২০ এপ্রিল, ২০২০ ০০:৩৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জানাজা আজ হাজার লক্ষ জানাজার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো?

ড. কাজী এরতেজা হাসান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জানাজা আজ হাজার লক্ষ জানাজার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো?

ড. কাজী এরতেজা হাসান

দেশে উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতি উপেক্ষা করে কোনোরকম পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই লকডাউনের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরাইল উপজেলার বেড়তলা গ্রামে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর নামাজে জানাজায় প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম নিয়ে গতকাল থেকেই নানা সমালোচনা শুরু হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করাও হয়েছে। এমনকি   ওই জানাজায় অংশ নেওয়ার সূত্র ধরে বেড়তলাসহ ৩ উপজেলার ৮টি গ্রাম লকডাউনের নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব গ্রামের  বাসিন্দাকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এই জানাজাকে ঘিরে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা খুব জরুরি হয়ে পরেছে। 

গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ হয়েছে, মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় এত মানুষের সমাগম ঘটিয়ে সরকারের এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা ফুটিয়ে তুলতে সুকৌশলে নেপথ্যে কাজ করেছেন বিএনপির ২ জন সংসদ সদস্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২ আসনে (সরাইল-আশুগঞ্জ) বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া এবং সংরক্ষিত নারী এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এই জানাজায় অংশ নিতে নিজের অনুসারীদের গোপনে তাগাদা দিয়েছিলেন বলেও জানাজায় অংশ নেয়া অনেকেই জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২ আসনটি বিএনপি জামায়াতের ঘাঁটি হিসাবেই পরিচিত। এই আসন থেকেই এমপি ছিলেন তাহের ‌উদ্দীন ঠাকুরও। তাই আওয়ামী লীগ সরকারকে বিতর্কিত করতে তারা যেকোনো সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পরেন। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার সকালে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটায়। পৃথিবীতে মহামারী আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগকালীন সময়েও শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা বাড়ানোর জন্য বিএনপির এই দুই সংসদ মিলেই মওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় এত লোকের সমাগম ঘটিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন অনেকে। 

এ অবস্থায় মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজা নিয়ে নিম্নোক্ত ১৫ টি প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। তাহলে অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি। 

খেলাফত মজলিসের  নায়েব আমীর মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজার নামাজ আজ "টপ অব দ্যা কান্ট্রি"।  করোনা ভাইরাসে যখন সারাদেশে জরুরি অবস্থা আর  বি বাড়িয়া 'লকডাউনে' তখন লকডাউন ভেঙ্গে এই ফরজে কেফায়া (যা কয়েকজনে পড়লে সবার আদায় হয়ে যায়) জানাজার নামাজের মাধ্যমে শো-ডাউনের পেছনে কোন দূরভিসন্ধি ছিল কি না তা তদন্তেরও দাবি রাখে। এক জানাজা আজ হাজার লক্ষ জানাজার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো? করোনা পরিস্থিতিতে  সারা৷ বিশ্বে এমন আরেকটি জানাজা বা শেষকৃত্যের নজির কোথাও নেই। তবে বাংলাদেশে এটি কেন হলো? কারা করলো? পরিকল্পিত  নাকি আবেগে এটি হয়েছে আসুন একটি  বিশ্লেষণ করি। 

১. আনসারী বিকেল ৫টায় ইন্তেকাল  করেছেন, চাইলে সন্ধ্যার আগে পরে তার দাফন করা যেত।

২. তাকে মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়েছে সেটি কোন অন্ধকার কবরস্থান ছিল না। পরিষ্কার লাইটিং মাঠ ছিল। রাতে দাফনে কোন সমস্যা ছিল না। কেন তারা পরদিন ১০টা পর্যন্ত লাশ নিয়ে সময় কালক্ষেপণ করলেন?

৩. রাতেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত প্রাইভেট গাড়িতে খেলাফত মজলিসের দলীয় কর্মীরা সেখানে হাজির হন। ফজরের নামাজে অন্তত ১৫ হাজার লোক শরিক হয় বেড়াতলা মাদ্রাসায়? তবুও কেন অপেক্ষা করা হলো?

৪. তখনই এতো লোক দেখে কী জানাজা ফজরের পরেই পড়ে নেয়ার প্রয়োজন ছিল না? 

৫. ঢাকার মজলিস ও হেফাজতের নেতারা যেহেতু ফজরের আগেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন, তখন বাদ ফজর জানাযা না পরে কেন সকালে আরো বেশি লোক সমাগম ও জানাজার জন্য শোডাউন করলেন?

৬. করোনার এই পরিস্থিতিতে ঢাকা থেকে মাওলানা মাহফুজুল হক ও মামুনুর হকের নেতৃত্ব হাজার হাজার নেতা কর্মী কি জানাজায় শরিক হতে  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়  যাওয়া খুব জরুরি ছিল? লকডাউনের জরুরি অবস্থায় তার এতো বড় বহর নিয়ে ঢাকা থেকে বের হলেন আইনশৃঙ্খলা  বাহিনী কোথায় ছিল? কোন খুঁটির জোড়ে তাদের আটকাতে পাড়লো না? 

৭. খেলাফত মজলিস কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুল হকদের সাথে আনসারীর পরিবারের ফোন আলাপ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দলীয় নেতাদের ও জামেয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মোবারক উল্লাহর ফোন আলাপ আনসারীর মৃত্যুর পরে বিকাল ৫টা থেকে ট্যাপ করলেই লাশ নিয়ে শোডাউনের বিষয়টি স্পষ্ট  হয়ে যাবে।

৮. সকালে যখন লাখ লাখ লোক  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিশ্বরোড থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত লোক লোকারণ্য হলো তখন জানাজার নামাজ সংক্ষিপ্ত না করে দীর্ঘ সময় লোকজনকে আটকিয়ে বয়ান করা হলো কেন?

৯. লাশ দাফন সংক্ষিপ্ত না করে করোনার জন্য দোয়া হবে বলে, লাশ কবরে দাফন শেষ করে আরো ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে দোয়া করা হলো কেন?

১০.  মসজিদে ফরজ নামাজ যেখানে সংক্ষিপ্ত  সেখানে কয়েকজন মিলে সংক্ষিপ্ত জানাজার নামাজ পরতে শরিয়তের সমস্যা ছিল কোথায়?

১১. হাদিসে আছে মহামারীতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লোকজন না যেতে, সরকারী নিষেধাজ্ঞা ছিল ঢাকা থেকে বের না হতে। তবুও ইসলামের নির্দেশনা ও সরকারী আইন অমান্য করে মাওলানা মাহফুজুল হক, জুনাইদ আল হাবিব, মামুনুল হক, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবী, হাসান জামিলের নেতৃত্বে  হাজার হাজার আলেম ঢাকা থেকে কেন বি বাড়িয়া গেলেন?

১২. ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থেকে আসার পরে ঢাকার এই আলেমদের বাসা কেন এখনো লকডাউন করা হচ্ছে না? বা কেনইবা আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে  লাখো মানুষকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলার  কারণে?

১৩. ওসি ও এসপিকে প্রত্যাহার করে আইনী ব্যবস্থা নিলেও খেলাফত মজলিসের নেতাদের কি কোনই দায় ছিল না?

১৪.  খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাহফুজুল হোক বলেছেন, "করোনার কারণে জানাজায় লোক কম হয়েছে।" তার উদ্ভট বক্তব্যের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না? গত সপ্তাহে বাংলাদেশ জমিয়তে উলামার কেন্দ্রীয় সভাপতি, শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানীর খলিফা আল্লামা আব্দুল মুমিন ইন্তেকাল করেন। তিনি আনসারীর ছেয়ে হাজারগুন বেশি জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। কিন্তু জমিয়তে নেতার সংক্ষেপে জানাজা পড়তে পারলে তারা কেন পারলেন না? এখানে মানুষের আবেগ ছিল না লাশের রাজনীতির নোংড়া শোডাউন ছিল তা তদন্তের দাবী কী রাখে না?

১৫. এটি কী পুরো দেশের মানুষকে হুমকির মধ্যে ফেলা ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি বিদ্রোহের শামিল নয়? এর কী কোন প্রতিকার পাবে না রাজনৈতিক কারণেই হেফাজতীয় সখ্যতায় এই দেশের মানুষ?

১৬. জানাযার নামাজ 'ফরজে কেফায়া'; অর্থাৎ একজন কেউ আদায় করলেই সকলের আদায় হয়ে যায়। ফরয, যা বাধ্যতামূলক নামাজ সেটা আমরা পড়ছি ঘরে বসে, পবিত্র কাবা শরীফ এবং মদীনায় পর্যন্ত জমায়েত নিষেধ আর একজনের জানাযার নামাজ পড়তে এত অবুঝ লোকের জমায়েত! এই ধর্মান্ধ পাগলামি'র শেষ কোথায় ?

এদিকে, শনিবার (১৮ এপ্রিল) সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানাজায় অংশ নেয়া গ্রামগুলোতে মাইকিং করে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।  বেড়তলা ছাড়া বাকি গ্রামগুলো হলো- আশুগঞ্জ উপজেলার খড়িয়ালা, বৈগইর, মৈশাইর; সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের শান্তিনগর, সীতাহরণ, বড়ইবাড়ি ও সদর উপজেলার মালিহাতা। এসব গ্রামের কেউ আগামী ১৪ দিন বাড়ি থেকে বের হলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

এছাড়া, ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়ায় জানাজায় লোক সমাগ‌মের ঘটনায় সার্কেল এএসপি, ওসিসহ তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনা তদন্তে তিন সদ‌স্যের তদন্ত ক‌মি‌টি গঠন করা হয়েছে। রবিবার (১৯ এপ্রিল) পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানার এ তথ্য জানিয়েছেন।

এর আগে ওই ঘটনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে সরাইল থানার ওসি শাহদাৎ হোসেন টিটুকে প্রত্যাহার করা হয়। শনিবার (১৮ এপ্রিল) রাতে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে তাকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে যুক্ত করতে বলা হয়। জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সহকারী পুলিশ সুপার মো. আলাউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে সরাইলের ঘটনা তদন্ত করতে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন ও অর্থ) কে সভাপতি করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন)। কমিটিকে আগামী ২২ এপ্রিল ২০২০ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল পৌনে ৬টায় জেলা শহরের মার্কাস পাড়ায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আলেম মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারী। তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। 

শনিবার সকাল ১০টায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে বেড়তলা গ্রামে জুবায়ের আহমদ আনসারীর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় স্থানীয় মাদ্রাসার প্রান্তর ছাড়িয়ে জানাজার সারি দীর্ঘ হয় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যন্ত। করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব মানার নির্দেশ থাকলেও জানাজা ঘিরে এ ধরনের বিশাল জামাত হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনা চলছে।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা ও ডেইলি পিপলস টাইম। পরিচালক, এফবিসিসিআই।


বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর