৮ জুন, ২০২০ ১৫:৫৪

বদলে গেছে পৃথিবী

আহমেদ আল আমীন

বদলে গেছে পৃথিবী

আহমেদ আল আমীন

রিপ ভ্যান উইঙ্কলের দরকার নেই; কুম্ভকর্ণের মতো ছয় মাস ঘুমিয়ে বাইরে নামলে আজকের পৃথিবীকে এখনকার কেউ আর চিনতে পারবে না। বারবার চোখ কচলে, হাতে চিমটি কেটেও অবাক হবেন তিনি। বিশ বছরে যে পরিবর্তন দেখেছিলেন রিপ, তার চেয়ে বেশি পরিবর্তনের মুখোমুখি হবেন তিনি, তবে ভিন্নভাবে। ছয় মাস পর জেগে উঠেও কুম্ভকর্ণের কাছে এতটা অচেনা মনে হয়নি পৃথিবী।     

আজকের পৃথিবীতে কুম্ভকর্ণ ঘুম থেকে উঠেই হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে নাশতার টেবিলে কিছু পাবেন না। রেগে মেগে বাইরে এসেও একই অবস্থা দেখবেন। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। এত মানুষ গেল কই? 

বদলে গেছে পৃথিবী। বহমান এই সময়ে বদলে গেছে চারপাশ। ঘরের ভেতর ও বাহির। বাড়ির আনাচে কানাচে নতুন চেহারা। নবরূপে প্রকৃতি ও পরিবেশ, চির কাঙ্খিতরূপে। 

ভারসাম্য আসছে জীবন ও খাদ্যচক্রে, বাস্তুসংস্থানে। নদী আর সাগরে স্বাভাবিক গুণ ও মানের পানি। জলজ ও উভচর প্রাণিদের ক্রীড়া। ডলফিনের ডিগবাজি, মাছের সাঁতারের ধরনে মনে হয়, রাজ্য পুনরুদ্ধারের আনন্দে মেতেছে ওরা। কোথাও কারো হারিয়ে যাবার নেই মানা। নদীর পাড়ে, সাগর তীরে বাড়-বাড়ন্ত ঘাস ও লতার নৈপুণ্য, দস্যিপনা; মাকড়শার জাল, পিঁপড়া ও কাঁকড়ার আলপনা। বদলে গেছে পরিবেশ। 

জলে, জঙ্গলে, বনে ও পাহাড়ের এমন সব আদিম অধিবাসী বড় নিশ্চিন্ত, নিরাপদে। ঘর ছেড়ে বাইরে, ঘুমায় দুয়ার খুলে। বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খাবে শুনে সিংহের পিঠে চড়ে হরিণ এসেছে নদীর পাড়ে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে শিয়াল। খরগোশের সেলফিতে উঠে এসেছে সেই ছবি। এই ছবি সর্বশেষ কে দেখেছে কবে? পৃথিবী দেখেনি বহুদিন। 

বদলে গেছে মানুষ। বাইরে মানুষের আনাগোনা কম। মনে হয় কবুতরের খোঁপে ঢুকে পড়েছে। র‌্যাডিক্যাল চেঞ্জ এসেছে মানুষের মনে ও আচরণে। ভালো মানুষ আরো ভালো। কিছু মন্দ মানুষ হয়েছে আরো খারাপ ও স্বার্থপর। আর কিছু মন্দ মানুষ হয়েছে ভালো মানুষ। পশুত্বের স্তর থেকে উন্নীত হয়েছে মনুষ্যত্বে। বদলে গেছে চেহারা। বদলে গেছে দৃষ্টিভঙ্গি।
মানুষ সম্বিত ফিরে পেয়েছে যেন। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ধীরে ধীরে স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করেছে। বুঝে গেছে, এ পৃথিবীতে একা ভালো থাকা যায় না। কেউ তা পারেনি। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে এখানে। নিজের ভালো থাকার জন্যই অন্যকে, প্রতিবেশিকে কিংবা পরিবেশকে ভালো রাখতে হবে। কারণ পৃথিবী তোমার একার নয়, সবার আছে অধিকার।

একদা স্বার্থপর মানুষ এখন মানবিক। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় বেশ মনোযোগী। দায়িত্ববোধ বাড়ছে। ধর্ম-বর্ণের ভেদ ভুলে মানুষের কাতারে সবাই। মানুষটা জেগে উঠেছে প্রতিটি মানুষের মনে। এখন গরীব-অসহায় কিংবা প্রান্তিক মানুষের কথাও তার ভাবনায় থাকে। মানবিকতা, ঔদার্য, মৃত্যুভয়, সততা, দায়িত্ববোধ, সহানুভূতি, আত্মত্যাগ ও সবারে নিয়ে ভালো থাকার মানসিকতা তৈরি হয়েছে মানুষের মনে। 

বদলে গেছে সময়। বদলে গেছে আপন ও পর। সব আপন আসলেই আপন নয়। সব পর আসলে পর নয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আপন ও পরের আসল পরিচয় প্রকাশ পায়। দূরে থেকেও কাছাকাছিও হওয়া যায়। কাছাকাছি হলেও দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বদলে গেছে মানুষের মৃত্যুর ধরন ও দৃশ্যপট। বহমান এই সময়ে মশা-মাছি কিংবা কুকুর-বিড়ালের মতো যেখানে সেখানে মারা পড়ছে মানুষ। কে যেন জাম গাছের ডালে চড়ে কষে নাড়া দিয়েছে! আর কাঁচা, পাকা জামগুলো ঝরে পড়েছে একে একে। বৃষ্টি কিংবা গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ছে মানুষ। লাশের সারি বেশুমার। রাস্তাঘাটে, বনে-বাদাড়ে, সাগর-পাহাড়ে কিংবা ঘরের ফ্লোরে, পঁচা ড্রেনে। কে, কাকে টেনে তুলবে, আশ্রয় দেবে অথবা ভরসা দেবে! সবাই ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জীবন কিংবা মৃত্যু থেকে। 

কারও মৃত্যু এখন কাউকে স্পর্শ করে না। লাশের কাছেও কেউ যায় না।  নেই কোনো বন্ধু বা স্বজন। সমাজ, সংসার থেকে মানবের এমন অসম্মানের বিদায় এখন যত কঠিন তত বাস্তব। মানুষ এখন আবেগ, বিবেক বিসর্জন দিয়ে মনুষ্যত্বহীন। কখনো বা দায়িত্বহীন। কেউ কারও না। জানাজা বা দাফনে কেউ আসে না। মানুষ আজ বড় বাস্তববাদী ও স্বার্থপর। এ সময়ে আজ বেঁচে থাকাটাই বড় অর্জন। আসলেই সময় আগের মত আর নেই। একই সঙ্গে মানবিক ও অমানবিক। আচরণের বৈপরীত্ব প্রকাশ হয়ে হয়েছে। মানুষের অস্তিত্বজুড়েই টান পড়েছে। ঘরে ঘরে বন্দি মানুষ। বিশ্বটাই আজ কারাগার। সীমানাগুলো বন্ধ। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কলের চাকা ঘুরে না। কারখানা বন্ধ। ইঞ্জিন চলে না। সভ্যতা যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। 

কাজের ধরন বদলে গেছে। অফিসই কাজের একমাত্র জায়গা নয়। প্রমাণিত হয়েছে, চাইলে ঘরেও অনেক কাজ করা যায়। ঘরের কাজ সবাই করতে পারে। কাজের লিঙ্গভেদ নেই বললেই চলে। যে কোনো অবস্থায়ই কাজ করতে হবে। 

বদলে গেছে অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাস। উদাসীন পথিকও এখন সুস্থতায় খোঁজে নিয়মিত পুষ্টিকর, সতেজ ও সুষম খাবার। মাছ, গোশত বেশি নয়, সবজি হলে ভালো হয়। আদা, রসুন, কালোজিরা, লবঙ্গ ও দারুচিনি। দিনে কিছু সময়ের ব্যায়াম। বদলে গেছে লাইফস্টাইল। বদলে গেছে রুটিন। বদলে গেছে কথা বলা। বদলে গেছি এই আমি। আর আপনি?

বিডি প্রতিদিন/আল আমীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর