২ জুন, ২০২০ ২১:০৯

মানুষ ও মানবিকতা খুব তুচ্ছ আর ঠুনকো এখানে

বাণী ইয়াসমিন হাসি

মানুষ ও মানবিকতা খুব তুচ্ছ আর ঠুনকো এখানে

বাণী ইয়াসমিন হাসি

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আপনজনেরা। প্রায়ই কথা হয় বিভিন্ন ইস্যুতে। গত কয়েকদিন ধরে নানা সংকট নিয়ে কথা হচ্ছে। আমার প্রিয়জনেরা প্রায় সবাই-ই অসুমলিম দেশে থাকেন। একটা ব্যাপার বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে ঐসব দেশে রমজানে জিনিসপত্রের দাম কমানো হয় এবং সুপারশপগুলোতে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা থাকে। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের মত একটা মুসলিম ‌অধ্যুষিত দেশে রমজানের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের যে লাগামহীন উর্ধ্বগতি এটা নিয়ে চেতনাবাজ বা ধর্মের নামে যারা সারাদিন আস্ফালন করে তাদের কেউ কি কোন বক্তব্য, কর্মসূচী বা প্রতিবাদ করেছে? এদেশের ৯৫ ভাগ মানুষ খুব কষ্ট করে হিসেবের টাকায় সংসার চালায়। মাস শেষে ৫০০ টাকা অতিরিক্ত খরচও যাদের কাছে বোঝা বলে মনে হয়। ফেসবুকে ইফতার আর সেহরিতে নিত্য নতুন চেক ইন আমার আসল বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। যারা কথায় কথায় ফতোয়া দেয় আর ইসলাম গেলো গেলো বলে রব তোলে তাদের মুখেও এ বিষয়ে কোন প্রতিবাদ নেই।

সাধারণত সুপার শপগুলোর উপর আমি খুব ভরসা করি। যদিও দুই দিন পর পরই আগোরা থেকে উল্টাপাল্টা জিনিস কিনে আনি। গত বছর প্রথম রোজায় আগোরা থেকে একটা তরমুজ কিনি। কেনার আগে বলি কেটে দেখান। সেলসম্যান বললো- কাটতে হবে না ম্যাম, একদম ফ্রেশ, আজই আসছে। কড়া মিষ্টি হবে। আরো কিছু কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলাম। ইফতারের আগে তরমুজ কেটে দেখি পুরো সাদা। মেজাজ ভয়াবহ খারাপ হলো। অনেকটা জিদ করেই ইফতারের পরপরই তরমুজ টা নিয়ে আগোরায় গেলাম। ব্যাটাকে পাকড়ালাম। প্রথমে অস্বীকার করলো প্রডাক্টটি নাকি তাদের না। আমার হৈচৈ এ অন্য ক্রেতারাও জড় হলো। তরমুজের গায়ে তাদের সীল এবং আমার কাছে থাকা রিসিট মিলিয়ে এক ক্রেতা বললেন আরে এটা তো কিছুক্ষণ আগে আপনাদের এখান থেকেই কেনা। তাদের জোচ্চুরি হাতে নাতে ধরা পড়ায় সবাই মিলে স্যরি বলতে লাগলো।

আমার বাসার পাশে মিঠাই। আমি প্রায়ই ওখান থেকে খাবার-দাবার কিনি। দইয়ে মাঝে মাঝেই মাছি আর তেলাপোকার ঠ্যাং পাই। আমার আগের বাসায় তেলাপোকা ছিল। ভাবতাম বাসা থেকেই হয়তো গেছে। কিন্তু নতুন বাসাটাতে আমরাই প্রথম ভাড়াটে। কোন মাছি বা তেলাপোকা নেই। কিন্তু মিঠাইয়ের দইয়ে সেদিনও তেলাপোকার ঠ্যাং পেলাম। লাখ লাখ টাকার চটকদারী বিজ্ঞাপনের ভিড়ে পণ্যের মান তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই ভেজালের কারবারিরা ইয়াবা ব্যবসায়ীর চেয়ে কোন অংশেই কম অপরাধী না।

আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লায় চলাচলকারী (ঢাকা মহানগর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগর) বাস ও মিনিবাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। রবিবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিআরটিএ সংস্থাপন শাখা থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লা রুটে চলাচলকারী বাস/মিনিবাস, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস/মিনিবাস এবং ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা ১ জুন সোমবার থেকে কার্যকর হয়েছে।

তবে বর্ধিত ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, একজন যাত্রীকে বাস/মিনিবাসের পাশাপাশি দুইটি আসনের একটি আসনে বসিয়ে অপর আসনটি অবশ্যই ফাঁকা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটে উল্লেখিত মোট আসন সংখ্যার অর্ধেকের বেশি যাত্রী বহন করা যাবে না এবং দাঁড়িয়ে কোনো যাত্রী বহন করা যাবে না।

এ ছাড়া অনুমোদিত এই ভাড়ার হার করোনাভাইরাসজনিত সংকটকালের জন্য প্রযোজ্য হবে উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এ সংকট দূর হলে আগের ভাড়া প্রযোজ্য হবে। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? পাশের সিট খালি রাখা তো দূরের কথা রীতিমত যুদ্ধ করে যাত্রীরা বাস-মিনিবাসে জায়গা করে নিচ্ছে। বসার জায়গা তো বাদ; দাঁড়ানোর জায়গায়ও নেই অধিকাংশ বাসে। আজকের রাজধানীর চিত্র এটি। আর এদেশে কোনকিছু একবার বাড়লে সেটা সাধারণত আর কমে না। করোনা পরবর্তী স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই বর্ধিত বাস ভাড়া কমবে বলে বিশ্বাস হয় না।

করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবর প্রকাশের পর থেকেই দেশের ওষুধের দোকানগুলোয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, সকল প্রকার জীবাণুনাশক এবং মাস্কের সংকট দেয়া দিয়েছে। অনেক জায়গায় কয়েকগুণ চড়া দামে মাস্ক বিক্রি হচ্ছে বলে ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন। করোনা মোকাবেলায় কার্যত লকডাউন হয়ে থাকা দেশে কর্মহীন মানুষ দিশেহারা। এ অবস্থায়ও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। অথচ গণপরিবহনে সংকট থাকলেও বাজারে পণ্য সরবরাহ প্রায় স্বাভাবিকই আছে।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর দেওয়া তথ্যমতে, গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে প্রতিকেজি মশুরের ডালে দাম বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সাত দিনে কেজিতে পিয়াজের ‍দাম ২১ শতাংশ এবং রসুনের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৪ শতাংশ, টিসিবি আদার দাম কেজিতে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়ার তথ্য দিলেও আদতে ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই পণ্যটির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি আদা এখন ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। লেবুর দাম বেড়েছে কয়েকগুণ।

পৃথিবীর সব দেশে যেকোন দুর্যোগে বা বিশেষ অবস্থায় পণ্য এবং সেবার দাম কমে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং জরুরি সেবা রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। আমাদের প্রিয় দেশটা সবসময় যেন উল্টো পথেই হাঁটে। সব জায়গায় রমজানে নিত্যপণ্যের দাম কমলেও; আমাদের এখানে বাড়ে। এই করোনা কালেও আমরা দেখছি বাজারে আগুন। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি টাকা আদায় করছে কোভিভ-১৯ এর টেস্টে। আবার কোন কোন হাসপাতাল শুধু তাদের ভর্তি রোগীর টেস্ট করছে। তাই টেস্ট করাতে কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছে।

জীবনটা অনেক ছোট কিন্তু সুন্দর। তবে সেই সুন্দর জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য প্রাচুর্য নয়, দরকার একটা মানবিক মন। আমার আপনার আশেপাশে কত মানুষ না খেয়ে আছে। সেটা আমরা নিচু হয়ে তাকিয়ে দেখি না। কারণ সবার চোখ উপরে। আমাদের যা আছে আরও চাই। আজ আপনি আমি মারা গেলে একখণ্ড সাদা কাফনের কাপড় ছাড়া সাথে করে কিছুই নিয়ে যেতে পারবো না। তারপরও শুধু চাই আর চাই। আমাদের চাহিদার শেষ নেই। শেষ ঠিকানা সাড়ে তিন হাত মাটি।

আমার মা বলতেন, আজ মরলে কাল দুইদিন। আসলে জীবন সব সময়ই অনিশ্চিত। এই করোনা কালে সেই অনিশ্চিয়তা আরও বেড়েছে। কিন্তু আমাদের লোভ একটুও কমেনি। বাড়েনি একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা। যে যেভাবে পারছি শুধু ব্যবসাটাই করছি। মানুষ ও মানবিকতা খুব তুচ্ছ আর ঠুনকো এখানে।

লেখক : সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর