৬ এপ্রিল, ২০২০ ১৫:১১

বসন্ত এসে গেছে, বিষাদ ছুয়েছে মন!

রুমানা রাখি

বসন্ত এসে গেছে, বিষাদ ছুয়েছে মন!

রুমানা রাখি

বসন্তকাল বসন্তকাল/আকাশ দেখ সূর্য হাসে/ বসন্তকাল বসন্তকাল/ জেগে উঠে পৃথিবীকে বল স্বাগতম! ব্রিটেনের বাচ্চাদের বসন্তকালে যে ছড়াটি শেখানো হয় তারই বাংলা অর্থ উপরের লাইনগুলো। প্রতিবছর এমন সব সুন্দর সুন্দর লাইনের গাঁথুনির মধ্যদিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানায় ব্রিটেনের লাখ লাখ শিশুরা। প্রতিবছরের মতো এবারও বসন্ত এসেছে কিন্তু বাচ্চাদের এবার আর এই ছড়াটি শিখতে হয়নি। 

ব্রিটেনসহ পুরো ইউরোপ চেরীসহ হরেক রকম ফুলে ছেয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগেও যেখানে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে সন্ধ্যা নামতো। সেখানে এখন সন্ধ্যা নামে আটটার পরে। বছরের এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করে ব্রিটেনবাসীরা। প্রতিবছরের মতো এবারও বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হওয়ার কথা ছিলো এপ্রিলের ছয় তারিখ। আর যা শেষ হওয়ার কথা ছিলো ১৭ই এপ্রিল। এপ্রিল ঠিকই আসেছে। এবার আর বাচ্চাদের প্রতিবছরের মতো ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। কারণ বাচ্চাদের ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে আরও ১৫ দিন আগে থেকে। আর তাই বসন্ত বসন্ত আমেজে উপরের ছড়াটি পড়েনি কোন বাচ্চারা। 

বছরের যে ছুটিগুলোর জন্য অপেক্ষা করে বাচ্চারা, অভিভাবকরা। কোন অপেক্ষা না করেই এবারের বসন্তে অনিদৃষ্টকালীন ছুটি দিয়ে দিল করোনাভাইরাস। তবে এ ছুটি অবকাশ যাপনের নয়, ভয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকার ছুটি। 

করোনাযুক্ত লন্ডনে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি শুধুই নিশব্দতা। যে পথ ছিল লোকে লোকারণ্য সেই পথ এখন জনমানবহীন। বার-রেস্তোরাঁ-শপিংমলের কপাট বন্ধ। এ কোন শহর! যে শহরের রেলে ও গাড়িতে চড়ার জন্য লোকে দীর্ঘ লাইন দেয় সময়ের আগে, এখন কোনো তাড়াহুড়ো নেই, দীর্ঘ সারি নেই, কেবলই বিজন নির্জনতা। অচেনা, অজানা লন্ডন যেন মনে হয় একটু বাচতে চাই, একটু বাচাতে চাই। পৃথিবীতে আরও অনেক কিছু আছে দেখার। দেখতে চাই, নি:শ্বাস নিতে চাই প্রাণ ভরে। 

প্রতিবছরই বসন্তে চেরী দেখতে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার ভিড় করে লন্ডনে। তবে এবার বসন্তে কেউ চাইলেই চেরী দেখতে পারবে না, বাইরে ঘুরতে পারবে না, অবকাশ কাটাতে কোথাও যেতে পারবে না, পারবে না পরিবার নিয়ে পিজা খেতে বা সিনেমা দেখতে। 

যুক্তরাজ্যের ট্যুরিজম অ্যালায়েন্সের তথ্যমতে, গ্রীস্মের সময় প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে ১৮০৩ জনের বেশি ট্যুরিষ্ট লন্ডন ঘুরতে আসে। আর এইসব ঘুরতে আসা ট্যুরিস্টরা প্রত্যেকদিনের খরচ ধরা হয় ৬৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন। যা বছর শেষে হাজার মিলিয়নে গিয়ে পৌঁছে। আর বাইরে থেকে আসা ট্যুরিস্টদের সাথে মেতে ওঠে লন্ডনের বসবাসকারীরাও। 
বসন্তকে ঘিরে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের সাথে মিলিয়ে ছুটি নেয়, শুধু বসন্তকে উপভোগ করার জন্য। কিন্তু করোনা, উপভোগ তো দূরের কথা মানুষকে দিনে দিনে মৃত্যুর বুকে ঠেলে দিচ্ছে করোনাভাইরাস। বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে ঘরের মধ্যে। 

দুই দিন আগে ডেইলি মেইলে বিখ্যাত কম্পোজার জেমা পিককের একটি আর্টিকেল ছাপা হয়। যেখানে জেমা তার ১৩ বছরের ছেলের একটি কবিতা তুলে ধরেন। যেখানে লেখা আছে-আমাদের ইতিহাস বই এখন কথা বলছে/আমরা আমাদের পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছি/ আমারা ঘরের কাজ করছি/ কিন্তু সবই যেন আমরা করছি ভয়ে ভয়ে/ আমরা নি:শ্বাস নিতে চাই...

জেমা তার আর্টিকেলটিতে লিখেন। আমার ১৩ বছরের সন্তানটি অনেক সাহসী। কিন্তু এখন আমি বা তার বাবা কোন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে চাই, সে আমাদের পথ আগলে ধরে। আমার মনে হয় আমার সন্তানটি ভয়ে ভয়ে তার সাহস হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে সন্তানরা তাদের মনোবন কতোটুকু ধরে রাখতে পারবে তা জানা নেই কারও। 

করোনাভাইরাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা হোম কোয়ারেন্টাইন। তবে হোম কোয়ারেন্টাইনের সুফলজনিত আলাপের মাঝে একটা বড় আলাপ এখনও আসেনি, তা হলো হোম কোয়ারেন্টিনের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুকি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা। চীন, যুক্তরাজ্য,আমেরিকা, কানাডায় ইতোমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে চীনে করা জরিপে দেখা যায়, ৪২.৬ শতাংশ ব্যক্তি করোনার ভয়ে অ্যাংজাইটিতে ভুগছেন। এর পূর্বে সার্স, ইবোলা এ জাতীয় মহামারির সময়েও মধ্যপ্রাচ্য ও কানাডাতে মানসিক রোগের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। তাই করোনার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক বাতিল করা যাবে না।

গত সপ্তাহে জার্মানির একটি স্টেটের অর্থমন্ত্রী করোনার ভয়ে আত্মহত্যা কিংবা য্ক্তুরাজ্যের একই পরিবারের চারজনের আত্মহত্যার সংবাদ আমাদের মাঝে মানুষিক ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। লম্বা সময় ঘরে বসে থাকার একটা মানসিক চাপ আছে। প্রতিদিন অফিসে কাজ করে যারা অভ্যস্ততা, দিনের পর দিন বসে থেকে এই কর্মোদ্দীপ্ত মানুষদের এক ধরনের হতাশা তৈরি হবে। সেই হতাশা থেকে ধীরে ধীরে হবে ক্রোধ ও বিষণ্ণতা। 

ইংলিশ রক সিঙ্গার জন লেনন ও তার স্ত্রী ইয়োকো অনো মানবতার জন্য ‘ইমাজীন’ শিরোনামের একটি গান লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে। জন লেননের গাওয়া সেই গানটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল। সে গান যা এখনো মানুষকে উদ্দীপ্ত করে বিশ্ব মানবতার জন্য- মনে করো স্বর্গ নেই/ সহজ হবে যদি আরও চেষ্টা করে ভাবো/ আমাদের অতলে কোন নরকও নেই/ আমাদের আছে শুধু আকাশ/ মনে করো, সব মানুষ বেঁচে আছে আজকের জন্য/ ভাবো, পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই....

জন লেননের এই গানটি যে এতো বছর পর আমাদের সামনে সত্যি হবে, তা হয়তো জানা ছিলোনা স্বয়ং মেননের। তবে প্রকৃতি লেননেরই স্বপ্নের পৃথিবী বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কী নির্মমভাবে আমাদের সামনে হয়েছে তা আমরা দেখছি বর্তমান সময়ে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্যগুলো প্রতিদিনের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা কমার নাম নেই। সাড়ে নয় কোটি জনবসতির দেশটিতে করোনার ছোবল থামবে কবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। হয়তো থামবে ঠিকই, আবার জনপদে ফিরবে জনতার পদচারণ, প্রত্যহিক ব্যস্ততায় ডুবে  মানুষ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় আঘাতে জর্জরিত লন্ডনে মানুষের আপনজন হারানোর শোক এবং সব ধকল সামলে উঠে বর্তমানের বিষণ্নতার দেয়াল ভাঙতে পারবে কবে, তা এখনো অজানা।

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর