১৩ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:২২

শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের পরশমণি

গোলাম মাওলা রনি

শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের পরশমণি

মানুষ সাধারণত দুই ধরনের অতৃপ্তিতে ভোগে। কোনো কোনো মানুষের জীবনে অতিরিক্ত প্রাপ্তি তার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে জীবনের নানা অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে কেউ কেউ কবি কণ্ঠে গেয়ে ওঠে জনমদুখী কপাল পোড়া গুরু আমি একজনা। এই দুই শ্রেণির মানুষের হেদায়েতের জন্য পবিত্র আল কোরআনের সূরা আর রাহমানের মতো উত্তম নেয়ামত জমিনে দ্বিতীয়টি নেই।  তাবৎ দুনিয়ার বেশির ভাগ মুসলমান সূরাটি নিয়মিত পড়েন এবং এটির তেলাওয়াত শোনেন তার চেয়েও অধিক পরিমাণে। কিন্তু সূরাটির তাফসির কিংবা অন্তর্নিহিত ভাবগাম্ভীর্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ। এই সূরার প্রথম ১৩ আয়াতের তাৎপর্য কেউ যদি অনুধাবন করার চেষ্টা করেন তবে আশা করা যায় যে, দুনিয়ার প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি সংক্রান্ত কষ্ট কিংবা হতাশা কোনো দিন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

সূরা আর রাহমানের প্রথম ১৩ আয়াতের আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে নিই কেন আমি চলমান সময়ের উত্তপ্ত এবং চাপা উত্তেজনাকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাদ দিয়ে আল কোরআনের একটি বহুল পঠিত সূরা নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়লাম? ঘটনার শুরুটা হয়েছিল গত চার-পাঁচ দিন আগে। আমার এক বন্ধু রাত ঠিক ৯টার সময় তার স্ত্রী-পরিজন নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে এলেন। তার মুখমণ্ডল দেখে আমি অনুমান করলাম যে, তিনি গভীর মনোবেদনায় ছটফট করছেন। ভদ্রলোক হাল আমলে যথেষ্ট ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং গত চার-পাঁচ বছর ধরে সাধ্যমতো দান-খয়রাত এবং সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন। তিনি তার দানগ্রহণকারীদের কৃতজ্ঞতা তো দূরের কথা উল্টো নানামুখী সমালোচনার শিকার হচ্ছেন সাম্প্রতিক সময়গুলোতে।

আমার জানা মতে, বন্ধুটি নিতান্ত ভদ্রলোক এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সৎ। পরিশ্রম করেন এবং হালাল উপার্জনের বিষয়ে সতর্ক থাকেন। ধর্মীয় কাজে অকাতরে দান করেন কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ খুব ঠেকায় না পড়লে আদায় করেন না। মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করেন কিন্তু নিজে কোরআন-হাদিস নিয়মিত পড়েন না। আমি তার কারণগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করলাম এবং নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানবুদ্ধি সহযোগে কিছু কথাবার্তা বললাম। আমার কথাবার্তা শুনে বন্ধু এবং তার স্ত্রী খুবই খুশি হলেন। অন্যদিকে, আমি আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করতে থাকলাম তার এক বান্দার মনের কষ্ট লাঘব করার মতো হেকমত আমায় দান করার জন্য। আমাদের সে রাতের আলোচনার কিছু অংশই আজকের শিরোনামের বিষয়বস্তু।

আমি বন্ধুটিকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কেন দান-খয়রাত করছেন এবং সৎপথে থেকে উপার্জনের চেষ্টা করছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য। আমি যখন প্রশ্ন করলাম, দান-খয়রাতের বিষয়ে আল্লাহর হুকুম কি? এটি বান্দার প্রতি কিরূপে পালন করার বিধান করা হয়েছে এবং আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে কোন জিনিসটি আপনার আগে করা উচিত এবং কোনটি পরে? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি কোনো উত্তর করলেন না, বরং জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এমনভাবে তাকালেন যাতে করে আমি নিম্নের কথাগুলো বলার সুযোগ পেলাম।

মুসলমান হিসেবে একজন বান্দার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো আল্লাহর প্রতি ইমান আনা। দুনিয়াতে যেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শপথবাক্য পাঠ করতে হয় তেমনি বান্দা কালেমা উচ্চারণ করে মুসলমান হিসেবে নিজেকে আল্লাহর মনোনীত খলিফা বানিয়ে জমিনে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। সরকারি কাজকর্মে যেমন একটি ম্যানুয়াল থাকে এবং বিধিবদ্ধ সংবিধান থাকে তেমনি মুমিন ও মুত্তাকিদের জীবনেও কতগুলো ম্যানুয়াল এবং সংবিধান রয়েছে। পবিত্র কোরআন হলো সেই সংবিধান এবং রসুল (সা.)-এর জীবনী হলো ম্যানুয়াল। পার্থিব জীবনের কালাকানুন কিংবা দুনিয়ার কোনো যন্ত্রপাতির যে গাইড লাইন থাকে সেমতে প্রত্যেককে ক্রমিক অনুসারে কাজ করতে হয়। সব কর্ম যেমন রাতে করা যায় না তেমনি ১০ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত নিয়মকানুনকে এক নম্বরে এনে কোনো যন্ত্র চালু করা সম্ভব হয় না।

আল্লার বিধানমতে মুমিন-মোত্তাকির প্রথম কর্ম বর্ণিত হয়েছে কোরআনের নাজিলকৃত প্রথম আয়াতের মাধ্যমে। সংকলিত কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরাতে ‘আলাক’ শিরোনামে নাজিলকৃত আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘পড়ুন, আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সূরাটির ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যিনি কলম দ্বারা শিখিয়েছেন এবং মানুষকে শেখালেন তার অজানাকে। কোরআনের নাজিলকৃত প্রথম আয়াতগুলোই হলো বান্দার প্রতি তার মালিকের প্রথম নির্দেশ, যার তাফসিরে বলা যেতে পারে- মানুষকে আল্লাহ সর্বপ্রথম পড়তে বলেছেন। যদি প্রশ্ন করা হয়, কী পড়তে বলেছেন তাহলে বলতে হবে অবশ্য কোরআন পড়তে বলেছেন। কোরআনের কোন অংশের দিকে সর্বপ্রথম দৃষ্টি দিতে হবে সেই উত্তর ও সূরা আলাকের ২ নম্বর ও ৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, যিনি মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং পড়ুন আপনার রব সম্মানিত। ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যিনি কলম দ্বারা শিখিয়েছেন।’

আল্লাহ চান প্রতিটি বান্দা তার নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করুক। কীভাবে আল্লাহ তাকে এক ফোঁটা নাপাক পানি, মায়ের গর্ভ এবং জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করলেন। বান্দা যদি তার আপন জন্মরহস্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারে এবং অর্জিত জ্ঞানের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করতে পারে তাহলে তার পক্ষে আল্লাহকে সম্মান জানানো ছাড়া অন্য কোনো গতি থাকবে না। তার জ্ঞানই তাকে সূরা আলাকের ৩ নম্বর আয়াতের উত্তম লালনকারী বানিয়ে দেবে। মুমিনের পরবর্তী কর্তব্য হলো তার জ্ঞানকে কলমের মাধ্যমে এমনভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখা যাতে করে অন্য বান্দারা খুব সহজে সেই জ্ঞান আয়ত্ত করার সুযোগ লাভ করে। মানুষের জীবনে আল কোরআনের গুরুত্ব এবং নিখিল বিশ্ব ও মহাজগতের অন্যান্য নিদর্শনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সূরা আর রাহমানে আল্লাহ বলেন- (১) করুণাময় (২) শিক্ষা দিলেন কোরআন (৩) সৃষ্টি করলেন মানুষ (৪) শিক্ষা দিলেন কথা বলতে। এই চারটি আয়াতের সারমর্ম যদি ধারাবাহিকভাবে সংযোজন করা হয় তবে বলা যায়- আল্লাহর রাহমান বা করুণাময় নামের যথার্থতা বা সার্থকতা দুনিয়ার কোনো ক্ষমতা, পদ-পদবি, রাজত্ব, সিংহাসন, ধন, সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বা অন্য কোনো চিত্তাকর্ষ নেয়ামত দাতা হিসেবে নয়। যিনি ক্ষমতাবান তিনি হয়তো মনে করেন ক্ষমতাই হলো তার প্রতি প্রদত্ত আল্লাহর সবচেয়ে বড় করুণা। বিত্তবানরা মনে করেন, বিপুল ধনরাশি দ্বারা আল্লাহ তাদের করুণা করেছেন। অন্যদিকে আল্লাহ বলেন, না- ওসব কিছু না। আমার বান্দার প্রতি আমার সবচেয়ে বড় করুণা হলো আল কোরআন। এই সূরার মর্মকথা হলো- মানুষ সৃষ্টির আগে কোরআন সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর মানুষকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা কোরআনের ভাবাদর্শে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারে।

সূরা আর রাহমানের পরবর্তী আয়াতসমূহে আল্লাহ চন্দ্র সূর্যের কর্মকাণ্ড, তারকারাজি এবং প্রকৃতির বৃক্ষমালার আনুগত্য, আকাশমণ্ডলীর ভারসাম্য সম্পর্কে বলেছেন, এরপর বলেছেন মিজান অর্থাৎ তুলাদণ্ড সম্পর্কে যাতে করে মানুষ পরিমাণবোধ, সঠিক ওজন এবং ন্যায়নীতি সম্পর্কে সচেতন থাকে। পরের আয়াতগুলো অর্থাৎ ১০, ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মানুষকে জমিন ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়ে বলছেন- তোমাদের জন্য যে জমিন সৃষ্টি করেছি তাতে সুগন্ধি ফল, খোসাযুক্ত বীজ এবং বৃক্ষ রয়েছে- কাজেই তোমরা রবের কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?

আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা মুমিন মুসলমানের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করে পরের প্রসঙ্গে চলে যাব। মুমিন সর্বপ্রথম নিজেকে জানবে-চিনবে এবং সম্মান ও ইজ্জতসহকারে আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে। এরপর কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিজেদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং চিন্তাচেতনা নিয়ন্ত্রণ করবে পাশাপাশি আল্লাহর নির্দেশিত মত ও পথ অনুসারে রিজিকের সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয় স্তরে গিয়ে মুমিন ইবাদত, বন্দেগি, দান-খয়রাত, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। এসব কাজ করতে গিয়ে তারা সব সময় রসুল (সা.)-এর সুন্নত পালন করবে এবং কোরআনের নির্দেশমালাকে সব সময় মাথার ওপর চাপিয়ে রাখবে।

দান-খয়রাত সম্পর্কে কোরআনের একাধিক জায়গায় বহু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সূরা দুহাতে এতিম-মিসকিনকে ধমক না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সূরা মাউনে লোক দেখানো দানকারী এবং এতিমদের গলাধাক্কা দেওয়া লোকজনের দুর্গতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যারা মিসকিনদের খাবার দেয় না এবং দান-খয়রাত করে না তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। কোরআনের অন্য স্থানে আল্লাহ বলেছেন- ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দারা গরিব-দুঃখী এবং এতিম মিসকিনদের খাওয়া-পরায় এবং সাহায্য করে। তারা এসব কাজের জন্য দানগ্রহণকারীদের খোটা দেয় না। তারা বলে, এই যে তোমাদের খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি এবং সাহায্য করছি এর বিনিময়ে কোনো ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা চাই না। আমাদের এই প্রচেষ্টা কেবল আমাদের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে খুশি করার জন্য।’

আলোচনার এই পর্যায়ে ৩টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা চমৎকার একটি উপসংহারে পৌঁছতে পারব। প্রথমত, ইমান, ফরজ ইবাদত বন্দেগি বাদ দিয়ে এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথ পরিহার করে অন্যভাবে দান-খয়রাত করলে তা কতটুকু লাভজনক হবে? দ্বিতীয়ত, ইমান, জ্ঞানার্জন, ইবাদত-বন্দেগি সবই করা হলো কিন্তু দান-খয়রাত করা হলো না সে ক্ষেত্রে পরিণতি কী হবে? তৃতীয়ত, কিরূপে ইবাদত-বন্দেগি-দান-খয়রাত এবং অন্যান্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ তৃপ্তি, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা লাভ করা যাবে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো- আল্লাহর কাছে বেইমানের দান-খয়রাতের কোনো মূল্য নেই। অর্থনীতির ভাষায় আমরা যেটাকে অনুৎপাদনশীল শ্রম বলি কিংবা নিয়োগকর্তার অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্ম করার চেষ্টা করে তবে যেরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ঠিক তদ্রুপ বেইমানের কর্মকাণ্ড নিষ্ফল হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, যদি কোনো সুস্থ সবল শিক্ষিত মানুষ পুলিশ না হয়েও পুলিশের পোশাক গায়ে দিয়ে গুলিস্তান মোড়ে যায় এবং ট্রাফিক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে সেখানকার দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের তুলনায় অধিক শিক্ষা, সততা এবং একাগ্রতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করে তবে তার জন্য দুটি প্রাপ্য অপেক্ষা করবে। এক. লোকজন তাকে পাগল মনে করবে এবং দাঁত বের করে তার সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা শুরু করবে। দুই. সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লোকটিকে ধরে নিয়ে যাবে এবং প্রথমেই তার গায়ের পোশাক খুলে ফেলবে। এরপর বাকি শাস্তি তো পরের পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। এখন একবার ভাবুন তো সরকারের নিয়োগ এবং কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি ছাড়া একজন মানুষ যেখানে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয় পাগল উপাধি পায়, নতুবা শাস্তির মুখোমুখি হয় সেখানে বিশ্ব রবের অনুমোদিত মত, পথ এবং পদ্ধতির বাইরে বান্দার কর্মকাণ্ডের ফলাফল কী হতে পারে?

দ্বিতীয়ত, সব কিছু আল্লাহর নির্দেশ মতো করা হলো কিন্তু সম্পদ বণ্টন কিংবা দান খয়রাত করা হলো না- সেক্ষেত্রে বান্দার জন্য নির্ধারিত গন্তব্য হলো জাহান্নাম যার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সূরা মাউনে। কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- কিয়ামতের দিন জাহান্নামিদের আজাবের ফেরেশতাগণ জিজ্ঞাসা করবেন- তোমরা জাহান্নামে এসেছো কেন? তারা বলবে দুনিয়াতে আমরা এতিম মিসকিনদের খেতে দিতাম না এবং নামাজ পড়তাম না। আল্লাহর রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো- বেহতর ইসলাম অর্থাৎ উত্তম ইসলাম কি? তিনি বললেন- দেখা হওয়া মাত্র সবাইকে সালাম প্রদান করা এবং মানুষদের খানা-খাওয়াও। এই হাদিসটির প্রথম শর্ত অর্থাৎ সালাম প্রদানের মধ্যেই রয়েছে আমাদের তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর।

মূলত অহঙ্কারমুক্ত বিনয়ী চিত্ত এবং কৃতজ্ঞমনের ইবাদত, বন্দেগি এবং দান-খয়রাত দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে। এ ব্যাপারে হজরত ওমর (রা.)-এর জীবনের একটি উদাহরণ পেশ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে পড়বে। তিনি তখন মুসলিম জাহানের খলিফা। সমসাময়িক দুনিয়ায় তার সমমান তো দূরের কথা তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেন এমন কোনো রাজা-বাদশাহ কিংবা শাহেনশাহ তখন ছিল না। তৎকালীন বিশ্বের দুটি সুপার পাওয়ার যথা রোম সম্রাট এবং পারস্য সম্রাট ইতিমধ্যেই মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। দুনিয়ার ক্ষমতা বাদ দিয়ে যদি ধর্মকর্মের দিকে লক্ষ্য করি তবে দেখা যাবে যে সেখানেও হজরত উমর (রা.) আল্লাহ এবং রসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টির সর্বোচ্চ মাকামে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সম্মানিত আসরায়ে মোবাসসেরাদের একজন যারা কিনা দুনিয়াতে থাকা অবস্থাতেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। এমন একজন মানুষ আল্লাহর ভয়ে কতটা বিনয়ী মনে আল্লাহর সন্তুষ্টির উসিলা খুঁজতেন তা নিম্নের ঘটনাটির মাধ্যমে ইতিহাসের দলিল হয়ে রয়েছে- খলিফার পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে (রা.) এবং হজরত হাসান (রা.) বালক বয়সে মদিনার কোনো এক মাঠে খেলছিলেন। কথায় কথায় তারা উভয়ে বালকসুলভ ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে হজরত হাসান (রা.) খলিফার পুত্রকে উদ্দেশ করে বলেন- তুই হলি আমার চাকর। তোর বাবাও আমার চাকর। চাকরের বাচ্চা চাকর হয়ে আবার বড় বড় কথা...। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কাঁদতে কাঁদতে খলিফার দরবারে হাজির হলেন এবং হজরত হাসান (রা.)-এর বিরুদ্ধে পিতার কাছে নালিশ দিলেন। খলিফা ভরা মসলিসে হজরত হাসান (রা.) কে ডেকে পাঠালেন এবং তিনি এলে সবার সামনে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘আপনি কি আমার পুত্রকে চাকরের বাচ্চা চাকর বলেছেন!’ হজরত হাসান (রা.) উত্তর দিলেন- হ্যাঁ বলেছি। খলিফা পাল্টা প্রশ্ন করলেন- কীভাবে আমি এবং আমার পুত্র আপনার চাকর হলাম? হজরত হাসান পুনরায় উত্তর দিলেন- ‘আপনি আমার নানার চাকর ছিলেন এবং সেই কারণে আমারও চাকর। আর চাকরের ছেলে হিসেবে আপনার ছেলেও আমার চাকর।’

খলিফার দরবারে মজলিসে শুরা অর্থাৎ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণের উপস্থিতিতে উপরোক্ত ঘটনা ঘটছিল। উপস্থিত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় খলিফা হজরত হাসান (রা.)-কে বললেন, আপনি কি লিখে দিতে পারবেন যে, ওমর আপনার নানার চাকর ছিল এবং এই কারণে ওমর এবং তার পুত্র আপনারও চাকর! হজরত হাসান (রা.) বললেন- অবশ্যই পারব।  এই কথা বলে তিনি একটি দলিলে উক্ত কথাগুলো লিখে দিলেন। খলিফা ওমর (রা.) দলিলটি মাথায় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- ইয়া আল্লাহ! আমার সারা জীবনের কোনো আমলই যদি কিয়ামতের দিন তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তবে এই দলিল তোমার কাছে পেশ করব।  আমি যে আল্লাহর রসুল (সা.) এবং তার আহলে বাইতের চাকর ছিলাম এই দলিলের উছিলায় তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।

-লেখক : কলামিস্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর