মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

হতভাগা বাদল দিল্লির জেল থেকে শিগগিরই বাংলাদেশে ফিরছেন

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিচারাধীন বা দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী দিল্লির তিহার জেলে সাজা ভোগরত বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজিকে তার নিজ দেশের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ডাকাতি ও খুনের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন বাদল। বয়স ও প্রোফাইল (কারাগারে থাকাকালে তার সংযত ও ভালো ব্যবহার) দেখেই তাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব অনুমোদন করে ভারত। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই স্বদেশে ফেরত যেতে চলেছেন বাদল ফারাজি। গত ১ জুন দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের দুজন পুলিশ এসকর্ট কর্মকর্তাকে ভারতে এসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে কারাগার থেকে ফরাজিকে নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কলকাতা প্রতিনিধিকে ১৩ জুন ফোনে এ খবর জানান সমাজকর্মী রাহুল কাপুর। বাদলকে দ্রুত কারাগারমুক্ত করতে দুই বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই রাহুল। এদিন সকালেই তিহার কারাগারে বাদল ফরাজির সঙ্গে দেখা করতে যান রাহুল কাপুর। সেখানে তিনি বাদলকে তার দেশে পাঠানোর বিষয়টি জানান। রাহুল কাপুরকে উচ্ছ্বসিত বাদল বলেন, ‘আমি খুবই খুশি। দেশে গিয়ে আমি আমার মাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই। ১০ বছর পর দেশে ফিরে যাচ্ছি। ইতিমধ্যেই জামাকাপড়, বই, সার্টিফিকেটসসহ অন্য জিনিস গোছানোর কাজ শুরু করে দিয়েছি। বাংলাদেশে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে যাতে থাকতে পারি, সেজন্য আমার সাজার বাকি মেয়াদ ক্ষমা করে দেওয়া হবে বলে আশা করি।’

ভারতের কারাগার থেকে ছেলের মুক্তি পাওয়ার খবরে খুশি মা সরাফালি বেগম। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন সমাজকর্মী রাহুল কাপুর। সরাফালি বলেন, ‘ছেলের জন্য প্রতিদিনই আমার চোখ পানিতে ভরে ওঠে। আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে আসবে— সেই অপেক্ষায় আছি।’

বাদলের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোংলায়। আগ্রায় গিয়ে তাজমহল দেখবেন— এ আশায় বাদল ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই ভারতে ঢোকেন। তখন তার বয়স ১৫। পড়তেন পঞ্চম শ্রেণিতে। বন্ধুদের কাছে শুনে তাজমহল দেখতে আগ্রহী হন তিনি। লুকিয়ে ভারতে রওনা দেন। কিন্তু বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে পেট্রাপোলে প্রবেশের পরই বিএসএফ তাকে হত্যা মামলার আসামি হিসেবে আটক করে। ২০০৮ সালের মে মাসে দিল্লির ওমর কলোনিতে বৃদ্ধা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে বাদল সিং নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। শুধু নামের মিল থাকায় বাংলাদেশি বাদলকে ওই খুনের মামলায় আটক করা হয়।

দিল্লির সার্কিট আদালত ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। পরে দিল্লি হাই কোর্টও সেই রায় বহাল রাখে। কিন্তু বিনা দোষে এ সাজা কোনোভাবেই মেনে নেননি বাদল। দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় হাই কোর্টের সেই রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাদল। কিন্তু শীর্ষ আদালতও বাদলের আরজি খারিজ করে দেয়। তাই, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারেই কাটাতে হচ্ছে বাদলকে (২৫)।

কারাগারে এক দশক ধরে নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন বাদল। কারাগারে থেকে পড়াশোনা করেই স্নাতক হন তিনি। কারাগার চত্বরে থেকেই ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হন। একটা সময় যে ভাষা সমস্যার কারণে এত বড় শাস্তি পেতে হয়েছিল বাদলকে, আজ তিনিই ইংরেজি বা হিন্দিতে অনর্গল কথা বলছেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট কোর্সও করেছেন বাদল।

বাদল ফরাজির মুক্তির দাবিতে কয়েক মাস ধরেই ভারতজুড়ে র‌্যালি, জমায়েত, মানববন্ধনে শামিল হয় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা রাহুল কাপুর। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কে মাস্টার্স করা রাহুল সামাজিক কাজে ২০১৬ সাল থেকে তিহার জেলে যাতায়াত করছেন। কারাগারের বন্দীদের পুনর্বাসন, তাদের কাউন্সেলিংয়ের কাজ করতে করতেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বাদলের মুখ থেকে সবকিছু শুনে নতুন লড়াই শুরু করে দেন রাহুল।

বাদলের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দেশ ভুলে সম্মিলিতভাবে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার আরজি জানান রাহুল। এতে ভালো সাড়াও মেলে। ইতিমধ্যেই ‘জাস্টিস ফর বাদল’-শীর্ষক ওই পিটিশনে বাদলের মুক্তি চেয়ে ৩ হাজার ৮৫০ জনের মতো মানুষ স্বাক্ষর করে ফেলেছেন। এর পাশাপাশি বাদলের মুক্তির বিষয়ে তিনি যোগাযোগ করেন দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও চিঠি লিখে বাদলের মুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি আনতে উদ্যোগী হন রাহুল। বাদলের পাশে দাঁড়াতে কয়েক মাস ধরেই ফেসবুকেও লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন রাহুল। সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এর পরই গত মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে একটি চিঠি এসে পৌঁছায় রাহুল কাপুরের কাছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিভাগের যুগ্মসচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথনের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বাদলের হস্তান্তরে দুই দেশের উদ্যোগের বিষয়টি জানানো হয়।

সর্বশেষ খবর