মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

ভিক্ষার টাকায় জীবন চলে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রশিদের

ভিক্ষার টাকায় জীবন চলে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রশিদের

স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধা আ. রশিদ (৭০)। জীবন সায়াহ্নে এসেও বীর এ মুক্তিযোদ্ধার জীবন চলে ভিক্ষার টাকায়। অভাব অনটনের সংসারে বিধবা এক মেয়ে আর নাতি। স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় ১০ বছর। মাঝে টুকটাক কিছু কাজ করলেও বয়সের কারণে এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। জীবন যুদ্ধে পরাজিত এই মুক্তিযোদ্ধা সংসার চালাতে তাই বাধ্য হয়ে গত এক মাস ধরে কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোলচত্বরে ভিক্ষা করা শুরু করেছেন।

আ. রশিদের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ইউনিয়নের আমড়াগাছিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নববধূকে বাড়িতে রেখেই চলে যান খুলনা। সেখান থেকে ভারতের পশ্চিমবঙের হাসনাবাদ চব্বিশ পরগনায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ফিরে এসে খুলনায় মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯নং সেক্টরে যোগ দেন। তার দায়িত্ব ছিলো খুলনা, সুন্দরবন দিয়ে নিরাপদে সংখ্যালঘুদের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে দেয়া। খুলনা থেকে নৌকাযোগে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার সময় একদিন হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি পড়ে যান। গুলি লাগে ডান উরুতে। কোন রকমে সে যাত্রা বেচেঁ যান তিনি।

আ. রশিদ বলেন, ‘গুলি খাইয়া হ্যাদিন মইররা গেলে বালো হইতে। বুড়া বয়সে এতো কষ্ট করা লাগতে না। মুক্তিযুদ্ধ করছি। দ্যাশ স্বাদীন হইছে। স্বাদীন দ্যাশে ভিক্ষা কইরা খাই।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দ্যাশ স্বাদীন ওইলে ভালো থাকমু, এই আশায় যুদ্ধ করছি। এহন দ্যাহি রাজাকারগো গাড়িতে দ্যাশের পতাকা। আর আমরা মুক্তিযুদ্ধ কইরা ভিক্ষা কইররা খাই।

মুক্তিযোদ্ধা আ. রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর পিরোজপুরের বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। ওই সময় তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দেশরক্ষা বিভাগের পক্ষে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী কর্তৃক তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’ দেয়া হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মঠবাড়িয়া উপজেলা কমান্ড ও পিরোজপুর জেলা কমান্ড তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যয়নপত্র দেয়। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রমাণ পত্র রয়েছে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি তালিকাভুক্ত হতে পারেননি তিনি।

আক্ষেপ করে আ. রশিদ বলেন, ২০০৪ সালে পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধ বাছাই কমিটি তাকে সরকারি তালিকা থেকে বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করে সরকারি তালিকায় অন্তভুক্ত করতে সুপারিশ করে। কিন্তু দীর্ঘ ১০ বছরেও সরকারি তালিকায় তার নাম ওঠেনি।

ভাগ্যোন্নয়নের আশায় প্রায় ১৫ বছর পূর্বে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় চলে আসেন লেখাপড়া না জানা আ. রশিদ। ঢাকার কেরানীগঞ্জে বাসা ভাড়া নেন। গার্মেন্টসের ঝুট কাপড়ের ছোটোখাটো ব্যবসাও জুটিয়ে ফেলেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিলো আ. রশিদের। এর মধ্যে স্ত্রী মমতাজ বেগম মারা যান। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। কিছুদিন পর ছেলে বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ও ক্ষতির সম্মুখীন হন। অনেক কষ্টে দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। এরই মধ্যে বড় মেয়ে বিধবা হয়ে এক শিশু সন্তানকে নিয়ে আবারও তার কাছে ফিরে আসে।

একদিকে আর্থিক অনটন, অন্যদিকে বার্ধক্য দুটোই তার জন্য পীড়ার কারণ হয়ে দাড়ায়। শেষে বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে ভিক্ষাবৃত্তি করা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা এলাকায় একটি খুপড়ি ঘর ভাড়া নিয়ে বাস করছেন।

আ. রশিদ বলেন, ‘ট্যাহা নাই। খামু কি? ঘরে নাতিসহ বিধবা মাইয়া। উপোস থাকতে থাকতে আর বালো লাগে না। সরকারি তালিকায় নামডা উডলেতো কিছু টাহা-পয়সা পাইতাম।’

তিনি জানান, একাধিকবার মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সরকারি তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। তার অভিযোগ, সেখানকার কিছু লোক টাকা ছাড়া তাকে তালিকাভুক্ত করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. বাচ্চু মুক্তিযোদ্ধা আ. রশিদকে দেয়া প্রত্যয়নপত্রে লেখেন, ‘তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে তিনি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন।’

সরকারি তালিকাভুক্ত (গেজেট নং ১০৫৭) মঠবাড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান শরীফ বলেন, আ. রশিদ আমার সঙ্গে ভারতের আমলানি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং অগণিত হিন্দুদের জীবন তিনি বাঁচিয়েছেন। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।

এ ব্যাপারে কেরানীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. শাহজাহান বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করছেন, জাতি হিসেবে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।
 

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪/ রশিদা

সর্বশেষ খবর