শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

আইনি জটিলতায় পিছিয়ে গেল দুর্জয়ের ফেরা

দুর্জয়ের খোঁজ পেয়ে ভারতে এসে পৌঁছায় তার মা নমিতা ভক্ত এবং মামা সুব্রত মণ্ডল। বৃহস্পতিবারই কামালগাজীতে সেই এতিম খানায় পৌঁছে যান তার মা ও মামা। চারবছর পর হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন মা। মা কে পেয়ে ছেলেরও বাঁধভাঙা কান্না। ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে শুক্রবারই কলকাতার মৌলালির ইলিয়ট রোডে অবস্থিত শিশুকল্যাণ সমিতির দ্বারস্থ হন নমিতা দেবী। কারণ সমিতি অনুমতি দিলেই মা-মামার হাত ধরে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবেন দুর্জয়। তবে দুর্জয়কে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু আইনি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলি কাটিয়ে উঠতে পারলেই দুর্জয় ফিরে যাবে তার মায়ের কোলে। এদিন নমিতা দেবী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানান 'আমার বিশ্বাস ছিল একদিন ছেলেকে আমি ফেরত পাবই। সেই বিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশে মন্দির, মসজিদ, দরগায় প্রার্থনা করেছি। ছেলের চিন্তায় গত চার বছরে দু'চোখের পাতা এক করতে পারিনি। স্বামী বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত থাকায় একাই ছেলের খোঁজে এতদিন চারিদিকে খুঁজে বেড়িয়েছি। অবশেষে ছেলেকে দেখতে পেয়ে খুব ভাল লাগছে'। তবে এবারই নয়, এর আগেও ছেলের খোঁজে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। তবে মালিপুকুর থেকে ছেলে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ায় সে যাত্রায় ছেলের দেখা মেলেনি।

এদিকে 'ইচ্ছে' এতিম খানার প্রধান পার্থ সারথি মিত্র মুঠোফোনে জানিয়েছেন 'দুর্জয়কে আমরা তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু যেহেতু আমরা ওকে সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলাম তাই সরকার অনুমতি দিলেই আমরা দুর্জয়কে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারবো। তিনি জানান শুক্রবার দুর্জয়ের মা ও মামা শিশু কল্যাণ সমিতিতে এসেছিলেন তবে আইনি জটিলতা থাকায় তারা এখনই দুর্জয়কে ফেরত পাবেন না।

সেৰেত্রে প্রথমে কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ উপাদুতাবাস থেকে তাদের অনুমতিপত্র নিতে হবে। তাছাড়া দুর্জয়ের নামের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সমস্যারও সমাধান করতে হবে। উলেস্নখ্য দুর্জয়ের আসল নাম দুর্জয় ভক্ত হলেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রালয়ে তার নাম দুর্জয় ভক্তি। তারওপর ভারতে এসে বিভিন্ন স্থানে ইন্দ্রনারায়ন রায় চৌধুরী নামেও পরিচয় দিয়েছিল। আগামী দুইদিন শনিবার ও রোববার সরকারি ছুটির দিন থাকায় সোমবারের আগে এই আইনি জটিলতা কাটার কোন সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তিনি।

এর আগে বুধবার সকালে আনন্দবাজার পত্রিকা খুলেই চমকে ওঠে কলকাতার কামালগাজিতে 'ইচ্ছে' নামের একটি শেল্টার হোমে থাকা শিশু ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। পত্রিকাটি নিয়ে শেল্টার হোমের কর্তাদের দেখিয়ে বলে, 'ছবির এই ছেলেটিকে আমি চিনি, যে করেই হোক ছেলেটিকে দেশে ফেরাতে হবে।'

চার বছর আগের ছবি। কিছুটা ঝাপসা। শেল্টার হোমের কর্মকর্তারা বুঝতেই পারেননি, আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হওয়া শিশু দুর্জয় ভক্তিই তাদের শেল্টার হোমের ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।

আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, দুর্জয়ের মামা চার বছর ধরে দুর্জয়কে খোঁজাখুঁজি করছেন, ঘুরছেন কলকাতার দ্বারে দ্বারে। কিন্তু কিছুতেই কোনো সন্ধান পাচ্ছেন না। দুর্জয়ের মামা তার মোবাইল ফোন নম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় রেখে আসেন।

ওদিকে বুধবারই স্কুল শেষে বিকালে স্কুলের পোশাকেই শিয়ালদহ স্টেশনে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে হাজির হয় দুর্জয়। সেখানকার এক কর্মীকে দুর্জয় বলে, 'আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দাও, তাহলেই আমি বাড়ি ফিরে যেতে পারব।'

এরপর ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুর্জয়ের মামা সুব্রত মণ্ডল যশোর থেকে কলকাতায় গিয়েছিলেন দুর্জয়কে খুঁজতে। তার চেষ্টাতেই আনন্দবাজার পত্রিকায় দুর্জয়কে নিয়ে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। সে সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় নিজের মোবাইল ফোন নম্বরটি রেখে এসেছিলেন সুব্রত মণ্ডল। বুধবার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে বসেই মামার সঙ্গে কথা বলে দুর্জয়। দীর্ঘ চার বছর পর এই প্রথম বাড়ির কারও সঙ্গে কথা। 'মামা কবে নিতে আসবা'- এটুকু বলেই অঝরে কাঁদতে থাকে সে।

দুর্জয়ে মুখে শোনা গল্প

বুধবার বিকালে দুর্জয়ের মুখ থেকে শোনা সেই গল্প আবারও ছাপা হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকায়। ২০১১ সালের ঈদের আগের দিন সীমান্তের কাছে পাটবাড়ীতে এক উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিল দুর্জয়। সেখানে হঠাৎই লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে। সে-ও ছুট লাগায়। 'একটা লোক আমাকে নিয়ে ছুটতে থাকে। অনেকক্ষণ ছোটার পর সে আমায় বলে, তুই ভারতে ঢুকে গিয়েছিস। আর ফিরতে পারবি না।' এরপর সেই লোকটার সঙ্গেই কলকাতায় চলে যায় দুর্জয়। ওই লোকটার সঙ্গেই থাকত সে। তাকে মাদক পাচারের কাজে লাগাত লোকটা। তার সঙ্গেই ট্রেনে চেপে নানা জায়গায় ঘুরেছে দুর্জয়।

মাদক পাচারের কাজ ভালো লাগত না তার। তাই ফের একদিন ছুট দেয় সে। শিয়ালদহে এসে পুলিশের কাছে গিয়ে নিজেকে ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী বলে পরিচয় দেয়। মাদক ব্যবসায়ী ওই ব্যক্তিই তাকে শিখিয়েছিল, পুলিশ ধরলে এ নাম বলতে। বাংলাদেশের কথা বা বাবা-মায়ের কথা বললে পুলিশ জেলে ভরবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। নিজের নাম ইন্দ্রনারায়ণ বলতেই পুলিশ তাকে পাঠিয়ে দেয় হাওড়ার মালিপুকুর হোমে। 'ওখানে পচা খাবার দিত, পোকাও থাকত। নোংরা জামাকাপড় দিত। কিছু বললেই মারত, কেটে সেখানে লবণ দিত।' এক পর্যায়ে মালিপুকুর হোমের কর্তাদের কাছে সে নিজের আসল পরিচয় দেয়। এরপর অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। উপায় না দেখে আবারও সেখান থেকে পালায় সে। শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে সেখানকার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনার কামালগাজিতে 'ইচ্ছে' নামে অনাথ আশ্রমে। এখানে একটি স্কুলেও ভর্তি হয় সে। এখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বুধবার স্কুলের পোশাকেই শিয়ালদহে হাজির হয়েছিল সে। হাতে ধরা ছিল আনন্দবাজার।

 

সর্বশেষ খবর