শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

খু্ড়িয়ে চলছে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়

আকতারুজ্জামান ও মাহবুব মমতাজী

আলো-বাতাসহীন শ্রেণিকক্ষ, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট, খেলার মাঠ ও অবকাঠামো সংকট, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকা— এ ধরনের নানা সমস্যায় জর্জরিত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো। এক বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে অন্য বিষয়ে ক্লাস নেওয়া, লাইব্রেরিয়ান না থাকা— এসব সমস্যাও এ বিদ্যালয়গুলোয় প্রকট। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এমন অবস্থা রাজধানী ও সারা দেশে। অন্যসব সমস্যার পাশাপাশি ঢাকার সরকারি উচ্চমাধ্যমিক অনেক বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীর অভাবও রয়েছে বলে জানা গেছে। সমস্যার অত্যধিক ভারে খুঁড়িয়েই চলছে এসব বিদ্যালয়। সম্প্রতি জাতীয়করণসহ রাজধানীতে সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৪৪টি। এর মধ্যে পুরনো ২৫টিতে ৪৭৬ জন শিক্ষক একই প্রতিষ্ঠানে আছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে ৩৭ জন শিক্ষক টানা ২৭ বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে কর্মরত। আর ১৫ জন শিক্ষক ২৬ বছর ধরে রয়েছেন একই বিদ্যালয়ে। ১১৯ জন শিক্ষক ১৮ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। বাকি ৩০৫ জন শিক্ষক ১০ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত কর্মরত রয়েছেন। গত বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর রাজধানীর পুরনো ২৫টি সরকারি বিদ্যালয়ে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা শিক্ষকদের একটি তালিকা তৈরি করে। সেখানেই ৩৭ জন শিক্ষকের সর্বোচ্চ ২৭ বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে থাকার প্রমাণ পায়।

জানা যায়, ঢাকার হাতে গোনা নামকরা বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকরা থাকছেন বছরের পর বছর। ওইসব বিদ্যালয়েই সন্তানদের ভর্তি করাতে রীতিমতো যুদ্ধ করেন অভিভাবকরা। আর বাকি সব বিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর হার তুলনামুলক কম। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের দুটি বহুতল ভবন শতাধিক বছরের পুরনো হওয়ায় সেগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। ফলে বিদ্যালয়টিতে শ্রেণিকক্ষ সংকটের পাশাপাশি শিক্ষক, শিক্ষার্থীর অভাব। এর একটি ফটক আশপাশের বাসিন্দাদের ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রহিমান আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সারা দেশের মতোই ঢাকার বিদ্যালয়গুলোও দুর্দশাগ্রস্ত। তার বিদ্যালয়টিতে কয়েক বছর ধরে পাঁচজন শিক্ষকের পদ শূন্য। তবে তুলনামূলকভাবে বিদ্যালয়টি ভালো চলছে। সরেজমিন দেখা যায়, পুরান ঢাকার ইসলামিয়া সরকারি মুসলিম উচ্চবিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ শিক্ষার্থী। এর জন্য সরকারি কবি নজরুল কলেজের পূর্ব-উত্তর পাশের একটি ভবনে আটটি কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া আছে। ওই কক্ষগুলোয় দুই শিফটে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া হয়। ফলে শ্রেণিসংকটের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের। বলতে গেলে বিদ্যালয়টির নিজস্ব সত্তা বলে কিছুই নেই। কবি নজরুল কলেজ ঘিরে আছে চারদিকে। নেই বিদ্যালয়ের নিজস্ব খেলার মাঠ। আর এখানে যে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে, তা অনেকেই জানে না। আলো-বাতাসহীন শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুৎ না থাকলে পাঠদান সম্ভব হয় না। জানা যায়, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, নারিন্দা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, টিকাটুলি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, গভর্নমেন্ট মুসলিম স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, জুরাইন শেখ কামাল সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও উত্তরখান সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে আগ্রহী হয় না। গড়ে এসব বিদ্যালয়ে ২ হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদানের সক্ষমতা থাকলেও ভর্তি হয় ৯০০ থেকে ১২০০ শিক্ষার্থী। এখন পুরান ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মানে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়েছে। অথচ একসময় ইসলামিয়া সরকারি মুসলিম হাইস্কুল, মুসলিম গভর্নমেন্ট হাইস্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও বাংলাবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বেশ সুনাম ছিল। এগুলোয় এখন বিদ্যুৎ, শ্রেণিকক্ষ ও অবকাঠামোগত সংকট প্রকট। কয়েকজন শিক্ষকের দাবি, শিক্ষার্থীর অনেকেই নতুন ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে চলে যায়। একশ্রেণির অভিভাবক বিত্তবান, তারা সন্তানদের নতুন ঢাকার নামকরা বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও হাজারীবাগ শহীদ শেখ রাসেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইনছান আলী বলেন, এই শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি বিদ্যমান শিক্ষকরা টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। এ সমস্যা সমাধান করলে শিক্ষকরা পাঠদানে আরও উৎসাহী হবেন, ফলে শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী হবে। নোয়াখালীর হাতিয়া শহর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন। একজন প্রধান শিক্ষক, একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ২৫ জন সহকারী শিক্ষক— মোট ২৭টি শিক্ষক পদ থাকলেও মাত্র দুজন সহকারী শিক্ষক এখানে কর্মরত। প্রায় দুই বছর ধরে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের এমন সংকটাবস্থা চলছে। মাত্র দুজন নিয়মিত শিক্ষক নিয়ে কোনোমতে বিদ্যালয়টি চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক না থাকায় নামমাত্র পাঠদান সেবা দেওয়া হচ্ছে ছাত্রীদের। অভিভাবকরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এই বিদ্যালয় থেকে। আর অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। কারণ, বিদ্যালয়ের ফলও কাঙ্ক্ষিত মানের হচ্ছে না বলে জানা গেছে। শুধু নোয়াখালীর হাতিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় নয়, দেশের অনেক সরকারি উচ্চবিদ্যালয় শিক্ষক সংকটে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। ছাত্রছাত্রীরাও কাঙ্ক্ষিত মানের পাঠদান সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা দেওয়ার পর নিয়োগবিধি সংশোধনের কারণে ২০১২ সাল থেকে সরকারি মাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। এর ফলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে কারগিল সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে ১৭টি শিক্ষক পদ থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৪ জন। শিক্ষক সংকটে পাঠদান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ বিদ্যালয়ের। ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে রোকনউদ্দিন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ১১টি শিক্ষক পদ থাকলেও ছয়টি পদ শূন্য। ফরিদপুরের কামারখালী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। এখানে ১১টি শিক্ষক পদ থাকলেও ছয়টি পদ শূন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজধানীর বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জালাল উদ্দিন সরকার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে সরকারি মাধ্যমিকে ব্যাপকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাজধানীর বিদ্যালয়গুলোতেও রয়েছে শিক্ষকস্বল্পতা। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক সংকট প্রকট। অবিলম্বে এ অবস্থা কাটাতে উদ্যোগ নিতে হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর সূত্রমতে, সারা দেশে সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৪৩টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ রয়েছে ১০ হাজার ৩৬১টি। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোয় কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৮ হাজার ৮৭ জন শিক্ষক। বাকি ২ হাজার ২৭৪ জন শিক্ষকের পদই শূন্য। কয়েক দফায় সম্প্রতি জাতীয়করণ করা বিদ্যালয় মিলে সরকারি উচ্চমাধ্যমিকের সংখ্যা বর্তমানে ৪০৩টি বলে জানা গেছে। মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনেক সরকারি মাধ্যমিকে শিক্ষকস্বল্পতা অস্বীকার করার মতো নয়। কিছু বিদ্যালয়ে একেবারেই কমসংখ্যক শিক্ষক রয়েছে। এরা বিদ্যালয় চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তবে মাঝেমধ্যেই সারা দেশে বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকের শূন্যপদে সমন্বয় করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ পদে নিয়োগ বন্ধ থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর