১০ জুন, ২০২০ ০৮:৩১

ফ্লেম অব লিবার্টি লেডি ডায়নার স্মৃতিস্তম্ভ নয়

মাসুদুল হাসান রনি

ফ্লেম অব লিবার্টি লেডি ডায়নার স্মৃতিস্তম্ভ নয়

অনিন্দ্যসুন্দর শহর প্যারিসকে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সেইন নদী। সেই নদীর পাশে আলমা ট্যানেল। আইফেল টাওয়ার থেকে তিন চার মিনিটের হাঁটাপথের দূরত্ব। একসময় আলমা ট্যানেলের নাম কেউ জানতো না। সারাবিশ্বে আজ ট্যানেলটির নাম মুখে মুখে। এই ট্যানেল থেকে পাপারাজ্জিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হবার সময় লেডি ডায়না ও তার বন্ধু ডোডি আল ফায়েদ গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই থেকে আলমা ট্যানেল বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। একই সাথে প্যারিস ভ্রমণে আসা লক্ষ লক্ষ ডায়নাপ্রেমী ছুঁটে আসেন দুর্ঘটনাকবলিত স্থানটি দেখতে। তাদের কারণে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ট্যানেলের ওপর স্থাপিত স্ট্যাচু ফ্লেম অফ লিবার্টির কথাও।

প্যারিস ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীরা আইফেল টাওয়ার ঘুরে হেঁটে হেঁটে চলে আসেন আলমা ট্যানেলের কাছে। সেইন নদীর তীরবর্তী রাস্তার ওপর ফ্লেম অফ লিবার্টির সামান্য দূরে রয়েছে ভুগর্ভস্থ আলমা মেট্রোস্টেশন। প্রায় সবাই ফ্লেম অফ লিবার্টি দেখে আলমা মেট্রোস্টেশন থেকে মেট্রো চেপে শহরে ফিরে আসেন।

আমার কাজিন বাবু ও তার বন্ধু জনিসহ সেইন নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি আলমা ট্যানেলের সামনে। আমাদের তিনজনের আগ্রহ লেডি ডায়নার গাড়ির দুর্ঘটনাস্থল দেখা। একই সাথে জানার আগ্রহ মানুষ কেন ফ্লেম অফ লিবার্টিকে ডায়নার স্মৃতিস্তম্ভ মনে করে ফুল দেয়?

ফ্লেম অফ লিবার্টি যে ডায়নার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নয়, এ কথাটি বেশ ক'দিন আগে বলেছিলেন প্যারিস নিবাসী আলোকচিত্রী শওকত হোসেন হাওলাদার। আমি যার হাত ধরে প্যারিস চিনেছি।

আমরা প্রথমে রাস্তার ওপরে ফুটপাথে স্থাপিত ফ্লেম অফ লিবার্টি দেখি। ১৯৮৯ সালের মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনের শতবর্ষপুর্তিতে নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ফ্লেমের আদলে তৈরি এই স্মারকটি আলমা ট্যানেলের ওপর স্থাপন করা হয়।

সোনালী রঙের গিল্ডেড স্ট্যাচুটি ফ্রান্স এবং আমেরিকার বন্ধুত্বের প্রতীক। আসলে স্মৃতিস্তম্ভটি কিছুই নয়। ব্রিটিশ রাজবধূ ও মানুষের মনের সম্রাজ্ঞী ডায়ানার প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই এর অবস্থান। তাই অনেকেই এটিকে ডায়ানার স্মৃতিস্মারক ভেবে ভুল করেন। প্রকৃতপক্ষে ফ্লেম অফ লিবার্টির সাথে ডায়নার কোনও সম্পর্ক নেই। এর সাথে সম্পর্ক আছে শুধু নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির। ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর ফ্রেডেরিক অগাস্ট বার্থোল্ডি স্ট্যাচু অফ লিবার্টি নির্মাণের পর ফ্রান্স বন্ধুত্বের নির্দশন হিসেবে আমেরিকাকে দিয়েছিল। শত বছর পর আমেরিকা হেরাল্ড ট্রিবিউনের শতবর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে ফ্লেম অফ লিবার্টি ফ্রান্সকে উপহার দেয়।

প্লাস দ্যু এল'আলমা'র এই ফ্লেম অফ লিবার্টিটি সোনার পাতায় ঢাকা। ধূসর এবং কালো মার্বেল পাথরের বেদীতে স্থাপিত। ৩.৫ মিটার লম্বা মানে ১১.৪৮ ফিট উঁচু। বেদীর চারপাশে শিকল দিয়ে ঘেরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষজন এখন লেডি ডায়নার স্মরনে বেদীর নীচে পুস্পস্তবক অর্পণ করে। শিকলে ভালবাসার বন্ধনের প্রতীক ছোট ছোট তালা ঝুলিয়ে দেয়। অনেকে ডায়নার ছবিসহ ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমাদের বাসায় ফেরার তাড়া ছিল। বাবু ও আমার ফোনে ছোটবোন ফারহানা বারবার কল ও মেসেজ দিচ্ছে। 'ভাইয়া, কখন আসবেন। খাবার ও চা কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে '। সান্ধ্যজলখাবার, গরম চা কি আর উপেক্ষা করা যায়?

আমরা গল্প করতে করতে প্লেস দ্যু এল'আলমার নীচে ট্যানেলের মুখে দাঁড়াই। হেঁটে ট্যানেলের ভেতর যাওয়া নিষেধ। দূর থেকে যতোটুকু সম্ভব ট্যানেলের তেরো নাম্বার পিলারটি শনাক্ত করার চেস্টা করি। এই পিলারটিতে ডোডি আল ফায়েদের মার্সিডিজ এস২৮০ মডেলের কালো রঙের গাড়ি ধাক্কা খেয়ে মারাত্বক দুর্ঘটনায় পড়েছিল।

১৯৯৭ সালের ৩০ অগাস্ট রাতে ডায়ানা ও ডোডি প্যারিসের হোটেল রিৎজ থেকে ডিনার শেষে রুয়ে আর্সেনে হুসে'র এপার্টমেন্টে ফিরছিলেন। পিছু লাগা পাপারাজ্জিদের এড়াতে গিয়ে ড্রাইভার তীব্রগতিতে গাড়ি চালিয়ে ট্যানেলে ঢুকে পড়ে। এক পর্যায় ড্রাইভার তাল সামলাতে না পারায় তেরো নাম্বার পিলারের সাথে গাড়ি প্রচন্ডবেগে ধাক্কা খায়। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাবেক প্রিন্সেস অব ওয়েলস। গাড়ির চালক ও ডোডি ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাদের দেহরক্ষী ট্রেভর রিস-জোনস গুরুতর আহত হন।

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলে ডায়না রাজপ্রাসাদ ছেড়েছিলেন। ছেলেদের নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন একা। দাঁড়িয়েছিলেন মানুষের পাশে।
১৯৯৭ সালে ল্যান্ডমাইন ও এইডস বিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল বিজয়ী নেলসন মেন্ডেলাসহ কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিনেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তার জীবনের অবসান ঘটে।

মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে লন্ডনের রাস্তায় নজিরবিহীন জনতার ঢল নামে। যা সামলাতে ৩০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করতে হয়। সমগ্র ব্রিটেনেএক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় এবং হাজার বছরের ঐতিহ্য ভঙ্গ করে প্রথমবারের মত বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের উপর উড্ডীয়মান রাজপতাকা নামানো হয়। তারপর প্রসাদের উপর উড্ডীয়মান ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ অর্ধনির্মিত করা হয়। যা রাজা বা রাণীর মৃত্যু হলেও অর্ধনির্মিত করা হয় না।

৩৬ বছর বয়সী ডায়ানার মৃত্যুর এ ঘটনাকে ভিত্তি করে ২০০৭ সালে হলিউডে সিনেমা হয় 'দ্য মার্ডার অব প্রিন্সেস ডায়ানা'। এ সিনেমায় ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের চরিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার ও বাফটা পুরস্কার জিতেছিলেন হেলেন মিরান।

বিকেলের আলো ম্লান হয়ে যাওয়ায় আমরা উপরে উঠে আসি। আমাদের তিনজনের মন কিছুটা বিষন্ন। চুপচাপ হাঁটি। বাসায় ফেরার তাড়া আছে। আলমা মেট্রো স্টেশনের দিকে হেঁটে যেতে যেতে শুনি, ডায়নাকে নিয়ে স্যার এলটন জনের গাওয়া গান 'ক্যান্ডল ইন দি উইন্ড। '
Goodbye England's rose / May you ever grow in our hearts/ You were the grace that placed itself / Where lives were torn apart / You called out to our country/ And you whispered to those in pain/ Now you belong to heaven /And the stars spell out your name....

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর