সরকারের হতদরিদ্রবান্ধব ১০ টাকার চাল নিয়ে এমন কারবার শুরু হয়েছে, যার কারণে যাদের পেটে ভাত জুটছে না, তাদের ভাগ্যে এ চালও জুটছে না। বাস্তবে এ চাল জুটছে তাদেরই, যাদের পেটে ভাত, গোয়ালভরা ধান এবং মাঠভরা জমিজমা ও বাড়িঘর রয়েছে। এ-সংক্রান্ত অভিযোগ প্রতিদিনই আসছে।
ভাতবঞ্চিতরা চালবঞ্চিত : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, এক অনুসন্ধানের সময় বিরামপুর উপজেলার কাটলা ইউনিয়নের রণগাঁও গ্রামের ৬১ বছরের বৃদ্ধ মো. মফিজ উদ্দীন বলেন, ‘গ্রামের ২০ বিঘা জমিয়ালা সীতারাম পায় ১০ টাকা কেজির চাল, আর হামার ঘরে চাল নাই, ধার-দেনা করে কোনোমতে সংসার চলে। গাঁওত কাম নাই, পেটে ভাত নাই, ঋণ করে সংসার চলে। তাও হামার চেয়ারম্যান, মেম্বাররা হামাক চালের কার্ড দেয় নাই। ৬১ বছর হয়ছে, ৬৫ বছর হয় নাই, তাই বয়স্ক ভাতার কোনো কার্ডও পাই নাই।’ জানা গেছে, এ গ্রামের ১৮ জন হতদরিদ্র ১০ টাকার চাল থেকে বঞ্চিত হওয়ায় জেলা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একই অবস্থা বিরামপুরের কাটলা ইউনিয়নের ঘাসুড়িয়া, চৌঘুরিয়া, রণগাঁও গ্রামের। এসব গ্রামের মফিজ উদ্দীন, বৃদ্ধ আজিমুদ্দীন, তহমিনা বেগম, আদিবাসী নারী পুতুল কুজুর (২৬) চাল বা চালের কার্ড না পাওয়ার বিবরণ তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে কাটলা ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. নুরুজ্জামান হোসেনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘তাদের বিষয়ে জানি। বিধবা ভাতার কার্ড এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ চেয়ারম্যান মো. নাজির হোসেন বলেন, ‘আমি নতুন চেয়ারম্যান। ১০ টাকা কেজি চালের তালিকা নির্বাচনের আগেই ইউপি সচিব মশিউর রহমান তৈরি করায় অনেক ভুল আছে। এখন নতুন তালিকায় যোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’
ওজনে কম দিয়ে ফাঁকি : চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শিবগঞ্জে গুদাম থেকে চাল বের করার পর অধিকাংশ ডিলারই চিহ্নিত সিন্ডিকেটের কাছে চাল বিক্রি করে দিচ্ছেন। বাকিরা বস্তায় চাল কম থাকার অজুহাত তুলে জনপ্রতি কম করে চাল বিতরণ করছেন। আবার কোনো কোনো স্থানে একবার চাল দিয়ে কার্ডে দুবারের স্বাক্ষর বা টিপসই নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ডিলার হাবিবুর রহমানকে প্রশ্ন করলে তিনি বিতরণের ক্ষেত্রে আধা কেজি করে চাল কম দেওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন, ‘এজন্য ৫ টাকা করে ফেরত দেওয়া হচ্ছে।’ আরেক ডিলার ডালিম আলী বলেন, ‘গোডাউন থেকে চাল আনার সময় বস্তাপ্রতি আড়াই বা তিন কেজি করে কম থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে আধা কেজি চাল কম দিচ্ছি এবং টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো নিয়ম না থাকায় তা দিচ্ছি না।’ ডিলার সাজেমান জানান, ‘গোডাউন থেকে চাল উত্তোলনের সময় চাল কম দিচ্ছে এবং এজন্য কার্ডধারীদের ৫ টাকা করে ফেরত দেওয়া হচ্ছে।’ ওজনে কম দেওয়ার ব্যাপারে শিবগঞ্জ খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী বলেন, গোডাউন থেকে ছালা বা বস্তার ওজন বাদ দিয়ে সঠিক ওজনে চাল দেওয়া হয়। সেহেতু চাল কম দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে খাদ্য অধিদফতরের অফিস সহকারী মো. লতিফুর রহমান জানান, উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের ৩০ জন ডিলারের মাধ্যমে ২১ হাজার ৪২৫ জনের জন্য ৬৪২ দশমিক ৭৫০ মেট্রিক টন চাল বস্তা বাদে ওজন করে দেওয়া হয়েছে। খাদ্য অধিদফতর থেকে কোনো ধরনের অনিয়ম বা ওজনে কম দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট ডিলাররাই দোষ চাপিয়ে ফয়দা লুটছেন। শিবগঞ্জ উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিসার এবং শাহবাজপুর ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার মো. আমজাদ হোসেন জানান, নিয়ম অনুযায়ী তিনি ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড তৈরি ও বিতরণ কমিটির সভাপতি হলেও তাকে না জানিয়েই অনেক কিছু করা হয়েছে। ফলে অনিয়ম ও দুর্নীতি হওয়াটা স্বাভাবিক। এদিকে মনাকষা ইউনিয়নে কার্ড তৈরিতে ‘ডিজিটাল কায়দায়’ অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কার্ডের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে ৯টি ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বারসহ ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৭২০টি কার্ড অর্থাৎ ৬০টি করে কার্ড ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।চুরির চাল জব্দ : কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, তাড়াইলে ১০ টাকা কেজির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ২১ বস্তা চাল জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে আদালত কাউকে আটক করতে পারেনি। শনিবার সন্ধ্যার দিকে তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নের তেউরিয়া গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে চালগুলো জব্দ করা হয়। তাড়াইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুলতানা আক্তার জানান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ক্রেতারা চালগুলো কিনে বিক্রি করেছেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এগুলো জব্দ করা হয়। এখন নিলামে এ চাল বিক্রি করে সরকারি খাতে টাকা জমা করা হবে।