১৬ এপ্রিল, ২০২০ ২১:০৫

ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ট্রাস্কফোর্স গঠন জরুরি

ড. কাজী এরতেজা হাসান

ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ট্রাস্কফোর্স গঠন জরুরি

ড. কাজী এরতেজা হাসান

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই কঠিন দুর্যোগের সময়েও দরিদ্র মানুষকে সহায়তার জন্য বরাদ্দ করা সরকারি চালের একাংশ লুটপাট করছে চক্র। কমবেশি প্রায় সারাদেশে কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলেমিশে গরিবের এই চাল আত্মসাৎ করছে। এই জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও চক্র তা গা করছে না। সরকারি ত্রাণের চাল লুটপাটের ঘটনা সব সরকারের আমলেই কম-বেশি ঘটলেও করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও দুস্থদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে এতটুকু কাঁপছে না এই লুটেরা চক্রের হৃদয়।

এমনকি সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ও ভিজিডির চাল বিতরণের ক্ষেত্রে ওজনেও কম দেওয়ার ভয়ংকর তথ্য উঠে আসছে। একজন দুস্থকে ১০ কেজি চাল দেওয়ার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও কৌশলে ৮ কেজির প্যাকেট বিতরণ করছে এই চক্র। এ নিয়েও দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ করছেন হতদরিদ্র মানুষ। জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর মিলিত সিন্ডিকেটের এই অপকর্মের দোষ গিয়ে পড়ছে সরকারের ওপর।

পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ইকড়ি ইউনিয়নেও করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের অসহায় লোকজনের মধ্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দকৃত ভিজিডির চাল আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের ধরতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ইকড়ি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বর মো. মওদুদ আহম্মেদ লাভলু, ২ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বর মো. রফিকুল ইসলাম, ৩ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বর শিশির হালদার, খোকন সিকদার চক্র গত সোমবার জিআর চালের ছয় বস্তা (প্রায় ৬০০ কেজি) আত্মসাৎ করেন। আত্মসাৎকৃত এই চাল বিকালে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় ভোলানাথের ছেলে ভ্যানচালক জীবনের বোথলা বাজারসংলগ্ন বাড়িতে। ভ্যানে করে জীবনের বাড়িতে সরকারি ত্রাণের চাল আনার বিষয়টি টের পান স্থানীয়রা। চাল আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত খোকন সিকদারের ভাই কবির সিকদার এবং স্থানীয় মহিউদ্দিন খলিফার ছেলে সাইদুল খলিফা বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে হইচই করেন।

এতে স্থানীয় লোকজন, সাংবাদিক ও প্রশাসনও বিষয়টি জেনে যায়। প্রশাসনের তত্পরতা টের পেয়ে আত্মসাতের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ইকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে খোকন সিকদার, শিশির, লাভলু মেম্বারসহ স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি সোমবারই সন্ধ্যায় গোপন বৈঠক করেন কবির সিকদারের (আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত খোকন সিকদারের ভাই) বাড়িতে। প্রশাসনের চোখ এড়াতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জীবনের বাড়িতে রাখা চাল তড়িঘড়ি করে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়।

জানা গেছে, ইকড়িতে সরকারি চাল আত্মসাতের বিষয়টি পিরোজপুর জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন (ডিসি) জানতে পারেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে পাঠান ডিসি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাত সাড়ে ৮টার দিকে জীবনের বাড়িতে গিয়ে আত্মসাত্কৃত চালের বস্তা না পেয়ে উলটো তথ্যদাতা সাইদুল খলিফাকে বকাঝকা করেন। তবে জীবনের মা প্রশাসনের লোকজনকে জানান, তার ছেলে ভ্যানে করে বিভিন্ন মানুষের পাঁচ-ছয় বস্তা চাল বাসায় নিয়ে আসে এবং পরে সেগুলো অন্যত্র নিয়ে যায়। ভাণ্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মাকসুদুর রহমান বিষয়টি সম্পর্কে অবগত বলে জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হুঁশিয়ারির মধ্যে বুধবারও ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও সরকারি চাল আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ গতকাল পৃথক আদেশে ইউনিয়ন পরিষদের আরও চার জন চেয়ারম্যান এবং পাঁচ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন চেয়ারম্যান ও ১২ জন সদস্য সাময়িক বরখাস্ত হলেন।

সরকারপ্রধানের এরকম হুঁশিয়ারির মধ্যেই শনিবার রাত থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত দেশের আট জেলা থেকে ২৫ হাজার ৮০০ কেজি (প্রায় ২৬ টন) চাল উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে ১৮ জনকে, যাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের। এর আগে ৮ এপ্রিল থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১ লাখ ২১ হাজার ২৫৭ কেজি (১২১ টনের বেশি) সরকারি চাল উদ্ধার করে। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে খোলাবাজারে বিক্রি কর্মসূচির (ওএমএস) এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালও রয়েছে।

ওএমএসের আওতায় ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে গত সোমবার এই কার্যক্রম স্থগিত করে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এদিকে, দেশের চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার অনূর্ধ্ব করার পাশাপাশি কঠোর হস্তে তা দমন করার অপ্রাণ চেষ্টা করছেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলার অন্যান্য সদস্যরা। 

একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। অনেকেই মনে করছেন করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণের চাল চুরিতে লিপ্ত আছেন জনপ্রতিনিধিরা। এ তথ্যটি সঠিক নয়। এখনো প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তৃণমূলে পৌঁছায়নি। তাই পুরোনো অভ্যাসবশত জনপ্রতিনিধিরা এখনো ভিজিএফ'র চাল চুরিতে ব্যস্ত। 

তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণের কার্যক্রম চালু করার যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা মানতে হবে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডের দলীয় প্রতিনিধি এবং প্রশাসনের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ পৌঁছালে এই কমিটির মাধ্যমে বিতরণ করবে। এই কাজটির তদারকি করবে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন সমন্বিত ট্রাস্কফোর্স। তাহলেই চাল চুরির ঘটনা আর ঘটবে না বলেই বিশ্বাস করি। 
এ অবস্থায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার জোর দাবি উঠেছে। তাহলেই এদেশের চাল চোররা সাবধান হয়ে যাবে। তাই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন নৌবাহিনী, পুলিশ এবং র‌্যাবকে নিয়ে একটি ট্রাস্কফোর্স গঠন করা হলে অনিয়ম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেই বিশ্বাস করি। তাই ত্রাণ বিতরণে এই ট্রাস্কফোর্স গঠন জরুরি হয়ে পরেছে। আমরা প্রত্যাশা করি, এই ট্রাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং গরিব অসহায় মানুষ ত্রাণ পাবেন।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা ও ডেইলি পিপলস টাইম। পরিচালক, এফবিসিসিআই

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর