পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক তিনি। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও সবার শীর্ষে সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানিয়া সাম্রাজ্যের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লিও বা হারেম। এটা কেবল সুলতানের মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা গল্প-উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা।
উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। তখন তিনি মানিসার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। অটোমান সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয় অসুস্থতা ইত্যাদি পথ পরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হারেম সংস্কৃতি, তোপকাপি প্রাসাদ, অটোমান প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতাগ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাস কামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে সাধারণ যৌনদাসী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো একাদশ পর্ব।
[পূর্ব প্রকাশের পর]
সুলতানের কক্ষ থেকে এতক্ষণে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ক্রিমিয়ার ওই মেয়েটার।
বসে বসে সেই প্রতীক্ষাই করছিলেন মাহিদেভরান। কিন্তু সারা খাতুন হেঁশেল আর খাস কামরার পাশে ঘুরে এসে জানালেন মেয়েটা তখনো সুলতানের কক্ষেই আছে। শুধু তাই নয়। সুলতান সকালের খাবার সেখানেই গ্রহণ করবেন। দানা হালিলকে দিয়ে দুজনের খাবার চেয়ে পাঠিয়েছেন।
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন মাহিদেভরান। সুলেমানের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সুলতানার দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকল সারা খাতুন। এরপর বলল, ‘মালিকা। এভাবে রাগ করে কী করবেন? চলুন নাস্তা সেরে নিই।’
চোখ গরম করে একবার সারা খাতুনের দিকে আরেকবার টেবিলে রাখা খাবারের দিকে তাকালেন মাহিদেভরান।
মুহৃর্তের মধ্যে চুপসে গেলেন সারা খাতুন।
মাহিদেভরানের দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রু। সারা রাত এতটুকু ঘুমাননি। এখানে বসেই সুলেমানের অপেক্ষায় ছিলেন। ভেবেছিলেন সকালের খাবারটা অন্তত একসঙ্গে খাবেন। কিন্তু কোথায় কী?
সুলেমানতো তার খাস কামরা থেকেই বেরুচ্ছেন না। একবার মনে হয়েছে সেখানে গিয়ে হানা দেবেন। কিন্তু সাহস হলো না মাহিদেভরানের। যদি উল্টো বিরক্ত হন সুলতান! অবশ্য বিরক্ত হওয়ারই কথা। এতে অটোমান প্রাসাদের কঠোর নিয়ম ভেঙে যেত। মুস্তফাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সারা। ওকে মক্তবে পাঠানোর জন্য তৈরি করছে। এই কাজটা সাধারণত মাহিদেভরান নিজেই করেন। কিন্তু আজ মন লাগছে না কিছুতেই।
সবকিছু মিথ্যে লাগছে। অর্থহীন মনে হচ্ছে।
জীবন আসলেই কত বর্ণিল। এই অভিজাত রাজপ্রাসাদের নিচে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির স্ত্রী হওয়ার পরও কত অসহায় মাহিদেভরান!
মুস্তফাকে মক্তবে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে সারা খাতুন। মাহিদেভরান তখনো সেখানে বসে। তার কোলের ওপর ভায়োলিনটা রাখা। রাত থেকেই ওটা সঙ্গে নিয়ে বসে আছেন মাহি। কিন্তু একবারের জন্যও সেটাতে সুর তুলেননি।
সারা খাতুনের নজরে এলো বিষয়টা।
‘একটু বাজাবেন সুলতানা?’
সাহস করে মাহিদেভরানকে বলল সারা। মাহিদেভরান উদাসী চোখে ভায়োলিনটার দিকে তাকালেন একবার।
এই ভায়োলিনটা তার মায়ের দেওয়া। ভায়োলিন বাজানোর ব্যাপারটাও মায়ের কাছ থেকেই শিখেছেন তিনি। অনেক ঘটনা অনেক সময়ের সাক্ষী এই ভায়োলিন। অনেক রাতেই সুলেমানকে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাতেন মাহি। কিন্তু সেই রঙ্গিন দিনগুলো এখন অনেকটাই স্মৃতি হয়ে গেছে। আজকাল আর সুলেমান ভায়োলিন শুনতে চান না। মাহিও তেমন একটা বাজাতে চান না। তবে মাহিদেভরানের মন যখন খুব খারাপ থাকে, তখন এর সুরে নিজেকে ঝালিয়ে নেন। মনের কষ্টগুলো হালকা হয়। কী ভেবে ভায়োলিনটা হাতে তুলে নিলেন মাহিদেভরান। তারপর এতে সুর তুললেন। সুরটা অবশ্যই করুণ। সারা খাতুন নিবিষ্ট মনে বাদ্য শুনছেন। মাহিদেভরান বাজাচ্ছেন আর তার দুচোখ গলে ঝরে পড়ছে কষ্টের অশ্রু।
‘কিসের সুর সুলতান?’
অদ্ভুত একটা রাত কাটিয়ে সুলেমানের সঙ্গে অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছেন আলেকজান্দ্রা। বদলে গেছে তার আচরণও। এখানে আসার আগে কেবল সুলেমানের কাছাকাছি আসার কথাই ভেবেছে। এবার মনে মনে সংকল্প করে ফেলেছে যে করেই হোক সুলতানকে তার জয় করতেই হবে। কিন্তু কাজটা কোনোভাবেই সহজ নয়। কারণ সে কেবল সুলেমানের একজন দাসীমাত্র! তবুও হাল ছাড়ার পাত্র আলেকজান্দ্রা নয়। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে এখানে এসেছে। আবার এখান থেকেই নিজের জীবনে পূর্ণতার আলো ছড়িয়ে দিতে চান।
‘ভায়োলিনের।’
সোজাসাপ্টা উত্তর সুলেমানের।
‘এত সকালে ভায়োলিন কে বাজাচ্ছে?’
সুলতানের কপালের চুল ঠিক করতে করতে আবারও জিজ্ঞেস করলেন আলেকজান্দ্রা।
‘মাহিদেভরান। অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানা। শাহজাদা মুস্তফার মা।’
একটু যেন বিরক্ত হলেন সুলতান। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আলেকজান্দ্রার। তার কাছে কৌতূহলটাই মুখ্য।
‘সুলতান বুঝি স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন?’
এবারের উত্তরটা সঙ্গে সঙ্গে মিলল না। একটু নিশ্চুপ থাকলেন সুলতান। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিলেন,
‘হুমম।’
‘তিনি কেমন মানুষ?’
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না সুলেমান। দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন,
‘সুলতানের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এত কৌতূহল থাকা ঠিক নয় আলেকজান্দ্রা।’
কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন আলেকজান্দ্রা। দ্রুত সুলতানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল সে। সুলতানের হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
‘আমাকে মাফ করবেন সুলতান। আমি বুঝতে পারিনি। এরপর আর এমন হবে না।’
সুলেমান কোনো জবাব দিলেন না। উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। এখান থেকে এক ঝলকে নদী আর রাজ্যের অনেকাংশই দেখা যায়। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই সকালের হিমেল বাতাস ছুঁয়ে গেল।
সুলেমান নিজের খাস কামরায় থাকলেও এই মুহূর্তে মাথার ভিতর রাজ্যের নানা চিন্তা ভর করেছে। অভ্যন্তরীণ নানা জনের নানা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ নতুন সুলতানকে নিয়ে কী ভাবছেন সেটাও জানা দরকার। এরপর রোডসের দিকে এগোতে হবে। হাঙ্গেরির রাজা লুইকে একটা শাস্তি না দিলেই নয়। অটোমানদের সম্মান আর পতাকা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে না পারলে চলবে না।
‘সুলতান কী কিছু ভাবছেন?’
‘হুমম?’
আলেকজান্দ্রার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন সুলেমান।
‘না। তেমন কিছু না। তুমি এখন আসতে পার।’
প্রথামতো সুলতানের কাফতানে চুমু খেয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন আলেকজান্দ্রা। সুলতান তখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। পারগালি ইব্রাহিমকে ডেকে পাঠালেন। তার সঙ্গে আলাপ করা দরকার।
‘হুজুর। আমায় ডেকেছেন?’
‘এসো পারগালি।’
পারগালিকে বারান্দার দিকে আসার ইশারা দিলেন সুলেমান। পারগালি বিনীত ভঙ্গিতে সুলতানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।
‘আশা করি হুজুরের রাতটা ভালোই কেটেছে।’
ইব্রাহিমের বন্ধুসুলভ আচরণে সহজ হয়ে উঠলেন সুলতান। পারগালির পিঠে হাত রেখে বললেন,
‘হুমম। বিষয় এটা নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা।’
‘কি কথা হুজুর?’
পারগালি বেশ আগ্রহভরে জানতে চাইল।
সুলতান একটু সময় নিলেন।
‘দেখ পারগালি সুলতান সেলিম খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছি। দুয়েকটি বড় সিদ্ধান্তও নিয়েছি। কিন্তু আমি জানি না আমার প্রজারা আমার ব্যাপারে কী ধারণা পোষণ করে। আমার আগামী সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার জন্য এটা জানা খুব জরুরি। তোমার কী ধারণা। সবাই কী বলছে।’
‘নির্ভয়ে বলব হুজুর?’
‘অবশ্যই। আমি তোমার কাছে সব সময় সত্যটা আশা করি।’
‘হুজুর এমনিতে নতুন সুলতানের ব্যাপারে সবাই আশাবাদী। আপনাকে সবাই ভালো হিসেবেই জেনেছে। পীরে মেহুমুদ পাশাকে উজিরে আজমের পদে বহাল রাখাটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। একপক্ষ এত খুশি, কারণ তারা মনে করেন পীরে মেহমুদ পাশার অভিজ্ঞতা অটোমান সাম্রাজ্যের জন্য অনেক কাজে দেবে। আবার উঁচু পদে আসীন কেউ কেউ এর পরিবর্তন চেয়েছিলেন। আর আরেকটা কথা।’
বলে একটু থেমে গেলেন পারগালি। সুলেমান ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি হলো পারগালি? থেমে গেলে কেন? বল?’
‘মানে... আরেকটা বিষয়ে সবাই খুব ধাক্কা খেয়েছে।’
‘কোন বিষয়?’
‘আমার বিষয়টা। এখানকার অধিকাংশ লোকেরই ধারণা পারগা থেকে আগত ভিনদেশি একজনকে খাস কামরা প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়াটা আপনার ঠিক হয়নি।’
‘হা হা হা’
ইব্রাহিমের কথা শুনে কয়েক প্রস্থ হেসে নিলেন সুলেমান। তারপর আবারও পারগালির কাঁধে হাত রাখলেন।
‘তোমার কি ধারণা আমি এটা ঠিক করেছি নাকি বেঠিক?’
বুদ্ধিমান ইব্রাহিমও খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন।
‘এটা আপনার মহানুভবতা হুজুর।’
‘না।’
সুলতানের আপত্তি শুনে চোখ কপালে উঠে গেল ইব্রাহিমের।
‘তাহলে?’
‘দেখ এখানকার লোক যেদিক থেকে ভাবছে সেদিক থেকে কিন্তু এরা ঠিকই ভাবছে। কারণ এরা চায় না এদের সুলতানের খাস কামরা প্রধান হিসেবে এমন কেউ থাকুক যাকে এরা চেনে না। কিন্তু তারা জানে না তুমি আমার খাস কামরা প্রধান হওয়ার আগে থেকেই আমার ভাই- আমার বন্ধু। এটা যদি সবার জানা থাকত, তাহলে আর কারও আপত্তি থাকত না।’
সুলেমান যখন কথাগুলো বলছিলেন, ইব্রাহিমের চোখ তখন টলটল করছিল। মুহূর্তের মধ্যে নিচে ঝুঁকে সুলতানের কাফতানে চুমু খেলেন ইব্রাহিম। সুলতান তাকে টেনে উঠালেন। তারপর জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘আমৃত্যু আমার পাশে থেক ইব্রাহিম। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনেক দূর যেতে চাই।’
‘আমিও সুলতান। আমার প্রতি আপনার এই বিশ্বাস যেন সারা জীবন ধরে রাখতে পারি। আমার রক্তের শেষ বিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি আপনার এবং এই সাম্রাজ্যের গোলামি করে যেতে চাই। নাম ঠিকানাহীন এই আমাকে যে সম্মান আপনি দিয়েছেন, সারা জীবন আমি সেটা ধরে রাখতে চাই।’
‘ইনশাআল্লাহ। আমরা সফল হব।’
বলেই ইব্রাহিমকে নিজের থেকে আলগা করলেন সুলেমান। তারপর বললেন,
‘কিন্তু ইব্রাহিম আমি নিজে আমার প্রজাদের ধারণা সম্পর্কে জানতে চাই।’
‘তাহলে তো আপনাকে তাদের মধ্যে যেতে হবে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে।’
‘প্রয়োজনে তাই হবে।’
‘কিন্তু আপনার নিরাপত্তা? এভাবে জনসাধারণের মধ্যে মেশাটা কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ।’
‘আমি সেই ঝুঁকিতে ভয় পাই না ইব্রাহিম। মানিসায় তুমি আমাকে দেখেছ।’
‘কিন্তু হুজুর এখন আপনি মানিসার গভর্নর নন। এখন আপনি অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকর্তা। এখন চাইলেই আর আগের মতো অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। আপনার ওপর বিদেশি শত্রুদেরও নজর আছে। তাই আপনার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না।’
ইব্রাহিমের বক্তব্য যৌক্তিক মনে হলো সুলতানের। আসলেই তো। এখন অনেক কিছুই পাল্টেছে।
‘তাহলে ছদ্মবেশে যেতে হবে।’
‘জি হুজুর।’
‘দ্রুত ব্যবস্থা কর। আমি আজ বিকালেই বের হতে চাই। তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে।’
‘আচ্ছা।’
‘আমার জন্য সাধারণ পোশাকের ব্যবস্থা কর। আমি অভিজাত কাফতান পরে বাইরে বেরুতে চাই না। আর দুয়েকজন দেহরক্ষী ছাড়া আর কেউ যেন না থাকে। ওদেরকেও ছদ্মবেশে থাকতে বলবে। আর কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই।’
‘আমি সব বুঝতে পেরেছি হুজুর। আর একটা কথা, সকালে বালিদ সুলতান খবর পাঠিয়েছিলেন। আপনাকে একবার দেখা করতে বলেছেন।’
‘এটা এতক্ষণ বলনি কেন?’
‘জরুরি কিছু নয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছে আপনি যখন অবসর পাবেন তখন গেলেই হবে। জরুরি হলে আপনি তখনই আপনার কাছে খবর পৌঁছে দিতাম।’
‘ও আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে। তুমি এখন যাও। সব ব্যবস্থা কর গিয়ে।’
সুলতানের নির্দেশে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল ইব্রাহিম। এবার ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন সুলেমান। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন সেখানে কী যেন একটা চকচক করছে। কাছে গিয়ে বুঝলেন ওটা একটা নূপুর। হয়তো আলেকজান্দ্রার। নূপুরটা তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের অলঙ্কারের বাক্সটার মধ্যে রাখলেন সুলেমান। কবিতা লেখা আর অল্প অল্প অলঙ্কার তৈরি করা সুলেমানের পুরনো শখ। সেই বাক্সেই আলেকজান্দ্রার গয়নাটাকে পুরে রাখলেন। এই নূপুরের মধ্যেও যেন মেয়েটার গন্ধ জড়িয়ে আছে। মেয়েটা বেশ অদ্ভুতই। হারেমের অনেক মেয়েই সুলেমানকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। অনেকভাবে তাদের আকুলতার কথা বলেছে। সুলেমানও অনেকের সঙ্গেই রাতযাপন করেছেন। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতাটা যেন একেবারেই ভিন্ন। এই মেয়েটার মধ্যে একদম ভিন্ন কিছু আছে। সেটা যে কী, ভেবে পায় না সুলেমান। কে জানে আস্তে আস্তে হয়তো সবই টের পাওয়া যাবে।
‘আপনাকে দারুণ লাগছে বালিদ সুলতান।’
একটু আগে গোসল সেরে বেরিয়েছেন বালিদ সুলতান আয়শা হাফসা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন মনজিলা। তার মুখ থেকে প্রশংসাসূচক কথা শুনে একটু হাসলেন তিনি।
‘এই কথাটা গত কয় বছর ধরে বলছ মনজিলা?’
একটু ধন্দে পড়ে গেল মনজিলা। সত্যিই তো! কতদিন ধরে এমন কথা বলে যাচ্ছে সে!
‘দশ-পনেরো বছর তো হবেই!’
‘এই কবছরে আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। আমার ছেলে এখন অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান। আর তুমি এখনো আমায় বলছ আমায় নাকি বেশ লাগছে। হাসালে!’
হাসতে হাসতেই মনজিলাকে বললেন আয়শা। মনজিলা তবু তার মতোই।
‘আপনি যাই বলেন। আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি। সত্যি আপনাকে অন্যরকম লাগছে। আর আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন এটা কে বলেছে? এখনো আপনি যে সুন্দরী তা যে কোনো তরুণীর ঈর্ষার কারণ!’
আয়শা জানেন মনজিলার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে লাভ নেই। ভালোবাসার পুরোটা দিয়ে সে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে বালিদ সুলতান সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। কাজেই আর কথা বাড়ালেন না।
‘প্রাসাদের খোঁজ বল। কার কি অবস্থা। কোথায় কি হচ্ছে?’
‘খবর ভালো আবার ভালো না।’
‘কি রকম? কোনো খারাপ খবর আছে?’
একটু যেন আতঙ্কিত দেখাল আয়েশাকে। স্বামী সেলিম খানের মৃত্যুর পর থেকে যথেষ্ট কঠোর এবং নিয়ন্ত্রিত থাকার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু সব সময় কী আর নিজের সঙ্গে নিজের অভিনয় চলে? কখনো না কখনো ভিতরের পোড় খাওয়া মানুষটার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। এখন যেমন খারাপ শব্দটা শুনেই মনের ভিতর আবছা আতঙ্ক ভর করল।
‘না... না। ওরকম খারাপ কিছু না। সেরকম কিছু হলে তো আপনাকে জরুরি ভিত্তিতেই জানাতাম।’
‘তাহলে বলো কী খবর?’
‘সুলতান ছদ্মবেশে বাইরে গেছেন। তার সম্পর্কে এবং অটোমান শাসকদের নিয়ে প্রজাদের ধারণা জানতে।’
‘সঙ্গে কে গেছে?’
‘পারগালি ও তিনজন রক্ষী।’
‘এত অল্প রক্ষী?’
বিস্ফোরিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন আয়েশা।
‘কাউকে জানানো হয়নি বালিদ সুলতান। খুব গোপনে এ যাত্রায় গেছেন সুলেমান।’
‘তাহলে তুমি জানলে কী করে?’
‘মাফ করবেন। আমি জেনেছি সুলতানের জন্য সাধারণ পোশাক সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। নইলে বিষয়টি আমিও জানতে পারতাম না।’
‘কিন্তু তাই বলে এমন নিরাপত্তা ছাড়া?’
‘আমি ইব্রাহিমকে বলেছিলাম। কিন্তু ইব্রাহিম বলল এটাই নাকি সুলতানের নির্দেশ। সুলেমান নাকি কোনো আড়ম্বর ছাড়াই বাইরে বেরোতে চেয়েছেন।’
‘হুম। বুঝতে পেরেছি। রাতে কি সুলেমান খাস কামরায় ছিল?’
‘জি। সুলতান ও ঘরেই ছিলেন। খাস কামরা প্রধান ইব্রাহিমের নির্দেশে সুলতানের পছন্দের ক্রিমীয় দাসীকে তার ঘরে পাঠানো হয়েছিল।’
‘ক্রিমীয় দাসী আবার সুলতানের পছন্দের হলো কবে থেকে?’
‘সুলতান আগেই তাকে পছন্দ করে রেখেছিলেন। দানা হালিল আমাকে এমনটাই জানিয়েছেন।’
‘দানা হালিল এটা জানল কোত্থেকে?’
‘পারগালি ইব্রাহিম নাকি তাকে বলেছেন।’
‘হুমম। এই মেয়েটির দিকে নজর রাখতে হবে। সুলেমান যেন আবার কোনো ভুল না করে বসে।’
‘ঠিক আছে। আরেকটা বিষয় বালিদ সুলতান...’
‘কি? মনজিলা?’
‘মাহিদেভরানের মন-মেজাজ খুব খারাপ। সকাল থেকে কিছুই মুখে তুলেননি।’
‘কেন? আবার কী হলো?’
‘ওই যে, সুলতান খাস কামরায় ছিলেন।’
‘এটা তো নতুন কিছু নয়।’
‘তা ঠিক। কিন্তু সুলতানা ভেবেছিলেন সকালের নাস্তাটা অন্তত সুলতানের সঙ্গে করবেন। কিন্তু সেটা হয়নি।’
‘কেন? সুলেমান ফেরেনি।’
‘জি না। তিনি ওই দাসীটার সঙ্গে খাস কামরাতেই নাস্তা সেরেছেন।’
‘কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই তো ওখান থেকে মেয়েটার বেরিয়ে যাওয়ার কথা।’
‘সুলতানের ইচ্ছাতেই নাকি সে ওখানে ছিল।’
‘কিন্তু এটা তো আমাদের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। এভাবে চলতে থাকলে তো সুলেমানকে নিরাপদে রাখা যাবে না মনজিলা।’
‘আমারও তাই ধারণা। আপনি একটু সুলতানকে বোঝাবেন। আপনার কথা তিনি কোনোভাবেই ফেলতে পারবেন না। সুলেমান আপনাকে অনেক ভালোবাসেন। অনেক মানেনও।’
‘সে না হয় আমি বললাম মনজিলা। কিন্তু এসব ব্যাপার তো বলে-কয়ে শেখানো যায় না মনজিলা। এসব ব্যাপার বুঝতে হয়। একজন অটোমান সুলতান হিসেবে কীভাবে চলতে হবে, কখন কোথায় কার সঙ্গে কতটুকু মিশতে হবে সেই শিক্ষা সুলেমানকে আমি নিজে দিয়েছি। এখন সিংহাসনে আরোহণের পর সে যদি এসব শিক্ষা ভুলে বসে থাকে তাহলে তো আমাদের জন্য ভীষণ বিপদ হবে।’
‘তারপরও আমার মনে হয় আপনি একটু বুঝিয়ে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘এখন সেটাই করতে হবে। কিন্তু মাহিদেভরান এভাবে পাগলামি করছে কেন? তাকে আমি এত বুঝালাম। মানিসায় থাকার সময়ও অনেক বুঝিয়েছি। এখন তো সুলেমান আর গভর্নর নেই। এখন সে অটোমান সুলতান। তার ব্যস্ততা বাড়বে, জীবন-যাত্রা পাল্টে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।’
‘আসলে সুলতানা এখনো সেগুলো বুঝে উঠতে পারেননি। কাঁচা মন। তাই কষ্ট পাচ্ছে।’
‘আমার হয়েছে বিপদ। সব সামলাতে হবে।’
বালিদ সুলতান আয়েশা হাফসার কপালে চিন্তার রেখা দেখা গেল। এমনিতে তিনি ভীষণ দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু তবুও পুত্র কিংবা পুত্রবধূর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার কিংবা পুত্রের সাম্রাজ্য সামলানোর মাঝখানে তিনি কতটুকু সুবিধে করতে পারবেন সেটাই তাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। ভাবনার ফলাপল যাই হোক না কেন আয়েশা জানেন সব মেনেই তাকে বাঁচতে হবে। এদের নিয়েই চলতে হবে।
‘আমি বলেছিলাম আমি মুরগির ঝোল তরকারি খাব না। এরপরও কেন এটা আমার সামনে?’
অনেকটা চিৎকার করে উঠলেন সুলতান সুলেমানের বোন হেতিজা সুলতান। এমনিতে তিনি বেশ নম্র-ভদ্র-সাধারণ। কিন্তু মেজাজ বিগড়ে গেলে তাকে মানানো বেশ কঠিন। তবে গত বেশ কিছুদিন ধরে বিশেষ করে তার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে অনেকটাই পাল্টে গেছেন হেতিজা। সহজ-সরল মুখের মাঝখান থেকে সেই হাসিটা কোথায় যেন উবে গেছে। কথায় কথায় রেগে যান। কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেন না। একা একা থাকেন। সারাক্ষণের সঙ্গী হ্যারিনার সঙ্গেও যখন-তখন খারাপ ব্যবহার করে বসেন। নিজেকে খুব একা লাগে হেতিজার। কিন্তু কিছু করার নেই। হেতিজার কক্ষে শব্দ শুনে এদিকে ছুটে এসেছেন মাহিদেভরান।
ঘটনার বিবরণ শুনে হ্যারিনাকে একটু ঝেড়ে দিলেন। তারপর হেতিজাকেও বুঝিয়ে বললেন। মায়ের পেছন পেছন ততক্ষণে সেখানে ছুটে এসেছে শাহজাদা মুস্তফা। এসেই ‘ফুপি... ফুপি...’
বলে হেতিজার কোলে ওপর বসে পড়ল। এই একটা জায়গায় হেতিজা বেশ দুর্বল। মুস্তফাকে অসম্ভব আদর করেন হেতিজা। মাহিদেভরানের পর মুস্তফার বেশিরভাগ সময় কাটে মুস্তফার সঙ্গেই।
হেতিজার মেজাজ খারাপ থাকায় তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন মাহিদেভরান। আর সেই সময় মুস্তফা আসায় বিরক্ত হলেন মাহি।
‘মুস্তফা, দুষ্টুমি করও না। ফুপির মেজাজ খারাপ।’
মুস্তফা কী বুঝল কে জানে? টুক করে বলে দিল
‘আম্মু... তুমিও তো একটু আগে কাঁদছিলে। ফুপিতো আর কাঁদছে না।’
মুস্তফার কথা শুনে মাহিদেভরানের দিকে তাকালেন হেতিজা। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিলেন মাহিদেভরান।
‘দুষ্টুমি করতে নিষেধ করেছি মুস্তফা। নইলে কিন্তু খারাপ হবে।’
‘ভাবী কী হয়েছে?’
হেতিজা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন মাহিদেভরানকে। মাহিদেভরান নিশ্চুপ। চোখ টলটল করছে। হেতিজা যা বোঝার নিজে থেকেই বুঝে নিলেন।
‘এভাবে মন খারাপ করলে চলবে কেন? তুমিতো এখন আর সাধারণ কোনো স্ত্রী নও, তুমি অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকর্তা সুলতান সুলেমানের স্ত্রী। তোমাকে এত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মন খারাপ করা ঠিক হবে না।’
‘আমি কী করব? আমি কি এই সুলেমানকে চেয়েছিলাম হেতিজা? আমি সুলতানা হতে চাই না। আমি সুলেমানের স্ত্রী হয়েই থাকতে চাই।’
‘এভাবে বল না। আমরা নিরুপায় এর সবই যে নিয়ম। আমরা কেউই এই নিয়মের বাইরে নই।’
‘আমি আর পারছি না হেতিজা।’
‘পারতে হবে। না পেরে উপায় নেই।’
মুস্তফা এগিয়ে এসে মায়ের চোখের পানি মুছে দিল।
‘কাঁদছ কেন মা?’
‘এমনি।’
বলে মুস্তফাকে জড়িয়ে ধরলেন মাহিদেভরান। শাহজাদা মুস্তফাই এখন তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন।
চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার