১০ মার্চ, ২০২০ ২০:১৮

মুজিববর্ষে সোনিয়া গান্ধীর আমন্ত্রণ নিয়ে অপপ্রচার!

হাসান ইবনে হামিদ

মুজিববর্ষে সোনিয়া গান্ধীর আমন্ত্রণ নিয়ে অপপ্রচার!

বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গল্পটা বহু পুরোনো। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ভারত। ভারত সরকারের পাশাপাশি ভারতীয় জনগণও বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক অদ্ভূত রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নীতির উপর ভিত্তি করে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নানা সময়ে আমরা পরিবর্তন হতে দেখেছি। এরকম এক অদ্ভুত গোলকধাঁধাতেই কাটছে এ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, যাচ্ছে দিন। 

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যখনি এক সুনির্দিষ্ট মাত্রা নিতে শুরু করে তখনি সর্বত্র ‘গেলো গেলো’ রব উঠে! দু’দেশের প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের কোন সফর বা চুক্তি সম্পাদনের মুহুর্তে সোশাল মিডিয়া ও  গণমাধ্যমে এক শ্রেণীর মানুষের অপপ্রচার শুরু হয়ে যায়। যে কোন সময় যখন দু দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক বা আলোচনা থাকে তখনি শুরু হয়ে যায় অপপ্রচার। আর চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক হলে তো কথাই নেই। ভয়াবহ সব মিথ্যাচার পরিলক্ষিত হয় সোশাল মিডিয়ায়। যে কোন ঠুনকো ইস্যুতেও চলে একের পর এক অপপ্রচার। 

মাঝেমধ্যে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও এসব গুজবের পেছনে দৌড়াতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে খুব পরিকল্পিত উপায়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে যখন ভারত সরকারপ্রধান ও শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আসবেন তখনি এমন এক অহেতুক অপপ্রচার শুরু হলো বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে।

বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে দাবী করা হয়, বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর ঢাকা সফরের জন্য দেওয়া আমন্ত্রণ বাতিল করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তদবির শুরু করেছে। 

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এর আগে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করেছিলেন সোনিয়া গান্ধীকে আমন্ত্রণ না জানাতে। ঐ গণমাধ্যম আরো দাবী করে, গত ২ মার্চ হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন উচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে এক বৈঠকে এই দাবীটি উত্থাপন করে ভারত সরকারের এক প্রতিনিধি। তারা এও জানায়, ভারত সরকার প্রত্যাশা করেছিল সোনিয়া গান্ধীকে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানো হবে না। 

যে বা যারা পরিকল্পিতভাবে এই গুজবটি ছড়াচ্ছেন তাদের চিন্তা অনেক সুদূরপ্রসারী। এই ঘটনায় এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। একদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঝে বাংলাদেশকে টেনে বিভেদ রেখা টেনে দেয়া অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভারতের সরকার এবং ব্যক্তি ইন্দিরা গান্ধীর পরিবারের সম্পর্কেও ছেদ টানা। অথচ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্টোবরে যখন দিল্লী সফরে যান তখন নিজে সোনিয়া গান্ধীকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সোনিয়া গান্ধীও বাংলাদেশে আসবেন ২৬ মার্চ এমনটাই আগে থেকে পরিকল্পনা করা। শেখ হাসিনা একইসাথে রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াংকা গান্ধীকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কেননা এই দুই পরিবারের সম্পর্ক রাজনীতির বন্ধনে আবদ্ধ না বরং অনেকবেশী পারিবারিক ও আন্তরিকতার। অপরদিকে ভারতের সরকারপ্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশ সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ১৭ ও ১৮ মার্চ। 

একইদিনে একইমঞ্চে যে তারা আসবেন বিষয়টা তেমনও না তারপরেও একদল গুজবে লিপ্ত। একটা বিষয় মাথা রাখা উচিত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই দুই দল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী একথা যেমন সত্য আবার নিজ দেশের জাতীয় ইস্যুতে নানাসময় কংগ্রেস-বিজেপি এক সুরেও কথা বলেন। এতো নির্বুদ্ধিতার ছক কষে নিশ্চয়ই ভারত সরকার চলে না যে, ভিন্ন রাষ্ট্রের আমন্ত্রণ কাকে করবে না করবে সেখানে তারা নাক গলাবে! এই কথাটা বোধহয় আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত। প্রত্যেক দেশের স্ব স্ব পররাষ্ট্র নীতি আছে আর এই নীতির ভিত্তিতেই তারা চলে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে অনধিকার চর্চা করার অধিকার বাংলাদেশ যেমন কাউকে দেয়নি আবার নিমন্ত্রণের মতো বিষয় নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করার রাজনীতিও যে বালখিল্য আচরণ তা আশা রাখি স্বাভাবিকভাবে যেকেউ বুঝতে পারে। 

গান্ধী পরিবারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহু পুরোনো। ইন্দিরা গান্ধী নামটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজীবন শ্রদ্ধেয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে নামটি ওতপ্রোতোভাবে জড়িত তা হল শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটির সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বা রাষ্ট্রনায়কদের নামের তালিকায় যাঁর নামটি কৃতজ্ঞচিত্তে বেশি স্মরণ করা হয়, তিনি হলেন ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী নামগুলো খুবই অবিচ্ছেদ্য। 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোট পেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ৷ শপথ গ্রহণের আগেই এই উপমহাদেশের ভয়াবহ গণহত্যা প্রত্যক্ষ করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। রক্তের হোলিখেলার মাঝে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয়নি কোন পক্ষে যাবেন তিনি। একটি উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্যাতিত  জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে গোটা বিশ্বে আমাদের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন তিনি। তাই গান্ধী পরিবার ব্যতিরেকে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী কখনোই যে বাংলাদেশ পালন করবেনা একথা ষড়যন্ত্রকারীরা জানে। আর জানে বলেই, একটা গুজব উত্থাপন করার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির বরাত দিয়ে। 

অবশ্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে গুজব নতুন কিছু নয়। একের পর এক অপপ্রচার এই দুই দেশকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়। সাম্প্রতিক এনআরসি ইস্যুতে সোশাল মিডিয়া এমনকি গণমাধ্যমেও লাগাতার অপপ্রচার দেখছি। আসামের সব লোক নাকি আমাদের দেশে আসছে, সীমান্ত দিয়ে শত শত মানুষ বাংলাদেশে আসার ফেক ভিডিও অনলাইনে দেখা যাচ্ছে। আবার গত বছর দেখলাম রেমিটেন্স সংক্রান্ত এক ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এই মর্মে যে, ভারতের শীর্ষ রেমিটেন্স উৎস বাংলাদেশ। অথচ পরে বেরিয়ে এলো ভিন্ন তথ্য, দ্যা ইকোনোমিক টাইমস ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অফিসিয়াল তথ্যে দেখা গেল, ভারতের শীর্ষ রেমিটেন্স আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। পরবর্তী রাষ্ট্রগুলো যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইংল্যান্ড, ওমান, নেপাল, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া। 

শীর্ষ বিশ রাষ্ট্রের তালিকাতেও বাংলাদেশের নাম নেই। অথচ গুজবের মাধ্যমে তারা রটিয়ে দিলো, ভারতের শীর্ষ রেমিটেন্স উৎস বাংলাদেশ! এছাড়াও বিদ্যুত ও জ্বালানী সংক্রান্ত, বিনিয়োগ ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে হরহামেশাই অপপ্রচার চলতে থাকে। আর নির্বাচন এলে তো কথাই নেই। একের পর এক গুজবে টালমাটাল থাকে গণমাধ্যম। মনে হয় ভারতের সরকার বুঝি বাংলাদেশের নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে! 

রোহিঙ্গা ইস্যুতেও একের পর এক অপপ্রচার ভারতের বিরুদ্ধে হয়েছে। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিলো এমন যেনো, ভারত চাইলেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে পারে কিন্তু করছে না! একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ভারত যেমন বাংলাদেশের আন্তরিক বন্ধু, তেমনি মিয়ানমারের ওপরও ভারতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তবে ভারত চাইলেই তা একদিনে সমাধান করে দেয়া সম্ভব, এই ধারণা পোষণ করা উচিত নয়। 

ভারত তার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়েই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পাশে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেননা সর্বশেষ জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনে ভারত সুস্পষ্টভাবে ‘কফি আনান কমিশন’-এর সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংকটের সমাধান চেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও বার বার ‘কফি আনান কমিশন’ এর সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনেও এই সুপারিশের পক্ষে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বশক্তিকে আহবান জানিয়েছেন। 

ভারত সরকার ‘জেনেভা কনভেনশন’এ বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে যেখানে চীন, রাশিয়া সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেছে। তাই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভারত সঠিক অবস্থানেই আছে, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এই সংকট সমাধানে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে ভারত অবশ্যই তার জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেবে- এটাই স্বাভাবিক। মোদ্দা কথা, এক ইস্যু যায় তো আরেক ইস্যু আসে কিন্তু অপপ্রচারকারীদের গুজব রটানো বন্ধ হয়না। এমন অসংখ্য অপপ্রচারের মাঝেই এগিয়ে চলছে এই দুই দেশের সম্পর্ক। 

সবশেষে বলবো, ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুতার সূচনা। আমরা আজ যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা বলি তার মূল ভিত্তি তৈরি করেছিলেন তারা। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিই বাংলাদেশ ভারতের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের মূল অস্ত্র। আজো দুই দেশ নিজেদের সমস্যা সমাধান করে চলছে সেই চুক্তির উপর ভিত্তি করেই। তাই যে বা যারা এই সম্পর্ককে নষ্ট করতে অপপ্রচারে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকেই সচেতন থাকা আবশ্যক। 

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর