৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ১১:৫০

সভ্যতার সংকট ও প্রগতির পথ

আবুল কাসেম ফজলুল হক

সভ্যতার সংকট ও প্রগতির পথ

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর বিশ্বব্যবস্থা যে রূপ নিয়েছে তা নিয়ে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে কায়েমি-স্বার্থবাদীরা অত্যন্ত আশাবাদী। কায়েমি-স্বার্থবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসকবর্গের মধ্যে মতের ঐক্য আছে। কথিত উদার গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ ইত্যাদি নিয়ে তাদের মধ্যে প্রখর কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে বৃহত্ শক্তিবর্গের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও স্বার্থগত বিরোধ আছে। প্রচারমাধ্যমে পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকটি কেন্দ্র বেশ স্পষ্ট। যেমন— ওয়াশিংটন, মস্কো, বেইজিং, দিল্লি, তেহরান ও পিয়ংইংয়ের কথাও উল্লেখ করা যায়। বলাই বাহুল্য, সবার শক্তি সমান নয়।

রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতিতেও বৈচিত্র্য আছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি রাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার দিক দিয়ে দৃষ্টিগোচর স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাকেন্দ্রের দিক দিয়ে পৃথিবীকে বহুকেন্দ্রিক বলা যায় না। অবশ্য সম্প্রতি ওয়াশিংটন ও মস্কোকে প্রতিদ্বন্দ্বী কেন্দ্র মনে হচ্ছে। তবে মস্কো মানবজাতির জন্য কোনো আদর্শ বা কর্মসূচি অবলম্বন করছে না। মস্কো, বেইজিং, দিল্লি কোনোটা কোনোটার প্রতি আনুগত্যশীল কিংবা শ্রদ্ধাশীল নয়। তাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা আছে। কানাডা, লন্ডন, সিডনি ও টোকিওকে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ অনুসারী। ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী ও অনুগত।

যুক্তরাষ্ট্র মুক্তবাজার অর্থনীতি, উদার গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ ও বিশ্বায়ন অবলম্বন করে চলছে। বলা যায়, এসব নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের ঠিক পরে প্রকাশিত ফুকুয়ামার The End of History, হান্টিংটনের The Clash of civilizations, ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসাবিষয়ক দু-তিনটি গ্রন্থ ইত্যাদিতেও মানবজাতির ভবিষ্যত্ নিয়ে বিধৃত আছে ওয়াশিংটনের কর্মনীতি ও আদর্শ। মস্কো, বেইজিং, দিল্লি, তেহরান কারোরই বহুব্যাপ্ত ও সুদূরপ্রসারী কোনো কর্মনীতি ও আদর্শ নেই। দিল্লি ওয়াশিংটনের বলয়ের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। দিল্লির তুলনায় মস্কো ও বেইজিংয়ের স্বাধীন আত্মবিকাশের ও বড় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে গিয়ে স্বাধীন আত্মবিকাশের সুযোগ হারিয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রতিপত্তির মধ্যে ঘটে চলছে যুদ্ধের পর যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রই সর্বত্র আগ্রাসী যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বসনিয়া, হার্জেগোবিনা, সার্বিয়ায় গেছে যুদ্ধ, যুদ্ধ গেছে আফগানিস্তানে, ইরাকে লিবিয়ায়, যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। সামরিক আক্রমণের আতঙ্কে আছে মধ্যপ্রাচ্যের সব রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যে আগ্রাসী নীতি নিয়ে যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ চালাচ্ছে তারই প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিয়েছে জঙ্গিবাদী শক্তি। জঙ্গিবাদীরা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ন্যাটোর শোষণ-পীড়ন ও আগ্রাসী যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের দ্বারা এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের নাগরিককে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত বিশ্বায়নের কর্মনীতি ও কার্যক্রম কায়েমি-স্বার্থবাদী গণবিরোধী-সভ্যতাবিরোধী। এ তো গেল কায়েমি-স্বার্থবাদীদের দিক, উদারতাবাদীদের দিক, সাম্রাজ্যবাদীদের দিক, বিশ্বায়নবাদীদের দিক। জনগণের দিক থেকেও পরিবর্তিত বাস্তবতার দৃশ্যাবলিকে দেখা যেতে পারে।

বিজ্ঞান প্রযুক্তির ও শ্রমিক-কৃষকদের শ্রমের কল্যাণে উত্পাদন ও সম্পদের দিক দিয়ে মানবজাতি আজ এমন এক অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে যে, সামাজিক ন্যায় বাড়ালে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত ও উন্নত করলে পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষই খেয়ে-পরে সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারবে। উত্পাদন বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে, আরও বেশি উত্পাদন ও সম্পদ সম্ভব। মাথাপিছু গড় আয়, মোট জাতীয় আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। সব রাষ্ট্রেই উচ্চশ্রেণির ও উচ্চ-মধ্যশ্রেণির লোকদের  প্রাচুর্য ও ভোগবিলাস বাড়ছে। তারা চলছে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদকে বিভ্রান্তিকর ও  প্রতারণামূলক রূপ দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রকে উদার গণতন্ত্র নাম দিয়ে নির্বাচনতন্ত্রে পর্যবসিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন ও উদার গণতন্ত্রকে আমরা জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করছি। ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে, অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-জবরদস্তি বাড়ছে, মানুষ মানবিক গুণাবলি হারিয়ে চলছে। প্রাচুর্যময় পৃথিবীতে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও অশান্তি বেড়ে চলছে। মানুষ কষ্টে আছে— খুব কষ্টে আছে। একদিকে চরম ভোগবাদ, অপরদিকে বঞ্চনা। চলমান ধারায় মানবীয় দুর্দশা কমার ও উন্নতির সম্ভাবনা দেখা যায় না।

পৃথিবীর সর্বত্রই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা শিথিল। মানব পরিস্থিতি কষ্টকর-দুঃসহ। জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’— আগের চেয়ে অনেক বেশি সত্য হয়ে সামনে আসছে :

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;

যাদের হূদয়ে কোনো প্রেম নেই— প্রীতি নেই

—করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি

এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা,

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হূদয়।’

কবি আল মাহমুদের একটি কবিতাও এখন অনেকের মুখে খুব শোনা যায় :

এ কেমন অন্ধকার, বঙ্গদেশ উত্থান রহিত

নৈশ্বব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখি বসে না

নদীগুলো দুঃখসময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়

কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্য কোনো শ্যামলতা নেই।

বুঝি না রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের

বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।

গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে

পুনর্জন্ম নেই আর জন্মের বিরুদ্ধে সবাই।

শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা

আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি,

নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না।

আপনার বাংলাদেশ এ-রকম নিষ্ফলা ঠাকুর।

এসব কবিতায় আজকের বাস্তবতার বিস্ময়কর রকম সুন্দর প্রতিফলন আছে। চতুষ্পার্শ্বের এই তো অবস্থা। হাজার পৃষ্ঠা লিখে যা বর্ণনা করা যায় না, দশ/বারো লাইনের কবিতায় একজন কবি তা বিস্ময়কর রকম সুন্দর করে প্রকাশ করেন! বাংলাদেশে আজ সে রকম কবিতা কোথায়? একটা ভালো গান কেউ লিখেছেন গত পঁয়ত্রিশ বছরে? কত গল্প, উপন্যাস। চারদিকে জোয়ার আছে বিনোদনমূলক সাহিত্যের, ব্যবসায়িক সাহিত্যের, জনপ্রিয় সাহিত্যের। প্রগতিমূলক সাহিত্য কোথায়?

মহত্ সাহিত্য ছাড়া নোংরা রাজনীতি নিয়ে জাতি উঠতে পারবে? সত্যের সন্ধানে আলোচনা-সমালোচনা কোথায়? কেবল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে কর্তৃত্ব দখল ও অর্থ-সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে যে বিতর্ক ঝগড়া-ফ্যাসাদ, হিংসা-প্রতিহিংসা, জুলুম-জবরদস্তি, তা দিয়ে তো কস্মিনকালেও যথার্থ কল্যাণকর কিছু হয় না। মানবিক গুণাবলির কেবল পতন ঘটতে থাকলে মানুষ জন্তু-জানোয়ারের পর‌্যায়ে নেমে চললে ক্ষমতাধর দম্ভ আর সম্পদের পাহাড়-পর্বত দিয়ে কী হবে।

পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যাচ্ছে কেবল অপশক্তির ক্ষমতায়ন এবং শুভশক্তির পরাজয়, ক্ষমতাচ্যুতি, অপসৃতি, দুর্গতি। বৈষয়িক প্রাচুর্যের মধ্যে নিদারুণ মানসিক রিক্ততা। এই তো সভ্যতার সংকট। রাজনীতিতে ধর্মের নামে চলছে অধর্ম, গণতন্ত্রের নামে চলছে গণপ্রতারণা, সমাজতন্ত্রের নামে যা কিছু চালানো হচ্ছে তাতে আছে অবাস্তব সব চিন্তা, নির্বুদ্ধিতা, ভণ্ডামি, প্রতারণা। জাতীয়তাবাদের ঘোষণা দিতে দিতে রাজনৈতিক নেতারা চলে যান বৃহত্ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে। প্রগতিপ্রয়াসী কোনো লেখক-সংগঠন বাংলাদেশে নেই। প্রগতিশীল কোনো লেখক কি বাংলাদেশে আছেন।

যদি রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে সর্বজনীন কল্যাণে উন্নতিশীল রাখা হতো, তাহলে তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লবের এই কালে পৃথিবীর সর্বত্র সব রাষ্ট্রে মানুষ খেয়ে-পরে সম্মানজনক জীবনের অধিকারী হতে পারত। যে সম্ভাবনা মানবজাতির সামনে আছে তার বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার আমূল সংস্কার। আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা, অর্থনীতি-রাজনীতি ইত্যাদি সব কিছুর আমূল সংস্কার অপরিহার্য। এসবের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রথমে দরকার নৈতিক জাগরণী ও সঙ্ঘশক্তি। জনগণের সঙ্ঘশক্তি না থাকলে, রাজনৈতিক দল না থাকলে কিছুই করা যাবে না। গণবিরোধী, সুবিধাবাদী দল ও নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের কোনো সুফল হবে না। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর যে অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি সব আদর্শকে বিভ্রান্তিকর রূপে দেখা যাচ্ছে। অনেক কিছুই সেকেলে হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কালের নতুন সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সর্বজনীন গণতন্ত্র  এবং জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণাকে নতুনভাবে উদ্ভাবন করে পৃথিবীর সর্বত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। প্রত্যেক জাতির এবং গোটা মানবজাতির সামনে বিরাট-বিপুল সম্ভাবনা আছে। অভাব আগ্রহের, অভাব নৈতিক শক্তির, অভাব আত্মবিশ্বাসের, অভাব পরিকল্পনা ও কর্মসূচির, অভাব সঙ্ঘশক্তির রাজনৈতিক দলের। সব কিছু অপশক্তির দখলে আছে। অভাব নতুন রেনেসাঁদের। অভাব গণজাগরণের। গণজাগরণ আর হুজুগ এক নয়। গণজাগরণের মধ্যে জনগণের মধ্যকার মহত্ সব মানবীয় গুণাবলির জাগরণ ঘটে। হুজুগ সৃষ্টি করে হীন-স্বার্থান্বেষী লোকেরা। হীন উদ্দেশ্য সফল করে নেওয়ার জন্য তারা প্রচার-প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জনসাধারণকে আন্দোলনে মাতায় এবং নিজেদের হীনস্বার্থ হাসিল করে নেয়। ১৯৮০-র দশক থেকে বাংলাদেশে গণআন্দোলনের নামে সৃষ্টি করা হচ্ছে হুজুগ এবং তাতে রাজনীতি সম্পূর্ণ গণবিরোধী চরিত্র লাভ করেছে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে উন্নত নতুন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য কাজ করতে হবে। কোনো চিন্তা দিয়ে হবে না, চিন্তা ও কাজ দুটোই লাগবে।

পৃথিবীর সর্বত্রই আজকের সভ্যতার সংকটের উপলব্ধি অগভীর। কায়েমি-স্বার্থবাদী প্রচার মাধ্যম এমনভাবে প্রচার চালায় যে, সাধারণ মানুষ কায়েমি-স্বার্থবাদী শক্তির প্রতি নির্ভরশীল মানসিকতা নিয়ে চলে। জনমনে ধারণা বদ্ধমূল করে দেওয়া হয়েছে যে, অন্যায়-অবিচার মেনে নিয়েই চলতে হবে। কায়েমি-স্বার্থবাদীদের বাইরে এমন কোনো নেতৃত্বের উত্থান জনগণ আশা করতে পারে না, যা সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কাজ করবে। এটাই হলো আজকের সভ্যতার সংকটের গভীরতম জায়গা। জনগণের ওপর প্রচারমাধ্যম এখন প্রায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। যে সংকট চলছে তা গতানুগতিক রাজনীতি নিয়ে স্বল্প সময়ে কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমনটা মনে করা ভুল। দীর্ঘস্থায়ী, দূরদর্শী সাধনা ও সংগ্রাম লাগবে।

দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো থেকে উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে, পশ্চিমের দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের মহান সব ভাবধারা আত্মস্থ করতে হবে। এতে তারা শক্তিশালী হওয়ার উপায় বের করতে পারবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তাদের কূটনীতি, গোয়েন্দানীতি, প্রচারনীতি, আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি এবং লগ্নি পুঁজির জালে আটকা পড়লে সর্বনাশ। বাংলাদেশে আমাদের আজ দরকার এমন জ্ঞান, যা জনজীবনের উন্নতিতে কাজে লাগবে— কর্মের অবলম্বন হবে— যা হবে at once a method of enquiry and a mode of action. সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়নতত্ত্ব ও উদার গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে আমাদের স্বাভাবিক উন্নতির ও গণতন্ত্রের সম্ভাবনা নস্যাত্ হয়ে যায়— আমাদের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা বিকৃত হয়। দরকার পরনির্ভর চিন্তা ও কাজ পরিহার করে কর্মনীতি, রাজনীতি, পরিকল্পনা সব বিষয়ে আমাদের নিজেদের চিন্তা— স্বাধীন চিন্তা।

যে সভ্যতার সংকটে মানবজাতি আজ নিপতিত, তা সৃষ্টি হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে। পরে তা ঘনীভূত ও গভীর হয়েছে। মাঝখানে মার্কসবাদ অবলম্বন করে সংকট নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর সে চেষ্টা থেমে গেছে। সে ধারার অগ্রগতি আর সম্ভব নয়।

সর্বজনীন কল্যাণে আজ প্রত্যেক রাষ্ট্রে দরকার জাতি রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য এবং আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠনের চিন্তা। সর্বজনীন কল্যাণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠনে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিতে হবে।

     লেখক : শিক্ষাবিদ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর