২০ এপ্রিল, ২০২০ ১৪:২৬

করোনাকালের কথন: একটি কোভিডিয়ট ব্যবস্থার উপাখ্যান

কাজী এস. ফরিদ

করোনাকালের কথন: একটি কোভিডিয়ট ব্যবস্থার উপাখ্যান

প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করার প্রাক্কালে মার্চ মাসের শুরুর দিকে আরবান ডিকশনারি ‘কোভিডিয়ট’ নামে একটি অপমানজনক নুতন শব্দের ব্যবহার শুরু করে। তাদের মতে, কোভিডিয়ট হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যারা কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও নিজ নিজ দেশের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নীতিমালা ও নির্দেশনা মেনে চলে না। এই সব ব্যক্তি জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা উপেক্ষা করে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে না, অহেতুক ভয়-ভীতি ছড়ায়, অন্যের কথা না ভেবে প্রয়োজনের অনেকগুণ বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে, অযৌক্তিক সব খবর বিশ্বাস করে, যাচাই না করে ভুল ও মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে, প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহণ না করে অন্যের ক্ষতির কারণ হয়, ও হিরোইজম প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে কোন কোন সময় মানবসেবার নামে  হাস্যকর কাজ করে। তারা করোনাভাইরাসকে অস্বীকার করে, মনে করে তাদের যেহেতু কোন শারীরিক অসুস্থতা নাই এবং যেহেতু তারা বয়স্ক নয়, তাই তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে না। আবার ব্যক্তির পাশাপাশি কোন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকার ব্যবস্থাও কোভিডিয়ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পার।

সরকার ব্যবস্থাও যে কোভিডিয়ট হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি ও ফ্রান্স। করোনাভাইরাসকে যথাযথভাবে গুরুত্ব না দেওয়ার মাশুল তারা এখন হাড়ে হাড়ে দিচ্ছে। 

পরিসংখ্যান বলছে, এই ৪টি দেশেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও এর কারণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আমাদের সরকার ব্যবস্থাও যে কোভিডিয়ট তা আমাদের কর্মকাণ্ডে এবং আমাদের আইন প্রণেতাদের বক্তব্যে  প্রমাণিত হচ্ছে। এই বছরের ৭ জানুয়ারি চীনের উহান শহরে শনাক্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাস ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে আমাদের দেশে প্রবেশ করে ৮ মার্চ। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এই ভাইরাস বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ২৪ লক্ষ ১৪ হাজার ৬০৫ জন ব্যক্তিকে সংক্রমিত করে প্রাণ নিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার ১৭৪ জনের। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে প্রস্তুতি নওেয়ার জন্যে আমরা ২ মাসের ও বেশি সময় পেয়েছিলাম । কিন্তু এত সময় পেয়েও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে আমরা বোকামির পরিচয় দিয়েছি যার জন্যে হয়তো আমাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।   

আমাদের আইন প্রণেতারা করোনাভাইরাসের ভয়াবহতাকে উপহাস করে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাদের সুমধুর বচনগুলো ছিল,‘আমাদের দেশে করোনাভাইরাস আসবে না’, ‘আমাদের প্রস্তুতি অনেক উন্নত দেশের চেয়েও ভাল’, ‘সরকার সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিধায় দেশে সংক্রমণ কম  হয়েছে’, ‘করোনা মারাত্বক রোগ নয় - এটা সর্দি- জ্বরের মত’, ‘আমরা করোনা রুখে দিয়েছি’, ‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী’, ‘করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানবন্দরের মত ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতেও নেই’, ‘করোনাভাইরাস মারাত্বক নয়, ছোঁয়াচে’, ইত্যাদি। একজন মেয়র লন্ডন থেকে এসেছেন। তাঁকে এয়ারপোর্টে নাকি কিছুই বলা হয়নি এবং তিনি নিজেও নাকি জানতেন না যে তার হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা দরকার। যথারীতি তিনি তার সকল কাজকর্ম স্বাভাবিক সময়ের মত চালিয়ে গেছেন।  

সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তেও দ্বিধাগ্রস্ততা ও অপরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। জনগণকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা না দিয়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় তারা এই ছুটিকে স্বাভাবিক সময়ের মত ছুটি মনে করে নিজ নিজ অবস্থানে থাকেননি। তাছাড়া গণপরিবহন বন্ধ না করে ছুটি ঘোষণা করায় মানুষ দলে দলে উৎসবমুখর পরিবেশে গ্রামে চলে গেছে এবং ঢাকা থেকে করোনাভাইরাস গ্রামে নিয়ে গেছে। সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাদের ঢাকায় থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা নাই তারা না হয় গ্রামে গেলেন, কিন্তু বাকিরা এটাকে ছুটি মনে করে আনন্দ করার নিমিত্তে গ্রামে গেছেন। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে চলে গেছেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অনেকেই অনাকাঙ্খিত ছুটি পেয়ে এই দলে যোগ দিয়েছেন। সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে বলা হল, সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। সাধারণ মানুষ মনে করল তাহলে মনে হয় দিনে বের হওয়া যাবে। তাই গত কয়েকদিন যাবৎ বিশেষ করে ঢাকা শহরে মানুষের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ব্যাংকিং সেবা মাত্র ২ ঘণ্টার জন্যে চালু থাকায় অনেক মানুষ একসাথে ব্যাংকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এতে ব্যাংকাররা সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশি পড়ছে। তার চেয়ে সপ্তাহে একদিন সারাদিনের জন্যে খোলা রাখাটাই বেশি যৌক্তিক হবে। আবার নিজেরদের লাভ ঠিক রাখার জন্যে গার্মেন্টস মালিকরা হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিককে ঢাকা-গ্রাম-ঢাকা দুইবার আনা-নেওয়া করেছে। এটা হতে দেওয়ায় সরকার অনেক বড় একটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে।

যেখানে জনসমাগম এড়ানোই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম একটা উপায়, সেখানে একজন সিভিলি সার্জন ঘটা করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে জনসমাগম ঘটিয়েছেন। একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ডাক্তারবৃন্দ ‘করোনা ওয়াক’ এর নামে মিছিল করেছেন। করোনা প্রতিরোধে কোন কোন রাজনৈতিক সংগঠনও নাকি মিছিল করেছে! সেখানে তারা হয়ত বলেছেন, 'করোনার চামড়া তুলে নিবো আমরা' অথবা 'একটা একটা করোনা ধর, সকাল-বিকাল নাস্তা কর'। আর আমাদের মহাজ্ঞানী ও মহানীতিধর নির্বাচন কমিশন তিনটা সংসদীয় আসনে গত ২১ মার্চ উপনির্বাচনও করে ফেলেছেন। অবশ্য দুষ্টু লোকেরা বলতে পারেন, অন্তত ঢাকায় উপনির্বাচনে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। কারণ সেখানে প্রতি ঘন্টায় নাকি একজন ভোটার এসেছিল! 


বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষই মোটামুটি কোভিডিয়ট আচরণ করছেন। তাই আমরা খবরে শুনতে পাই, কেউ কেউ কয়েকশ টয়লেট পেপার-হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে ঘর ভর্তি করছে, ইত্যাদি। তবে এই ক্ষেত্রে আমরা মনে হয় সবাইকে ছাড়িয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর আমাদের অজ্ঞতা, মূর্খতা, ও অশিক্ষার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। সাধারণ মানুষ যারা আমজনতা নামে পরিচিত তারা মনে হয় সকল সীমা অতিক্রম করছে। তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিকে দেখার জন্যে চিড়িয়াখানার মত হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, ঘরের দরজা-জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, হাসপাতালের আইসোলেশন বেড - প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, বিদেশ-ফেরতরা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা থাকলেও অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে - আত্বীয়-স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছে, অনেকে এখনও বাজারে-মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে, করোনা নিয়ে তর্ক করে মারা যাচ্ছে - অনেক আহত হচ্ছে, যারা স্বাভাবিক সময়ে নামাজ পড়ে না তারাও এখন মসজিদে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ইত্যাদি। সবচেয়ে হাস্যকর যে কাজটা করছে তা হল, নিজ নিজ এলাকা লকডাউনের নামে রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে সামাজিক দূরত্বের মাথা খেয়ে ২০-২৫ জন একসাথে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, একসাথে পার্টি করছে। কেউ কেউ বড় আকারের জনসমাগম  করে ত্রাণ দিচ্ছে, কোন কোন জায়গায় একজন ত্রাণগ্রহীতাকে ত্রাণ বিতরণ করছে ১৫-২০ জন ত্রাণদাতা! তারা পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর সাথে লুকোচুরি খেলছে। সবার ঘরে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল আসলে তারা দৌঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, আবার টহল চলে গেলে দলবেঁধে পুরোদমে আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী না বললেও কেউ কেউ ভয়ে নিজে থেকেই কান ধরে উঠবস করে তাদেরকে বিপদে ফেলছে। 

কোভিডিয়ট এর বিপরীতে কোভিডিয়েন্ট নামে আরেকটি শব্দ প্রচিলত হতে যাচ্ছে। কোভিডিয়েন্ট হচ্ছে ঐ সমস্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, বা  সরকার ব্যবস্থা যারা কোভিড-১৯ কে গুরুত্বের সাথে নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলছে। উন্নত বিশ্বের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কোভিডিয়েন্ট সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে জার্মানি, নিউজিলান্ড ও জাপান। জাপান ছাড়াও আমাদের এশিয়ায় আছে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভুটান। জার্মানিতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পূর্বে জানুয়ারিতেই জার্মান সরকার করোনাভাইরাস শনাক্তে ব্যাপক হারে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। সে কারণে ইউরোপের বড় বড় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিতে মৃত্যুর হার অনেক কম। করোনা মোকাবিলার জন্য যত দ্রুত সম্ভব আমাদের কোভিডিয়ট আচরণ পরিত্যাগ করতে হবে এবং ব্যক্তি, সংগঠন, সকল প্রতিষ্ঠান ও সরকার ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে কোভিডিয়েন্ট হতে হবে। যে দেশগুলো সফলভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে, আমাদের সরকার ব্যবস্থার উচিত হবে কালক্ষেপন না করে অতিদ্রুত তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলেই কেবলমাত্র আমরা করোনা-যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারব বলে মনে হয়। এর অন্যথা হলে আমাদেরকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে, যেটা দেয়ার স্বক্ষমতা হয়ত আমাদের নাই।   


লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।  email:[email protected]

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর