৬ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৬:৩৭

সবকটি জানালা খুলে দাওনা

আবু হেনা

সবকটি জানালা খুলে দাওনা

একদিন কচিকাঁচার কেন্দ্রীয় মেলায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাসের ঘটনা নিয়ে শিশুদের আঁকা ছবি দেখে কীভাবে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন তার একটি বিবরণ হাশেম খানের একটি লেখায় ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মাতৃভূমির প্রতি ওদের ভালোবাসা এবং সহজ-সরল মনের সত্য প্রকাশ দেখে তিনি সেদিন সংকল্প নিয়েছিলেন ওদের এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে দেশের বাইরে সারা বিশ্বের মাঝে। এরপর শারীরিকভাবে অসুস্থ শিল্পাচার্য লন্ডনে চিকিত্সার জন্য যাওয়ার সময় ওদের আঁকা সত্তরটি নির্বাচিত ছবি সঙ্গে নিয়ে যান।  এরপর ১৯৭২ সালের ২২ জুন লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা আর হানাদার সেনাদের অত্যাচার ওদের কোমল হূদয়ে যে গভীর রেখাপাত করেছিল, তারই প্রতিফলন হয়েছিল এ ছবিগুলোতে। প্রতিটি ছবির বিষয় থেকে বাইরের জগতের সবাই জানতে পারল এদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অত্যাচারের প্রকৃত রূপটি কত বীভত্স ছিল। বাংলাদেশের শিশুরা সেদিন স্বাধীনতা যুদ্ধকে যেভাবে দেখেছে, উপলব্ধি করেছে, যেসব ঘটনা ওদের মনে দাগ কেটেছে, সহজ সরল মনকে বিচলিত, ভীতসন্ত্রস্ত করেছে, এগুলো তারই ছবি। গ্রামের পর গ্রাম, শহর-বন্দর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে ওরা, নিরীহ মানুষগুলোকে ধরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে, যুবক ছেলেদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে ওই ঘৃণ্য নরপশুরা। এসবই ছিল এসব ছবির প্রতিপাদ্য বিষয়। সেদিন সদ্য স্বাধীন দেশের সহজ সরল কোমলমতি শিশুরা এঁকেছে যুদ্ধ শেষের ছবি, বধ্যভূমির ছবি, কঙ্কালের স্তূপের ছবি।

লেখাটিতে উঠে এসেছে বিশ্ববরেণ্য শিল্পাচার্যের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি লোমহর্ষ চিত্র। বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে জিঞ্জিরায় যখন নরখাদকরা আগুন লাগিয়ে হাজার হাজার মানুষের ওপর গুলি করতে করতে ছুটে চলেছে যখন নিরুপায় মানুষ প্রাণভয়ে ছুটছে তখন একই সারিতে ছুটছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও। ছুটতে ছুটতে তিনি বলছেন, ‘আমাদের সবারই তো এখন একই অবস্থা, শুধু ছুটতে হচ্ছে, পালাতে হচ্ছে। আর না হয় মরতে হচ্ছে।’ পেছনে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ শুনে তিনি সবাইকে বলছেন, ‘থামবেন না, পালান, দৌড়ান।’ শাঁই শাঁই করে অগণিত গুলি যখন কানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে তখন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সবাইকে নিয়ে তিনি রাস্তার পাশের একটি গাছপালায় ঢাকা গোয়ালঘরে ঢুকে পড়লেন। ওখানে একপাল ছাগল চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ওই ছাগলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বসে পড়ে নিজেদের আড়াল করে জীবন বাঁচালেন সবাই। এতে ওদের সহায় হলো গাছপালা আর ছাগলগুলো। এভাবেই এদেশের অবলা প্রাণীরা গাছপালা, নদীনালা, খালবিল, ঝোপঝাড় এ মাটির সন্তানদের আঁকড়ে ধরে বাঁচিয়েছে নরপশুদের হিংস্র থাবার আঘাত থেকে।

এসব অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই অজানা নয়। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা থেকে ফিরছিলাম। এ সময় যুদ্ধকালীন অনেক স্মৃতি মনটাকে বিষাদে ভরিয়ে দিল। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই বিজয়। দীর্ঘ ন’মাস আমি চট্টগ্রাম বন্দর নগরীতেই ছিলাম। চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট, কাস্টমস এবং রেলওয়েতে কর্মরত আমরা বেশ কয়েকজন অফিসার ঠিক করেছিলাম নিজেদের অবস্থান থেকেই আমরা হানাদারদের পদে পদে প্রতিহত করব। আমাদের কাজ ছিল সমুদ্র, রেল, নদীপথে হানাদার বাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা। জাহাজ ডুবিয়ে বন্দর অচল করে দেওয়া যাতে ওরা যুদ্ধসামগ্রী আর সৈন্যসামন্ত আনতে না পারে, আমাদের পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে না পারে। বন্দরে জাহাজডুবির প্রক্রিয়ায় আমি এবং আমার বন্ধু পোর্ট ট্রাস্টের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর হোসেন সরাসরি যুক্ত ছিলাম। আমি তখন কাস্টম হাউস ছেড়ে মমিন রোডে একটি বাসায় থাকতাম। এক দিন সেখান থেকে একটি পোর্টের গাড়িতে ডুবুরিকে জাহাজ ডুবানোর কাজে পাঠিয়ে দেওয়ার পর নূর হোসেন তার পোর্ট ট্রাস্টের বাড়িতে যাওয়ার পথে হানাদারদের হাতে নিহত হয়। নূর হোসেনের আত্মত্যাগের এই স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িত করে। এ সময় পোর্ট ট্রাস্টের প্রধান প্রকৌশলী সামছুজ্জামান, হারবার মাস্টার দস্তগীর, নূর হোসেনসহ শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম সিআরবিতে কর্মরত চিফ প্ল্যানিং অফিসার এম এস সফিসহ তেরশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। অনেককে ওরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওরা আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। ওই সময় নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহে ওদের অনেকে গভীর রাতে আমার স্থানটিকে নিরাপদ ভেবে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। লাহোর ফাইনান্স সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময় আমার সতীর্থ হাফিজ উদ্দিন খানও এভাবে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। মনে পড়ে আয়কর উপদেষ্টা রহমান ভাই আর পরান ভাবীর বাড়িটির কথা। আমরা প্রায়ই সেখানে ছুটির দিনে মিলিত হয়ে একান্ত পরিবেশে সময় কাটাতাম। পরে ওই বাড়িতে হানাদাররা ‘টর্চার চেম্বার’ খুলেছিল। চট্টগ্রামের এসপিসহ অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে ওরা হত্যা করেছিল।

এমন অনেক স্মৃতি এক এক করে স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল তখন। এমন সময় হঠাত্ করেই রাস্তার পাশ থেকে একজন ভারতীয় সেনা অফিসার আমার গাড়ি থামিয়ে বলল, ‘আমার ইউনিট আমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। আমাকে কি ফৌজদারহাট পর্যন্ত এগিয়ে দেবে?’ সেদিন এদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। তাই মনের তাগিদেই সায় দিলাম। কিন্তু ফৌজদারহাটে পৌঁছে তার ইউনিটের সন্ধান মিলল না। তাই এগোতে থাকলাম। এভাবে কথা বলতে বলতে বিলোনিয়া অতিক্রম করে হঠাত্ কখন ভারতীয় সীমানায় আগরতলায় পৌঁছে গেছি বুঝতে পারিনি। এবার ভারতীয় সেনা অফিসার ধন্যবাদ জানালেন আর আমি আমার দায়িত্ব পালন করে অনেক রাতে ঘরে ফিরলাম। সারা পথে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখলাম ধ্বংসলীলা। ওরা যে ট্রেঞ্চগুলোতে থাকত সেগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মেয়েদের শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ ইত্যাদি— যারা ধর্ষিতা হয়েছে, যাদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তাদেরই ব্যবহার্য সমাগ্রী এগুলো। পড়ে আছে খালি মদের বোতল আর সিগারেটের প্যাকেট।

গত ১৭ ডিসেম্বর, ‘দি ডেইলি স্টার’-এ প্রকাশিত ২১টি যুদ্ধকালীন শিশুর ছবিটি দেখে আমার চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে নিজ চোখে দেখা সেই ভয়াবহ দৃশ্য। এ ছবিটি ইসলামপুরের শিশুভবনে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে তোলা। এদের ১৫ জন কানাডার সহূদয় ব্যক্তি দত্তক হিসেবে নিয়ে যায়। আজ ওদের সারা শরীরজুড়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টির পেছনে নিষ্ঠুর বাস্তবতা। কে হিসাব করে বলতে পারবে একাত্তরে এ সময়ে কত নারী ধর্ষিতা হয়েছে, কত ‘অবাঞ্ছিত’ শিশু জন্ম নিয়েছে, কতজনকে হত্যা করা হয়েছে? এ দেশে কি এমন কোনো পরিবার আছে যে পরিবারে অথবা তাদের আপনজনদের মধ্যে একজন শহীদ, ধর্ষিতা অথবা যুদ্ধাহত নেই?

যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে তারা কেউ বিচ্ছিন্ন একক ব্যক্তি নন। এরা কারও সন্তান, কারও পিতা, কারও স্বামী, কারও স্ত্রী, কারও ভাই, কারও বোন, কারও বন্ধু, প্রতিবশী, অভিভাবক অথবা হিতৈষী। এবার হিসাব করুন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অথবা ধর্ষিতা আসলে কতজন। মার্কিন সাংবাদিক এবং লেখক সুসান ব্রাউনমিলারের তিন ধরনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২ থেকে ৪ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে। এর অর্থ চার লাখ সামাজিক ক্ষত যা চার লাখ পরিবারকে সমাজের কাছে হেয়, প্রতিপন্ন করেছে। অর্থাত্ প্রায় ২০ লাখ মানুষ মানমর্যাদা হারিয়ে সমাজে নিগৃহীত হয়েছে। এ বোধশক্তি অবশ্য পাকিস্তানিদের নেই। কারণ ওরা একটি অসভ্য জাতি।

ড. বিনা ডি কোস্টার একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারিভাবে গর্ভপাত কর্মসূচি নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৭৫ হাজার গর্ভপাত বিভিন্নভাবে ঘটানো হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৫ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে— ‘অনেক ধর্ষিতা নারীকে তাদের পিতা-মাতা, স্বামীরা বাইরে বাচ্চার জন্ম দিয়ে খালি হাতে সমাজে ফিরে আসতে বলেছে।’ ১২ মে ১৯৭২ এর আর একটি নিবন্ধে ‘টাইমস’ লিখেছে— ‘বাচ্চাগুলোকে কখনো পানিতে ডুবিয়ে, কখনো অন্যভাবে হত্যা করা হয়েছে।’ এভাবেই অবাঞ্ছিত শিশুদের পরিত্যাগ করেই ধর্ষিতাদের সমাজে ফিরে আসতে হয়েছে। পাকিস্তানিদের যে কোনো বিবেক নেই, পরিবার নেই, সমাজ নেই তার প্রমাণ মেলে হামুদুর রহমান কমিশনের সামনে এদের বক্তব্য বিবৃতি থেকে। কমিশনের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরীফ বলেছেন, ‘জেনারেল গুল হাসান সেনাছাউনি পরিদর্শনের সময় সেনাদের জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কতজন বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করেছ?’ হামুদুর রহমান কমিশন পরিষ্কারভাবে বলেছে, মর্টার ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক ছাত্রাবাস ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ৮ম বেলুচ রেজিমেন্টের সিও কর্নেল আজিজ আহমেদ বলেছে, ‘ব্রিগেডিয়ার আরবাব আমাকে জয়দেবপুরের সব বাড়িঘর ধ্বংস করতে নির্দেশ দিয়েছিল। আমি যথাসম্ভব তা করতে চেষ্টা করেছি।’ ২৭/২৮ মার্চ ১৯৭১, ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের সিও ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ১৭ জন বাঙালি অফিসার এবং ৯১৫ জন বাঙালি সৈনিককে হত্যা করা হয়। মেজর জেনারেল ফরমান আলী কমিশনকে বলেন, ‘জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনারেল নিয়াজি বলেন, রেশনের ঘাটতি সম্বন্ধে আমি কি শুনেছি? এদেশে কি গরু ছাগলের অভাব আছে? এটা একটা শত্রু এলাকা। তোমাদের যা প্রয়োজন তা নিয়ে নিবে। আমরা বার্মাতে একইভাবে সবকিছু নিয়ে নিতাম।’ নিয়াজির নিজের কথাতেই ‘টিক্কা খানের বাহিনীর নির্বিচার হত্যার কারণেই সামরিক বাহিনীর নেতাদের ‘চেঙ্গিস খান’ এবং ‘কসাই’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল।’ পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের মতে, নিয়াজি নিজেই একজন দুর্নীতিবাজ এবং ধর্ষণকারী ছিল। কমিশনের সামনে একটি বিবৃতিতে একজন সেনা কর্মকর্তা বলে, সেনা সদস্যরা প্রায়ই বলত ‘নিয়াজি নিজেই একজন ধর্ষণকারী। সে কেমন করে ওদের ধর্ষণ করতে বারণ করে?’ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কথায় ‘হত্যা, ধর্ষণ, লুট, ধ্বংস, নির্যাতন আর অপমানজনক ব্যবহারের লোমহর্ষ কাহিনী সাধারণভাবেই বিবৃত হয়েছে।’ এ নৃশংসতা আর বর্বরতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিশন সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এরা তো ধর্ষণকারী, হত্যাকারীকে শাস্তি দেয় না, পুরস্কৃত করে। না হলে ১৯৫ জন স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীর আজও বিচার হয়নি কেন? আজও কেন ওরা স্বীকার করে না ওরা কত গুরুতর অপরাধ করেছে?

বাংলাদেশে এই গণহত্যার নীলনকশা তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে যখন নরখাদক ইয়াহিয়া খান লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়িতে বক শিকারে যায়। এরা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বাঙালিদের কিছুতেই সরকার গঠন করে পাকিস্তান শাসন করতে দেওয়া হবে না। জেনারেল নিয়াজি তার ‘দি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে লিখেছে, ‘ভুট্টো সংসদে বিরোধী আসনে বসতে রাজি ছিল না। সে এমন ভাবভঙ্গি দেখাতে শুরু করল যেন সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং অচিরেই সরকার গঠন করতে চলেছে।’ কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তাই ইয়াহিয়া খান ১২ জানুয়ারি, ১৯৭১-এ ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে নিশ্চিত হতে চাইল যে, বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা গ্রহণের পরও সে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবে। বঙ্গবন্ধু তাকে এ নিশ্চয়তা দেননি। ফলে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর অপেক্ষমাণ আলিঙ্গনের কাছে আত্মসমর্পণ করল। এরপর লারকানায় দুই বক শিকারি ‘লারকানা ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করল। এরপর অপারেশন ব্লিজ’ নামের সামরিক অভিযানটির বিস্তারিত পরিকল্পনা হয় ২২ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের একটি বৈঠকে। জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা তার ‘এ স্ট্রেনজার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ বইয়ে লিখেছে, ‘আমি ব্রিগেড কমান্ডারদেরকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় বিশদ পরিকল্পনা তৈরি রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। বস্তুত; এই ‘অপারেশন ব্লিজ’-এর উদ্দেশ্য ছিল দেশে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দিয়ে আবার সামরিক শাসনে প্রত্যাবর্তন করা।’ তাই ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতার অভিনয় চালাতে থাকল। একই সঙ্গে অব্যাহত রইল সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি। যেসব সামরিক কর্মকর্তা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী ছিল তাদের সরিয়ে দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে সিদ্ধহস্তদের স্থলাভিষিক্ত করা হলো। জেনারেল ইয়াকুব গভর্নর এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ড প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। বললেন, ‘তিনি তার পাকিস্তানি ভাইদের হত্যা করতে পারবেন না।’ জেনারেল টিক্কা খান তার স্থলাভিষিক্ত হলো। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবার আলোচনা চালাল। ১৭ মার্চ টিক্কা জেনারেল রাও ফরমান আলী আর খাদেম হোসেন রাজাকে জানিয়ে দিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার কোনো সমঝোতা হয়নি। অতএব ইয়াহিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই দুই জেনারেলের সঙ্গে বসে টিক্কা ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা তৈরি করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাও ফরমান আলী ঢাকায় গণহত্যা চালাবে আর রাজা ঢাকার বাইরে সারা দেশে। একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় কলম্বো হয়ে করাচি চলে গেল। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্যাংক আর কামানের বহর এসে ঘুমন্ত ঢাকা নগরীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাল। যে নিয়াজি টিক্কার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল সে ২৫ মার্চের গণহত্যাকে এভাবে বিবৃত করেছে : ‘জেনারেল টিক্কা খান চরম আঘাত হানল। রাতের প্রশান্তি পর্যবসিত হলো আহাজারি, ক্রন্দন আর অগ্নিসংযোগে। মনে হলো জেনারেল টিক্কা তার সব শক্তি ব্যবহার করে যে অভিযান চালাল তা ছিল চরম শত্রুর ওপর অতর্কিত আক্রমণের শামিল। বিপথগামী অথবা ভুল পথে চালিত নিজের মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া নয়। এই সামরিক হামলা ছিল নিষ্ঠুরতার এক চরম অভিব্যক্তি যা চেঙ্গিস খান, হালাকুর ধ্বংসলীলার চেয়েও অধিকতর নিষ্ঠুর প্রকৃতির যা ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের জালিয়ানওয়ালাবাগকেও হার মানায়।’

হানাদার বাহিনীর একটি ইউনিট কীভাবে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের পথে গোলাগুলি বর্ষণ করেছিল তার একটি বিবরণ ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে বিধৃত হয়েছে : ‘১ এপ্রিল ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে যে ইউনিটটির সঙ্গে আমি সহযাত্রী ছিলাম এটির একটি বিবরণ আমি এখানে দিতে চাই। পথে সবকিছুই এই সেনা ইউনিটের রোষানলে পড়ে। এতে পদাতিক বাহিনীর পেছনে একটি ট্যাংক আর কামানের বহর থেকে গোলাগুলির বর্ষণ অবিরামভাবে চলেছিল। সামান্য ছুঁতা পেলেই অথবা একটু সন্দেহ হলেই পদাতিকরা চারদিকে অজস্র গুলি ছুড়তে ছুড়তে চলেছে। গাছের শাখা-প্রশাখায় একটু দোলা অথবা শুকনো পাতার খড়খড় শব্দ হলেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো গর্জে উঠছে। সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে এ সেনা সদস্যরা পাশের কুঁড়েঘর আর বাঁশঝাড়গুলোতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এভাবে তারা যখন চারদিক ভস্ম করতে করতে চলেছে তখন আগুনের তীব্র দহনে একটি বংশদণ্ড প্রচণ্ড আওয়াজ করে ফেটে গেল। সবাই ধরে নিল কেউ আড়াল থেকে গুলি করেছে। এরপর আর কারও রক্ষা রইল না। সেনাবাহিনী এই পুরো এলাকায় বেষ্টনী দিয়ে লোকালয়টি ঘিরে গাছপালাসহ যত্রতত্র ঘরবাড়িতে সব ধরনের অস্ত্র থেকে গোলাগুলি বর্ষণ করল।’

এটাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্নিসিদ্ধ রক্তাপ্লুত আত্মত্যাগের পশ্চাতে পাক বাহিনীর কাণ্ডজ্ঞানহীন কাপুরুষতার চিত্র যার বিশ্লেষণ আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় চেতনাকে তড়িত্ প্রবাহে তীব্র, তীক্ষ আর প্রবল করে তোলে— সক্রিয় করে তোলে আমাদের আত্মোপলব্ধির প্রক্রিয়াকে। আমরা ভাবতে পারি না স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর দেশবরেণ্য নেত্রী যিনি দুবার পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন, কী ভেবে এমন মন্তব্য করলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।’ তার পরপরই বিএনপি সরকারের এক সময়ের প্রতিমন্ত্রী গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মূঢ় এবং পাকিস্তানিদের অর্থপুষ্ট তাঁবেদার হিসেবে ধিকৃত করে অশালীন এবং চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সব সদস্য এবং সমর্থকদের মর্মাহত করেছে। বিএনপির ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্রে এ কথা স্পষ্ট করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, ‘জাতীয় প্রগতি ও সমৃদ্ধির অগ্রসেনা মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১-এর মহান মুক্তি সংগ্রামের সেনানীরা আমাদের জাতীয় উপলব্ধি ও সংহতির কেন্দ্রীয় উপাদান।’ আজ এসব বক্তব্যে এদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে বিএনপির ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্রকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। বেগম জিয়া ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ ছয় বছর অতিক্রান্ত হয়েছে দলের আর কোনো কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২০০৯-এ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের কার্যকারিতা ২০১২ সালে শেষ হয়ে গেছে। সে কারণে বেগম জিয়া অথবা গয়েশ্বর রায় কারোরই বক্তব্য গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলীয়ভাবে বৈধ নয়। এসব মন্তব্য, বক্তব্য তাদের একান্তই নিজস্ব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নয়। আমরা বিএনপির সৈনিক— শহীদ জিয়ার আদর্শের অনুসারী, বিএনপির গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, ১৯ দফার ধারক-বাহক। বিএনপির ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা নিঃশেষে প্রাণ দিয়েছেন তারা এদেশের গর্বের ধন। মাতৃভূমিতে ওদের স্থান সর্বাগ্রে, সবার উপরে। ওরা মৃত নয়, ওরা মৃত্যুহীন, ওরা চিরঞ্জীব। ওরা আছে ১৬ কোটি মানুষের হূদয়জুড়ে।  ওদের কোনো সংখ্যা নেই, ওরা অজেয়— ওরা শত সহস্র, লক্ষ, অযুত— ওদের গতি সীমাহীন, ওরা অনন্ত। ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর