১৭ এপ্রিল, ২০২০ ০৬:১১

বিশ্বক্ষুধা ও আমাদের কৃষি

মালেকা আক্তার চৌধুরী

বিশ্বক্ষুধা ও আমাদের কৃষি

প্রতীকী ছবি

করোনা আক্রান্ত বিশ্বে বদলে গিয়েছে জীবন, বদলে গিয়েছে জীবনের গতি- প্রকৃতি, ধ্যান-ধারণা। সময়ের সুতোয় জড়িয়ে জীবন যেখানে একই নিয়মে একই ছকে ধারাবাহিকভাবে নানান ছন্দে বিন্যস্ত - প্রসারিত হয়ে চলে যাচ্ছিলো আজ সে নিয়মে হঠাৎ ছেদ পড়েছে। ভয়াল ৩১ ডিসেম্বর, চীনের উহান নগরী; ভয়াবহ বিস্তার মতান্তরে নব আবিষ্কার প্রাণঘাতী করোনার। জীবন মান এক লহমায় থমকে গিয়ে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জীবনের সচল চাকা আজ অশনির অমানিশায় অচল হয়ে পড়েছে ----- বিশ্ব যেন আজ ছোট্ট এক গ্রাম, মূহুর্তেই যে কোনো খবর ছড়িয়ে পড়ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কনসার্ট-অনুষ্ঠান, অফিস পাড়া, বিনোদন-ক্রীড়াঙ্গনসহ বহতা নদীর মতো জীবনে নেমেছে ভয়ংকর মরণঘাতী শ্যাওলার দূষিত দূষণ।

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। থামেনি ব্যক্তিক্ষুধা, থামেনি বিশ্ব ক্ষুধা। জনশ্রুতি আছে, প্রমাণাদিও রয়েছে, যে কোনো দুর্যোগ - মহামারীর প্রেক্ষাপটে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, মনন্তর, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, বেড়ে যায় অসাধু-অসৎ মানুষের লোভ লালসা এমনকি নোংরা যৌনলিপ্সাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সমাজের এক মহাক্রান্তিলগ্নে কথাসাহিত্যিক জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন, "ভারতের বুকে সাম্রাজ্যবাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে শবলুদ্ধ গৃধ্রদের উর্ধ্বস্বর বিভৎস চিৎকার মুখরিত হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস; একদিকে যুদ্ধের জুয়াখেলায় কাগজিমুদ্রার ছিনিমিনি, অন্যদিকে চোরাকারবার আর কালোবাজারের নারকীয় অত্যাচারেপর্যুদস্ত দিনযাত্রা; সারা বাংলার বুকে নিরন্ন বিবস্ত্র নরনারীর গগনভেদী হাহাকার, আর তারই বুকে বসে মুনাফাশিকারী ও ব্যবসায়ীদের দানবীয় অট্টহাসি। মহাপ্রলয়ের সন্ধিলগ্নে যেন নরক গুলজার"। (জগদীশ, ১৪২০,৭)।

করোনার করাল গ্রাসে বিশ্বমন্দার সমূহ আশঙ্কায় কাঁপছে পুরো পৃথিবী। একদিকে কোভিড আতঙ্ক অন্যদিকে অর্থনৈতিক ধস, বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সামনের  দিনগুলির চিত্র সহজেই অনুমেয়! দরিদ্র, হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষের করুণ চিত্র মানবিক মনকে ব্যথিত করে চলেছে অনবরত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার ভাষণে, কনফারেন্সে সেইসব অসহায় মানুষের জন্য আকুতি, হুঁশিয়ারী কোথাও বা অনুনয় - বিনয় উঠে আসলেও থামেনি অসৎ মানুষদের অসততার দৌরাত্ম্য। না থাকুক শিক্ষা দীক্ষা, কৃষ্টি - ঐতিহ্য ; মানুষ হিসেবে একটা মমত্ববোধ তো থাকা জরুরী। কৃত্রিম খাদ্য সংকট এড়াতে তথাকথিত মজুমদারের প্রতি সরকার প্রশাসনসহ সকল স্তরের দায়িত্বশীল কর্মচারী - কর্মকর্তাবৃন্দের সম্মিলিত নজরদারি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির অপচেষ্টা যেনো কখনোই সফল না হয়।

মানবিকতার উদাহরণ বিদ্যমান বিশ্বে কম তো নয়! বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে কুরিয়ার জার্নালে প্রকাশিত সেই শপিংমলের ক্রেতাদের মানবিকতাসম্পন্ন গল্পটি ----- শপিংমলের কাউন্টারের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যারা বিল মিটিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকেই তার পরের পে- মেন্টকারীর জন্য নিঃশব্দে ১০ ডলার করে রেখে যাচ্ছেন। এভাবে বেশ ক" জন ক্রেতার এমন মানবিক আচরণে কাউন্টারে যিনি বিল নিচ্ছিলেন তিনি অঝোরে কেঁদে ফেললেন। হায়  মানবতা! মানবিক হৃদয় এভাবেই মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়।।

অনুকরণ - অনুসরণ করার মতো উদাহরণ আমাদের দেশেই কী কম রয়েছে! বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসহ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ উদ্যমী ছাত্র ছাত্রীরা নিজ দায়িত্বে যে যার সামর্থ অনুযায়ী খেটে খাওয়া মানুষই শুধু নয় মধ্যবিত্তের ছদ্মাবরণে যারা রয়েছেন তাদেরকেও রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। সামাজিক মর্যাদা আর আত্মসম্মান যাদের ক্ষুধার পেটে পাথর বেঁধে দিনযাপন করতে বাধ্য করায়। 

সামাজিক অনৈতিকতা,  মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে আজ বিশ্ববাসীকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে ।  ভোগবাদী বিশ্বে করোনা ভ্রাতৃত্ববোধ - সাম্যবোধ জাগ্রত করে দিয়েছে দেশের সাথে দেশের, জাতির সাথে জাতির সর্বোপরি মানুষের সাথে মানুষের। তবুও প্রাণ সংহারী করোনার উৎখাত চাই আমরা এ বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডকে রক্ষায়। জ্ঞান বিজ্ঞানের শক্তিতে বলীয়ান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ এর ঔষধ আবিষ্কারে ঘাম ঝরিয়ে চলছেন অবিরাম।  আলো একদিন ফুটবে।

বিশ্বব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বাড়বে বেকারত্ব বাড়বে দারিদ্র্য।  ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ চাকুরীচ্যুত হয়ে বেকারত্বের ধকল বয়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ২.৩ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এর মতে, মন্দা কাটাতে প্রভাব ফেলবে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ এবং তার দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশ নিয়েও তিনি গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেন।

বিশেষজ্ঞ মহলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের এবং রেমিট্যান্স শিল্পের সমূহ সংকটাপন্ন অবস্থা। বাতিল হয়েছে একের পর এক অর্ডার, রেমিট্যান্সসহ রফতানি যোগ্য প্রতিটি খাতেই সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। করোনাকালের স্থায়িত্বের করুণার ওপর এবং বিশ্ব বাণিজ্য সচল হওয়ার সম্ভাব্য অনিশ্চিত সময়ের ওপর নির্ভর করবে অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রচণ্ডতা।
 
২০০৮-০৯ সালে বিশ্ব একবার আর্থিক মন্দায় পতিত হলেও সেটার প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিলো। এবারের বৈশ্বিক মন্দা একদিকে অর্থনৈতিক অন্যদিকে মানুষের জীবন রক্ষার তাগিদ; বেঁচে থাকাটাই যেখানে মূখ্য। 

সংকট ঘনীভূত হচ্ছে সামাজিক অর্থনীতিতে, বিপন্ন জনজীবনে। বিশ্বের প্রতিটি জনপদ আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে ; ফ্রান্সের হাসপাতালে লাশের স্তুপ, যুক্তরাষ্ট্র - যুক্তরাজ্যে মেলার মাঠ, খেলার মাঠ পাঁচতারকা হোটেলসহ নৌ- জাহাজগুলোকে অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত করে চলছে কভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা। পাকিস্তান, ভারতে পরিত্যক্ত রেলের বগিকেও ব্যবহার করা হচ্ছে চিকিৎসা কাজে। এই মহাদুর্যোগে যে যার ঘর সামলাতে এখনও যেমন ব্যস্ত, করোনা পরবর্তী সময়েও একই চিত্র প্রদর্শিত হবে সন্দেহ নেই। বিশ্বমন্দায় নিপতিত পৃথিবী আর একবার ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে বড় কঠিনভাবে। কে কাকে বাঁচাবে? সর্বত্র হতাশার চিত্র ; বেঁচে যাওয়া মনুষ্যজাতিকে অসহায়ভাবে সেটি অবলোকন করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি সামষ্টিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।  সেক্ষেত্রে, পুরো মানবজাতি যেখানে দিশেহারা ; আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্সের মতো প্রতাপশালী পরাক্রমশালী অর্থনীতির দেশগুলো বিপর্যস্ত অবস্থায় হিমশিম খেতে থাকবে সেখানে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকানোর সুযোগ কার কতোটুকুন থাকবে?  তারওপর IMF সতর্কবার্তা দিচ্ছে, চলতি অর্থবছরে বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সংকুচিত হতে চলেছে -----

আমাদের বাংলাদেশ এক সময় কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত ছিলো। সোনালি আঁশের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে,"  আমাদের মাটি আছে, মাটির উর্বরতাও রয়েছে ; আমরা এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখবো না, কোনো অনাবাদি জমি থাকবে না। "

একইভাবে "আমার দেখা নয়াচীনে" বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "নয়াচীনে একখন্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেললাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে।" (আমার দেখা নয়া চীন, পৃ;৮৯)।

কৃষকদের ক্ষতি মোকাবিলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিখাতে মাত্র ৫% সুদে কৃষকদের পাঁচ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছেন। আগামী অর্থবছরে বীজ, সার, সেচ বাবদ বাজেটে নয় কোটি টাকা কৃষিখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সুতরাং কৃষি হয়ে উঠতে পারে এ সময়ের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। এক টুকরো জমিও আমরা ফেলে রাখবো না। যথাযথ জমি ব্যবহারের মাধ্যমে ফুলে ফলে, দুধে মাছে আবারো চিরায়ত বাংলা তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। নিজেদের সমস্যা সমাধান হবে উপরন্ত ঘরের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মতো সুযোগও তৈরি হতে পারে। উৎপাদন কার্যক্রম ঠিক এই মূহুর্ত থেকেই সবরকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালিয়ে যেতে হবে। উর্বর ধরণীর উর্বর মাটি মানুষকে কখনও নিরাশ করে না। মনিটরিং ব্যবস্থার নজরদারিও বাড়াতে হবে কার্যকরভাবে। 

মানুষ ও জীবনের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা জনগণকে অবিরাম স্বপ্ন যেমন দেখাচ্ছেন তেমনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথও বাতলে দিচ্ছেন। গোটা দেশ আজ ঐক্যবদ্ধ তার সুদৃঢ় অবিচল নেতৃত্বে। সর্বসাকুল্যে একটাই ভরসার জায়গা।

সময় বন্দী হয়ে আছে একটা অনির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমে ; সেই ফ্রেমের অবকাঠামোটা পরিবর্তন করতে হলে চাই ধৈর্য, সহিষ্ণুতাসহ ক্রমাগত উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখা। নিজস্ব জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির চলমান গতিশীল বলয় অব্যাহত থাকলে সার্বিক পরিস্থিতি সুসংহত থাকবে।

ঠিক এ মূহুর্তে সর্বগ্রাসী করোনা মহাযুদ্ধে মানবজাতিকে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বিকল্প নেই। বেঘোরে প্রাণসংহারী করোনাকে একদিন ফটোফ্রেমে করেই বিশ্বের যাদুঘরে রাখা হবে ; পরবর্তী প্রজন্ম সেই বোতলে রক্ষিত "দৈত্যকে বশ করার মতো" প্রাণঘাতী করোনাকে পর্যুদস্ত দেখে উল্লসিত হবে, অনুপ্রাণিত হবে। সেদিন বেশি দূরে নয়।

লেখক: অধ্যাপক দর্শন বিভাগ ও সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর