সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপে সয়লাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করলে ভুল তথ্য আসে। মানুষের কম ডায়াবেটিসের স্থলে বেশি। আর বেশির স্থলে কম দেখায়। এতে যে কোনো সময় বিপর্যয় হতে পারে। যার ফলে মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি।

গতকাল রাজধানীর জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কার্যালয়ে নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রি প্রতিরোধে আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং অংশীজনদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন অধিদফতরের পরিচালক ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন, ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার মন্ডল, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক, কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী প্রমুখ।

ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছি। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যার একটি বড় অংশ বাসায় ডায়াবেটিস স্ট্রিপ দিয়ে সুগার পরিমাপ করেন। অথচ এই স্ট্রিপই নকল হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। এটা শুনে অনেকের হৃদকম্পন বেড়ে গেছে। ভুল পরিমাপের কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এটা মানুষ হত্যার মতো অপরাধ। চাল ডাল মূল্যবৃদ্ধি থেকেও বড় অপরাধ।

 রোস নামের একটি বড় আন্তর্জাতিক স্ট্রিপ তৈরি করা কোম্পানির প্যাকেট আমাদের নয়াপল্টনে তৈরি হয়। আমরা এমনও প্যাকেট পেয়েছি, যেটার মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেওয়া ২০২৫ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এমন তারিখ তো পৃথিবীতে হওয়া সম্ভব নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল করতে করতে ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখ আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘পণ্যটি যে কোম্পানির নামে বাজারজাত করা হচ্ছে, অর্থাৎ সেই রোশ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তারা ব্যাচ নম্বর দেখে জানায়, এই ব্যাচের স্ট্রিপ তারা উৎপাদন করেনি, বাজারেও ছাড়েনি। এরপর সেই নয়াপল্টনের প্রিন্ট ওয়ান নামের একটি প্রেসে অভিযান চালানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি ফার্মা সল্যুশনসকে মোড়ক সরবরাহ করার পাশাপাশি বাজারজাত করতে সহায়তা করে।

সভায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ফার্মা সল্যুশনসের প্রধান নির্বাহী পল্লব চক্রবর্তী বলেন, ‘কোম্পানির কিছু বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে এটি ঘটেছে। বিক্রয়কর্মীদের নানা ধরনের চাপ থাকে, চাপে পড়ে তারা এটা করেছে। তবে দায় আমাদের নিতে হবে; বাড়তি বলার কিছু নাই। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক বিষয়।’

মোড়ক তৈরি করা প্রতিষ্ঠান ওয়ান প্রিন্টের মালিক লুৎফর রহমান বলেন, ‘ফার্মা সল্যুশনসের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল। তাদের লেনদেন এত ভালো যে মোড়ক ছাপাতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। আমরা দুটি ধাপে প্যাকেট ছেপেছি ১০ থেকে ১১ হাজার টাকার প্রিন্টিং। তবে আমি ২ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছি।

ভোক্তা অধিদফতর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এই স্ট্রিপ আসছে। বিশেষ করে কাপড়ের লটের মধ্যে এসব দেশে আসছে। কাস্টমস পয়েন্টে তার কোনো তদারকি হচ্ছে না। তাদের উচিত হবে, এগুলো ভালোভাবে দেখভাল করা। ওষুধ প্রশাসনেরও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা উচিত; আইনে তাদের ক্ষমতা দেওয়া আছে। আমরা তাদের সহায়তা করব। আমরা যেসব তথ্য পেয়েছি, তা সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সবাইকে লিখিত আকারে জানাব। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া নকল ব্যাচের যেসব ওষুধ বাজারে আছে, তা জব্দ ও প্রত্যাহারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এফবিসিসিআই পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ঘটনাটি সাধারণভাবে চালডালের ভেজালের সঙ্গে মেলালে চলবে না। এটা মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। এর কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ব্যবসায়ীরা যখন এলসি খুলতে পারেনি তখন ব্যাগেজে নিয়ে এসেছে। এ ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী আমদানির জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে কেউ বেআইনি কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির বলেন, নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের কারণে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় ভোক্তা অধিদফতরের এ ধরনের উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ব্যবসায়ীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, তারা যেন কারও প্রাণহানির সহায়ক না হন, এ ধরনের অন্যায় থেকে বিরত থাকেন।

ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক বলেন, ‘ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বা অন্য কোনো ওষুধের বিষয়ে আমাদের জানানো হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনবল না থাকায় মাঠপর্যায়ে কাজ করা যায় না। তবে অভিযোগ এলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে সেই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’

সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মাসিতে নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের সন্ধান পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এর সূত্র ধরে অভিযান চালিয়ে ফার্মা সলিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ সরবরাহের প্রমাণ মেলে। প্রতিষ্ঠানটি এসব স্ট্রিপের প্যাকেট তৈরি করে নয়াপল্টনের প্রিন্ট ওয়ান নামের একটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। তবে ডায়াবেটিসের স্ট্রিপগুলো লাগেজ পার্টির মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা হয় বলে জানা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফার্মা সলিউশনকে সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং প্রিন্ট ওয়ানকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই গতকাল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়।

 

সর্বশেষ খবর