২০ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৩:০৬

যানজট ও মানুষজট

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

যানজট ও মানুষজট

ঢাকার মানুষ যানজট নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। যানজট নিরসনে কী করা উচিত? নিত্যনতুন পরিকল্পনা— মেট্রোরেল, মনোরেল, সার্কুলার রোড ইত্যাদি। আমার মনে হয় দিন দিন যেভাবে ঢাকা মহানগরীর তথা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ভৌগোলিক পরিসীমার সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অসমানুপাতিক হয়ে পড়ছে। তাতে করে যত কিছুই আমরা করি না কেন, কোনো অবস্থাতেই  যানজট নিরসন করা সম্ভব হবে না। সহনশীল পরিধিতে আনতে রাজধানীর বাইরে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে হবে। অতীতে জেলা, বিভাগ ও সাব-ডিভিশনাল শহরগুলোতে যেসব কর্মকর্তা পদায়িত হতেন তারা সপরিবারে কর্মস্থলে বাস করতেন। যেমন— জেলা জজ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রমুখ। মজার ব্যাপার হলো, এখন একেকটা উপজেলাতেই ১৭টি ক্যাডারের কর্মকর্তা কর্মরত। তাদের মধ্যে প্রায় ২৫-৩০ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। কোনো স্থানে কর্মকর্তার সংখ্যা আরও বেশি। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ৩৩ জন চিকিত্সক পদায়িত আছেন। বর্তমানে দেশে পাঁচ শতাধিক পুলিশ স্টেশন রয়েছে, যেখানে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিদর্শক (তদন্ত) এবং সাব-ইন্সপেক্টররা অনেকেই পরিবার সঙ্গে নিয়ে যান না। তাদের পরিবার-পরিজন থাকেন রাজধানীতে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ তারা অনেক খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করেন। যেগুলো কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

উপজেলা পর্যায়ে সেই ৩০ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে যদি উপজেলাতেই বসবাস করতেন তাহলে তাদের আত্মীয়স্বজন তাদের দেখাশোনার জন্য সেখানেই যেতেন। অর্থাত্ নিত্যনৈমিত্তিক যেসব কাজে জনসাধারণ ঢাকায় আসা-যাওয়া করেন সেটা অনেকাংশেই কমে যেত। আজকাল সাব-ডিভিশন বলে কোনো শব্দ নেই, সেগুলো সবই জেলা হয়ে গেছে। আমি একজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারলাম যে, অধিকাংশ জেলা সদরে মেডিকেল কলেজ আছে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে, বিশ্ববিদ্যালয় আছে, অন্যান্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ইত্যাদি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই সহস্রাধিক প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা জেলা শহরে বসবাস করেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জেলার এসব কর্মকর্তার শতকরা ৫০ ভাগই পরিবার-পরিজন ছাড়া বসবাস করেন। তাদের পরিবারের সদস্যরা থাকেন রাজধানীতে। অর্থাত্ পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তার পরিবার-পরিজন আর তাদের একটি করে গাড়ি যদি ঢাকায় থাকে তাহলে ঢাকার যানজট নিরসন কীভাবে সম্ভব?

অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা পোস্টিং স্থলে কর্মরত থাকলে সেখানে শিক্ষাদীক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি সবকিছুতেই অভাবনীয় উন্নতি হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা শিক্ষা অফিসার এবং একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা পরিচালকরা যদি জেলা শহরেই অবস্থান করতেন এবং তাদের ছেলেমেয়েরা জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করত, তাহলে সেসব স্কুল-কলেজের মান স্বাভাবিকভাবেই আরও উন্নত হতো।

আপনারা নিশ্চয়ই এটা লক্ষ করেছেন যে, আমরা যখন ষাটের দশকে অর্থাত্ ১৯৬৩-১৯৬৮ সময়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করি তখন বার্ষিক ক্রীড়া, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় সাধারণত জেলা প্রশাসক অথবা জেলা জজ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকতেন। এসব জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ৫-১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেও অনেক কিছু শেখা যেত। অপ্রাসঙ্গিক কোনো বক্তব্য তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত হতো না। স্বাভাবিকভাবে সত্-অসত্, ভালো-মন্দ এবং সুন্দর-কুিসতের পার্থক্য, শিক্ষক-ছাত্রের যে সম্পর্ক এ জিনিসগুলো তারা সবার সামনে তুলে ধরতেন। আসলে প্রধান অতিথি সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় চরিত্র গঠনমূলক বক্তব্যই অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করতেন, যা শিশু-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। পুরস্কার বিতরণীর পরদিন ছুটি থাকত। তার পরদিন যখন ক্লাস শুরু হতো তখন প্রত্যেক শিক্ষক ক্লাসে এসে বলতেন— তোমাদের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কী কী বলেছিলেন বলতে পারবে কি কেউ? না বলতে পারলে তিনি নিজে বলতেন আর কথাগুলোর বিষদ ব্যাখ্যা তুলে ধরতেন। স্কুলের কোমল শিশুদের সামনে কোনো প্রধান অতিথি রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করতেন— এটা আমার মনে পড়ে না।

আমি যদি একটি গড় হিসাব দেখাই— জেলা পর্যায়ের দুই সহস্রাধিক কর্মকর্তার অর্ধেকের পরিবার-পরিজন ঢাকায় থাকেন। প্রতি পরিবারে সাহায্যকারী লোকসহ পাঁচজন সদস্য রয়েছে ধরে নিলে ১০০০দ্ধ৬৪দ্ধ৫= তিন লাখ কুড়ি হাজার জন শিশু ও নারী এবং গৃহকর্মী ঢাকার বাইরে বসবাস করতেন। একই সঙ্গে আমি যদি ধরে নিই, এই এক হাজার জন কর্মকর্তার মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ঢাকা শহরে চলাচল করে, তাহলে দেখা যায়, প্রায় ৬৪ হাজার অতিরিক্ত গাড়ি দৈনন্দিন স্কুল এবং অন্যান্য সময় ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। জনগণ এবং স্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের মন-মানসিকতার বিকাশের জন্য সব সরকারি কর্মকর্তার পরিবার-পরিজন জেলা শহরে থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। একজন ডিসি, এসপি, অধ্যক্ষ, উপাচার্যের ছেলেমেয়ে যদি একজন গরিব কৃষক, মুদি দোকানদার বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সন্তানের সঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ গ্রহণ করে তাহলে ওই সাধারণ পরিবারের সন্তানদের মন-মানসিকতার বিকাশও অনেক সুন্দর হতো। থানা লেভেলে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, ৫০০ থানার ২৫০ ওসি, একই সংখ্যক পরিদর্শক (তদন্ত) এবং সমসংখ্যক সাব-ইন্সপেক্টর তাদের পরিবার-পরিজনকে ঢাকায় রেখে নিজেরা থানাতে অবস্থান করেন। ওসি সাহেবের পরেই থাকেন থানার পরিদর্শক (তদন্ত)। প্রায় প্রতিটি থানাতেই চার বা এর কাছাকাছি সংখ্যক এসআই থাকেন। এসব কর্তাব্যক্তি যদি তাদের পরিবার-পরিজনকে কর্মস্থলে নিয়ে যান তাহলে ঢাকা শহর রক্ষা পেত।

স্বল্প বয়সে পরিবারের পৃথক অবস্থানের কারণে স্ত্রী-পুরুষ সবারই পারিবারিক জীবনে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটে। দূরে বসবাসের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। এমনকি এই পরিবারগুলোর সন্তানরাও অনেক সময় মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে ভুল পথে ধাবিত হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রাক্তন কেবিনেট সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, পরবর্তী সপ্তাহে তিনি জেলা প্রশাসক পদায়নের ফিট-লিস্ট তৈরির জন্য উপসচিবদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, জেলা প্রশাসকদের সপরিবারে কর্মস্থলে অবস্থান বাধ্যতামূলক করা যায় কি-না তা ভেবে দেখতে। তিনি বললেন, সপরিবারে কর্মস্থলে অবস্থান করতে ইচ্ছুক কিনা তা প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করা হবে; কেউ আগ্রহী না হলে তাকে তালিকাভুক্ত করা হবে না, এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তা চান। জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এদের চাকরিগত অবস্থানের কারণে সমাজে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই কর্মকর্তাদের সপরিবারে কর্মস্থলে উপস্থিতির ফলে তাদের সন্তানদের সাহচর্য জেলা বা থানা পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সন্তানদেরও সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ লেখাপড়ায় উত্কর্ষতা লাভে অনুপ্রাণিত করবে। থানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে অর্ধেকের চেয়ে বেশি কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা জেলা বা রাজধানীতে থাকেন। প্রতি থানায় গড়ে ৩০ জন কর্মকর্তার অর্ধেক অর্থাত্ ১৫ জনের পরিবার যদি রাজধানীতে থাকেন, তাহলে ত্রিশ হাজার লোক এখানে বসবাস করছেন। এদের সাড়ে সাত হাজার গাড়ি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশে একই সঙ্গে ৮-১০টি মহানগরী গড়ে উঠে। আমরা কিন্তু বিভাগীয় শহরগুলোকে মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। এদিকেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বিভাগীয় শহরগুলো মহানগরী হিসেবে গড়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবেই রাজধানীর ওপর চাপ কমে যাবে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই দেশের প্রত্যেকটি থানাতেই এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো অনেক সচিব, জেনারেল, অধ্যাপক, চিকিত্সক, প্রকৌশলীর জন্ম দিয়েছে। সাফল্য অর্জনকারী সবাই যে জেলা সদর বা রাজধানীর নামকরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন তা কিন্তু সত্যি নয়। বরং রাজধানীতে বসবাসকারী অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েকে আমি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে দেখেছি।

জেলা শহর ও সংলগ্ন স্থানে শিল্পকারখানা গড়ে কর্মসংস্থান করে রাজধানীর ওপর থেকে মানুষের চাপ কমানো যেতে পারে। বিভাগীয় শহরে সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের কার্যক্রম শুরু করা, যাতে করে সাধারণ মানুষকে বাধ্য হয়ে ঢাকা আসতে না হয়। অনেকেই হয়তো মনে করবেন এতে করে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অধিকার হরণ করা হবে। ব্যক্তিগত অধিকার রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় এক্ষেত্রে ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বরং সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার পুরো দেশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন। দেশ তথা জনগণ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানতে পারবেন।  দরিদ্র, সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা তাদের সঙ্গে মিলে নিজেদের আলোকিত করার সুযোগ পাবেন।  সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র যেমন অনেক কিছু দিয়েছে, তেমনি তাদেরও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর