বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পদে পদে ভোগান্তি রমেক হাসপাতালে

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

পদে পদে ভোগান্তি রমেক হাসপাতালে

গত শুক্রবার রাত ৯টায় দুই বোন তার অসুস্থ ভাইকে নিয়ে আসেন রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। ৩০ টাকা দিয়ে নাম নিবন্ধন করান। ওয়ার্ডে নেওয়ার জন্য তাকে রোগী বহনের ট্রলিতে তোলা হয়। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় ট্রলি আটকে দেন হাসপাতালের কর্মচারীরা। রোগীকে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে বলেন কর্মচারী (এমএলএসএস) মিন্টু মিয়া ওরফে ডাইল মিন্টু। এ নিয়ে দুই বোনের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় এই প্রতিবেদক ছবি তুলতে গেলে তাকে আটক করে অশালীন আচরণ করেন ডাইল মিন্টুু ও তার সহযোগী ইউনুস আলী। মুঠোফোনও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। পরে অন্য কর্মচারীরা এসে এ প্রতিবেদককে উদ্ধার করেন। এরই মধ্যে দুই বোন নিজেরাই ট্রলি ঠেলে তাদের ভাইকে ওয়ার্ডে নিয়ে যান। তার আগের বুধবারে আরেক ঘটনা। বেলা পৌনে ১টায় গঙ্গাচড়া থেকে মমদেল হোসেন নামে এক রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। রোগী অজ্ঞান। তাকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তির অনুমতি মিললেও বেলা ২টা পর্যন্ত তাকে ওয়ার্ডে নেওয়া হয় না। কর্মচারীরা রোগীর স্বজনের কাছে ৩০০ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাবে না। ৩০০ টাকা দেওয়ার পর রোগীর ঠাঁই হয় ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেঝেতে।

খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এমন ঘটনা প্রতিদিনের। টাকা ছাড়া কোনো রোগীর ওয়ার্ডে যাওয়ার সুযোগ নেই। সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নেওয়া হয়। রাত ১১টার পর রোগী এলে ১ হাজার থেকে ২-৩ হাজার টাকা নিয়ে তবেই ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, কর্মচারীদের পাশাপাশি আছে দালালদের দৌরাত্ম্য। দালাল না ধরলে ভর্তির সুযোগ নেই। ওয়ার্ডের বিছানায় ঠাঁই হয় না। অন্যভাবে ভর্তি হলেও তার ঠাঁই হয় মেঝেতে। দালালদের খপ্পরে পড়ে টাকা খোয়ান রোগী ও তার স্বজনেরা। টাকা না দিলে রোগীর স্বজনদের মারপিট করা হয়। এ ছাড়া রোগীর ওষুধ, খাবার এবং তাদের স্বজনের টাকা ও মুঠোফোন চুরির ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। রমেক হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে আসা রোগীরা পদে পদে এমন ভোগান্তির শিকার হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক আ স ম বরকতুল্লাহ দাবি করেন, ‘অনিয়ম অনেকটাই কমে গেছে। জরুরি বিভাগে রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া এবং দালালদের দৌরাত্ম্য নিয়ে গত ৩১ অক্টোবর এক সমন্বয় সভা করা হয়েছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিচালক ‘অনিয়ম কমেছে’ বলে দাবি করলেও অনিয়ম রয়েছে বহাল তবিয়তে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এক হাজার শয্যার রমেক হাসপাতালে প্রতিদিন ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার রোগী চিকিত্সাধীন থাকেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ রোগী চিকিত্সা নিতে আসেন। চিকিত্সা নিতে এলেই তাদের দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়। অভিযোগ পাওয়া গেছে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান নয়ন, কর্মচারী ডাইল মিন্টু ও ইউনুস আলীর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের সদস্যরা পালা করে জরুরি বিভাগে অবস্থান করেন। টাকা ছাড়া রোগীদের ভর্তি করতে দেওয়া হয় না। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ১০০ দালাল। জরুরি বিভাগে রোগী নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরাও কিছু বলতে পারেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, ‘সিন্ডিকেট সদস্যদের হয়রানির বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ফলে আমরা নীরবে তাদের অরাজকতা সহ্য করে যাচ্ছি। তবে হাসপাতাল পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) রুহুল আমীনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নয়নকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি কারাগারে থাকলেও সিন্ডিকেট সদস্যরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’ আরেক অভিযোগে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ২ নম্বর মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে একজন রোগীর স্বজনের কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কর্মচারী তাপসী রায়কে ওই ওয়ার্ড থেকে প্রত্যাহার করা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর আগের দিন চুরি হয় ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের একজন রোগীর মুঠোফোন। জানা গেছে, দিনে-রাতে চিকিত্সাধীন রোগীর ওষুধ ও জিনিসপত্র চুরির ঘটনা কোনোভাবেই রুখতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে ওষুধ ও জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। গত নভেম্বর মাসে হাসপাতালের ৪০টি ওয়ার্ডে ১২০ জন রোগীর ওষুধ ও খাবার চুরির ঘটনা ঘটলেও একজন চোরকেও আটক করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মেডিসিন ওয়ার্ডের রোগী আবুল কাশেম বলেন, গত বুধবার বিকালে তার ছেলে খাবার আনতে বাইরে যাওয়ার পর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। আধাঘণ্টা পর তার ছেলে এসে দেখেন ৯০০ টাকার কেনা ওষুধ কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। ওয়ার্ডের নার্সকে অভিযোগ করার পর কোনো ফল হয়নি। মহিলা ওয়ার্ডের রোগী আম্বিয়া খাতুন বলেন, গত শুক্রবার সকালে তার স্বামী বাসায় চলে যান। বিকালে পায়খানা (ল্যাট্রিন) থেকে ফিরে এসে দেখেন ওষুধ ও বিছানার নিচে রাখা ২ হাজার টাকা নাই। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের একশ্রেণির কর্মচারীর সহযোগিতায় দালালরা এই চুরির সঙ্গে জড়িত। এসব ঘটনায় পরিচালকের কাছে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ করা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

গতকাল জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় সোহেল ও মিনহাজুল নামের দুই দালালের সঙ্গে। তারা দাবি করেন, জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন বলেই তারা রোগীর কাছ থেকে টাকা নেন। কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বিষয়টি জানে। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘অনিয়ম করে দালালরা নাম হয় কর্মচারীদের। দালালদের বিতাড়িত করতে শিগগিরই অভিযান শুরু করা হবে।’

সর্বশেষ খবর