৮ মে, ২০২০ ১৭:৪৯

লোভনীয় এমপি পদ, নিষ্ঠুর রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম রনি

লোভনীয় এমপি পদ, নিষ্ঠুর রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম রনি

‘কারো ঘর পুড়ে, কেউ আলু পোড়া খায়’-এ গল্প সবার জানা। সেই গল্পের মতো একটা ঘটনা শেয়ার করতে চাই। ঢাকা-৫ আসনের (ডেমরা-যাত্রাবাড়ী-কদমতলী আংশিক) সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মোল্লা মারা গেছেন মাত্র তিনদিন। চার বার নির্বাচিত এই জনপ্রিয় সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে শুধু মোল্লা পরিবারই নয়, তার নির্বাচনী এলাকাসহ গোটা ঢাকাবাসী শোকাহত। তিনি একসময় ঢাকার প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাও ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচার্য পাওয়া প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের প্রায় সকলেই শোক জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনও তার মৃত্যুকে কঠিন ক্ষত হিসেবে দেখছে। কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ‘সুবিধাবাদীরা’ তো তার ধার ধারেন না। ওই যে শুরুতেই বললাম- ‘কারো ঘর পুড়ে, আর কেউ সেটাতে আলু পোড়া দিয়ে খায়’। এই সুযোগসন্ধানীদের অবস্থাও ঠিক তেমনি। প্রবীণ এই রাজনীতিকের মৃত্যু যেন তাদের সামনে ‘বড় সুযোগ’ হয়ে দেখা দিয়েছে! তাই হারিয়েছেন বিবেকবোধ! মেতেছেন ‘লোভলীয় এমপি’ পদের নিষ্ঠুর রাজনীতিতে!

ঘটনা এক.
গতকাল বৃহস্পতিবার এক বড় ভাই (ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দলের নেতা) ফেসবুকে একটা অনলাইন পোর্টালের লিংক পাঠালেন। সাথে লিখলেন, ‘কেমন আছ? আমি চিকিৎসা নিয়ে বাসায় আছি। ভাল আছি। সাবধানে থেক।’ ‘আমি চিকিৎসা নিয়ে বাসায় আছি’ খটকা লাগলো। তাকে প্রশ্ন করলাম আপনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন? বললেন, হ্যাঁ, রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১২ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন এবং সুস্থ আছেন। আমি ভাবলাম আমরা সাংবাদিকরা যেহেতু ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি, তাই হয়ত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তারপর অবাক হয়েছি। তিনি বললেন, ‘ঢাকা-৫ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা মারা গেছেন। সামনে ইলেকশন, তুমি খেয়াল রেখ।’ আশ্চর্য হলাম। কিছু বলিনি। লিংকটা ওপেন করে দেখি ‘কে হচ্ছেন ঢাকা-৫ এর পরবর্তী সাংসদ’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সেখানে লেখা হয়েছে ৬ মে। (ওই আসনের বর্তমান এমপি ৬ মে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে মারা যান।)

ঘটনা দুই.
রমজানে সেহরি শেষ করে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই বলে সকালে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখি। মিসকল আলার্ট চালু থাকায়, যথারীতি কোনো ফোন আসলে পরে কলব্যাক করি। আজও এমন একটি নম্বর (অপরিচিত) দেখে ফোন দিলাম। কে বলছেন ভাই- আমাকে ফোন করেছিলেন, আমি রনি বলছি। প্রতি উত্তরে ‘বড় ভাই আমি আপনার একজন ভক্ত!’ কে বলছেন- নাম অমুক, ডেমরা। ও, ভাই কি জন্য ফোন করেছিলেন বলেন। ‘ভাই আমি আপনার সংবাদ পড়ি। আপনার লেখা খুব ভাল লাগে। আপনি যা লেখেন- সবার মনের কথা বলেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সংবাদগুলো দলের প্রতিটি ত্যাগী-নিপীড়িত নেতাকর্মীর মনের কথা লেখেন। কয়েকদিন আগে যে লিড নিউজটা লিখছেন খুব ভাল লিখেছেন’--- এভাবে বলেই চলেছেন। এবার তাকে থামিয়ে বললাম, ভাই আমি রোজা রেখেছি, বাতাস দিয়ে ফুলাবেন না। কি জন্য ফোন করেছেন সেটা বলেন? এরপর যা বললেন, তার সারমর্ম হচ্ছে, তিনি ঢাকা-৫ আসনের খুবই ত্যাগী নেতা (যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত)। সামনে উপনির্বাচনে তিনি এমপি পদপ্রার্থী। এ সংক্রান্ত কোন নিউজ লিখলে যেন তার নাম লিখি এবং ছবিটা পত্রিকায় ছাপা হয়। সে অনুরোধের জন্য ফোন করেছেন। কারণ তিনি বিরাট ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতা। এরপর আবার শুরু করলেন, আমার প্রশংসা। সকাল বেলা রাগ আর আটকাতে পারলাম না-- থামুন। এসব চাপাবাজি করছেন কেন? গত ১৫ দিনে আমার বাইনেম-এ কোন লিড ছাপা হয়নি পত্রিকায়। আমতা আমতা করতে লাগলেন। ফোনটা কেটে দিলাম। (এরপর মনে পড়লো তিনি গত সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন)।

ঘটনা তিন.
দুপুরের দিকে এক সাবেক ছাত্রনেতা ফোন করলেন। আমার ও আমার স্ত্রীর খোঁজ-খবর নিলেন। ভাবলাম দীর্ঘদিনের চেনা-জানা তাই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। কথায় কথায় তার মূল উদ্দেশ্য আমাকে বললেন। তার কথার সারমর্মও একই। তবে কিছুটা ভিন্নতা আছে। তিনি নিজে প্রার্থী নন। তিনি জানালেন, এখানে (ঢাকা-৫ আসন) অমুক নেতা (একটি থানা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল পদে আছেন) তার খুব কাছের মানুষ। খুব ভাল মানুষ। দীর্ঘদিন রাজনীতি করে কিছুই পায়নি। তাই আসন্ন উপনির্বাচনে তিনি যেন মনোনয়ন পান, এ জন্য দলের প্রতি তার ত্যাগ ও অবদানের কথাগুলো যেন সবার দৃষ্টি আকর্ষণে আসে। এ জন্য একটা ভাল সংবাদ লিখতে হবে। এমনিতে গত কয়েকদিন মনটা ভাল নেই। বলা যায় শরীরও। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, প্রথমে ভেবেছিলাম, ভালবেসে খোঁজ নিচ্ছেন। এরপর উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভাবলাম অন্যের মতো আপনিও প্রার্থী হবেন। কিন্তু না, অন্যের হয়ে দালালি করতে ফোন দিয়েছেন! (যদিও এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কী করবো? ওই যে মন ভাল নেই। মেজাজটা খিটমিটে হয়ে আছে।) মনে হলো, সে রাগ করেছে। তাকে শান্তনা দিতে গিয়ে বললাম, ভাই রাগ করবেন না। আমরা তো ভাই-ভাই। মনমেজাজ ভাল নেই। তাই ভাই হিসেবে বলেছি ‘দালালি’ করার কথা বলছি, রাগ করবেন না প্লিজ। সেও বললেন, আপনার সাথে কি রাগ করার সর্ম্পক? বললাম, ভাই শোনেন- আপনি এবং আমি দু’জন কম-বেশি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ভাল করে চিনি ও জানি। প্রধানমন্ত্রী তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেশ চালান না। আর উনি জেগে থাকেন বলেই আমরা এখনো শান্তিতে ঘুমাই-কী বলেন? তার জবাব, ‘একেবারে সঠিক কথা বলেছেন ভাই’। আরো বললাম, বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর তথ্যও আছে। পত্রিকায় লিখে কি মনোনয়ন পাওয়া যাবে? আর বঙ্গবন্ধুর মেয়ে কি পত্রিকা পড়ে দলের মনোনয়ন দেয়? আমার মনে হয়, পরিবার থেকেই কেউ একজন মনোনয়ন পাবেন- এটা ব্যক্তিগত ভাবনা। তিনি আমাকে বললেন, ভাই ওই পরিবারে নিজেরাই ঠিক নাই। সে কারণে পরিবার থেকে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভবনা কম। এরপর জরুরি একটা ফোন আসছে বলে ফোনটা কেটে দিলাম।

আমার উপলব্ধি: একজন মানুষ মারা গেল মাত্র তিনদিন। তিনি চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। যেদিন তিনি মারা গেলেন সেদিনই একটা অনলাইন পোর্টাল নতুন মুখের সন্ধান করে সংবাদ লিখলেন (সংবাদটা সম্ভবত মোল্লার দাফনের আগেই করা)। জোট শরিক নেতা হয়ত নৌকায় চড়তে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন না পেলেও সেই যুবলীগ নেতা এখন এমপি মনোনয়ন চান। যারাই রাজনীতি করেন, তারাই দলের কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেয়র, এমপি-মন্ত্রী হবেন এমন আশা করতেই পারেন। আর করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের চাওয়াকেও খাটো করে দেখছি না। সন্মান জানাই। তাদের প্রত্যাশা দোষের কিছু না। কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পায়নি বলে এমপি পদে মনোনয়ন পাবেন না.. এটা বলছি না। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মাত্র ১৭ ভোট পাওয়া ব্যক্তিও বর্তমান সংসদের এমপি হয়েছেন (স্বতন্ত্র)। কিন্তু শোকটা কাটিয়ে উঠতে হবে তো নাকি? মারা যাওয়ার দিনই সংবাদ লিখতে হবে? এখন থেকেই সাংবাদিকদের কাছে নাম লেখা ও ছবি ছাপাতে ধর্না দিতে হবে? পত্রিকায় লিখে বা ছবি ছাপিয়ে মনোনয়ন পাওয়া যাবে? আবার অন্যের হয়ে পত্রিকায় নাম ছাপাতে দালালি করতে হবে? একটি আসনের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এমপিকে ঘিরেই হয়ে থাকে। আমরা যতই মুখে বলি, আগে দল, পরে এমপি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সে কারণে এমপি পদ একটা লোভনীয় পদ। কিন্তু এমন নিষ্ঠুর রাজনীতি কেন? লিপ্সার রাজনীতি কেন? করোনার এই কান্তিকালেও আমাদের মানবিক শিক্ষা হলো না? বাবার মরদেহ ছুঁয়ে দেখে না সন্তান। প্রিয়তমা স্ত্রীর সামনে ছটফট করতে করতে মারা যায় স্বামী। দাফন-কাফনে অংশ নেয় অন্যরা। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে চাচ্ছেন, ভাল কথা। কিন্তু শোকটাকে কাটিয়ে উঠতে দিন। করোনার ধকল কাটিয়ে উঠুন। গণসংযোগ শুরু করুন। তারপর পত্রিকায় নিজের নাম ছাপানোর প্রতিযোগীতায় নামুন। একবার কি ভেবেছেন, আপনি যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাহলে আপনার লাশটা কি সন্তান কাধে নেবে? দাফনে অংশ নেবে? গত কিছুদিন হলো কি দেখছেন? শিক্ষা হয় না?

পাদটিকা : আমি কাউকে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে লেখাটি লিখিনি। আসলে আমার উপলব্ধি শেয়ার করছি মাত্র। এতে কেউ যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে ছোট ভাই-বন্ধু মনে করে নিজগুণে ক্ষমা করবেন। হয়ত এটাও হতে পারে আপনাদের কাছে আমার শেষ ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ। কারণ কারোনা নামক প্রাণঘাতী ভাইরাসে কে কখন মারা যাবো তা তো বলা যায় না...

লেখক : সাংবাদিক।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর