারা বাদ দেওয়া উচিত মন্তব্য করে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সারা হেসেন বলেন, কোনো আইনের মানহানি সংক্রান্ত ধারা থাকা উচিত না। বিভিন্ন সরকারের আমলে মানহানি সংক্রান্ত ধারার অনেক অপব্যবহার আমরা দেখেছি।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এই আইনটি বাতিলই করে দেওয়া উচিত। শুধু বাতিল করলেই হবে না, সাইবার সিকিউরিটির কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সেটাও ঠিক করতে হবে। এটা করতে হবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে।
তিনি বলেন, বর্তমান আইনের একটি ধারায় বলা আছে, যদি কেউ ডিজিটাল বা ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন তথ্য উপস্থাপন করেন, যা আক্রমণাত্মক, ভীতিকর, ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত ও হেয়প্রতিপন্ন করা। এগুলো কোন আইনের ভাষা? কাকেকে বিরক্ত করেছে? দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা হলেওতো কেউ বিরক্ত হতে পারেন। তাহলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কি হবে? এই যায়গাটাতে একটি ব্যালেন্স আনতে হবে। যাতে আইন থাকলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তিনি বলেন, আমার মনে হয়, এই আইনটি বাতিল করে তিনটি ডাইমেনশন ক্রিয়েট করা উচিত। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টা বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত এবং কিভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ থাকবে, সেটা নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত।
শিক্ষক কাজী মাহফুজুল হক সুপন বলেন, বর্তমান আইটি যেভাবে রয়েছে, এটা থাকা উচিত নয়। তিনি বলেন, এই আইনের সংজ্ঞায় অনেক সমস্যা রয়েছে। কোনটা হ্যাকিং আর কোনটা হ্যাকিং না, বর্তমান আইনে থাকা সংজ্ঞায় এসব স্পষ্ট বলা নেই। আইনটি ভারতীয় আইনের হুবুহু অনুকরণ করা হয়েছে। এ কারণে আমাদের দেশের নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে সংজ্ঞাগত সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। আমরা যদি স্ট্যান্ডার্ড ফলো করি তাহলে সবই সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন যখন করা হলো, তখন সাংবাদিকরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর পরে আইনজীবী পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিট আইন নামে করা হলো। নতুন আইনে সুকৌশলে পুরনো আইনের অনেক ধারাই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেগুলো করাই হয়েছে বাক-স্বাধীনতা হরণ ও স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরির জন্য। এ ধরনের আইনের নামে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ যেন না থাকে এটা আমরা চাই।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত