বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
বাংলাদেশে মানবাধিকার

মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে বেশকিছু অসঙ্গতি

প্রতিদিন ডেস্ক

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের ‘টম ল্যানটস হিউম্যান রাইট কমিশন’-এর শুনানিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তমনা লেখকদের হত্যা, প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষকে হুমকি, সরকারের সমালোচকদের গ্রেফতার ও হয়রানির নানা তথ্য উপস্থাপিত হয়। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন প্যানেলিস্টরা। তারা মানুষের জীবন-মানের সার্বিক উন্নয়নে সবাইকে একযোগে কাজের পরামর্শ দেন। এনআরবি নিউজ। ১ ডিসেম্বর এ শুনানি হয় ওয়াশিংটন ডিসির রেবার্ন হাউস অফিস ভবনে। ‘শ্রিঙ্কিং স্পেস ফর সিভিল সোসাইটি’ শীর্ষক সিরিজ শুনানিতে এবারের বিষয়বস্তু ছিল ‘হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’। শুনানিতে অংশ নিয়ে আয়োজক তথা প্যানেলিস্টদের বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরিয়ে দিয়েছেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপ-প্রধান মাহবুব হাসান সালেহ। এর অন্যতম হচ্ছে- সাকাচৌ এবং মুজাহিদকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়নি, তারা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে দণ্ডিত হন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বড় একটি প্রকল্প থেকে অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার প্রত্যাহার করেনি, বরং বাংলাদেশই নিজস্ব অর্থায়নে ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত করবে বিধায় বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থ সহায়তার যে অনুরোধ জানিয়েছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ শুনানির প্যানেলিস্টদের কেউই বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধের নামে তিন মাসব্যাপী তাণ্ডবের প্রসঙ্গ টানেননি। এটিকে শুনানির ক্ষেত্রে অসঙ্গতি বলে অভিহিত করে মাহবুব হাসান সালেহ সবিস্তারে জানিয়েছেন, ওই তাণ্ডবে শতাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, অনেক সহায়-সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এগুলোও মানবাধিকার লংঘনের অন্যতম উদাহরণ। সালেহ আরও উল্লেখ করেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতক হিসেবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন এখনো যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে রয়েছেন। এটি কেউই উল্লেখ করলেন না। যদিও মানবাধিকার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই উপস্থাপিত হওয়া উচিত ছিল। আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা সম্ভব নয়।

শুনানিতে উপস্থিত এক ব্যক্তির প্রশ্ন ছিল একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে। এর জবাব কেউ দেননি দেখে বাংলাদেশি এই কূটনীতিক সালেহ ফ্লোর চেয়েছিলেন জবাব দেওয়ার জন্য। সে সুযোগ দেওয়া না হলেও তিনি অত্যন্ত কৌশলে উল্লেখ করেছেন, ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ এবং সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ মা-বোন। এ সংখ্যাই বলে দেয় একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ভূমিকার কথা। 

সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে নিহত ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা ছিলেন অন্যতম প্যানেলিস্ট। সাকা চৌ এবং মুজাহিদকে বিরোধীদলীয় রাজনীতিক হিসেবে যারা অভিহিত করছেন তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ওরা মানবতার শত্রু ছিল। ওরা বহু মানুষকে হত্যা করেছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ওদের বিচারের বিকল্প ছিল না।

রাফিদা আহমেদ অবশ্য তার স্বামীসহ অন্য ব্লগারদের হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদানে সরকারের রহস্যজনক আচরণের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থেই এহেন নৃশংসতায় লিপ্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেন্টার ফর ইনকুয়ারির পাবলিক পলিসি ডাইরেক্টর মাইকেল ডি ডোরা শুনানির সঞ্চালনাকালে বলেছেন, গত দুই বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে মুক্তমনা পাঁচ ব্লগার-লেখকের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধির কথা জানিয়ে বলেন, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখকদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এহেন অবস্থার অবসানে সরকার কঠোর না হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এ রকম পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসকে নিশ্চুপ থাকলে চলবে না।

উদ্বোধনী বক্তব্যে টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের কো-চেয়ার কংগ্রেসম্যান জেমস পি. ম্যাকগভার্ন বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আমরা আগে থেকেই নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছি। এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত ইউএস অ্যাম্বাসেডর স্টিফেন র‌্যাপের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। আমরা মৃত্যুদণ্ড রহিতের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তা রক্ষা করা হয়নি। আরেকটি বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। সেটি হচ্ছে সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের দমন-পীড়নের অভিযোগ। শত শত মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা অব্যাহত রয়েছে। গুমের অভিযোগও রয়েছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে আল কায়েদা এবং আইএসআইএসের তৎপরতার সংবাদ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতির প্রত্যাশাকেও শঙ্কায় ফেলেছে। আমি কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান রাখছি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য।

প্যানেলিস্টদের মধ্যে আরও ছিলেন ইউএস কমিশন অর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের সিনিয়র পলিসি এনালিস্ট শহর চৌধুরী, পেন আমেরিকান সেন্টারের মুক্ত মত প্রকাশ কার্যক্রমের পরিচালক কারিন ডিউশ কারলেকার ও আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক ভারত গোপালাস্বামী।

এক ঘণ্টাব্যাপী এ শুনানি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে বাংলাদেশ সরকারের কাউকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এতে। অন্যের কাছে জেনে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন দূতাবাসের উপ-প্রধান।

শুনানির কো-হোস্ট কংগ্রেসম্যান যোসেফ আর পিটস ছিলেন অনুপস্থিত। তার স্থলে সেখানে বক্তব্য দেন টেক্সাসের কংগ্রেসওম্যান শিলা জ্যাকসন লি।

সর্বশেষ খবর