২৩ জুন, ২০২০ ১৪:৪৬

আমাদের সেই আনন্দবাজার

জয়ন্ত ঘোষাল

আমাদের সেই আনন্দবাজার

অভীকবাবু তাঁর দীর্ঘ সম্পাদক জীবনে আনন্দবাজারকে এক নতুন অভিমুখ দিলেন। তিনি আনন্দবাজারকে পৃথিবীর সেরা সাংবাদিকতার উৎকর্ষের সঙ্গে মেলাতে চাইলেন। তিনি নিজে লন্ডনে গিয়ে স্যার হ্যারল্ড ইভ্যানের কাছে সাংবাদিকতার পাঠ নেন।

অভীকবাবু দ্য টেলিগ্রাফ শুরু করেন ৮৫ সালে। কলকাতায় বসে থাকলেও তিনি ছিলেন গ্লোবাল। আমি বলতাম, আপনি হলেন গ্লোকাল। গ্লোবালি লোকাল। বাংলার মানুষ দুনিয়ায় কি হচ্ছে তা জানলেও অনেকসময় কিছু কিছু বিষয় জানতে পারে না। দুনিয়ায় কি হচ্ছে কলকাতায় বসেও তিনি তার সব কিছুর updated হতে চাইতেন। তিনি ABP নিউজ চালু করলেন । ABP ইলেক্ট্রনিক চ্যানেল- হিন্দি, বাংলা, মারাঠি এসবই আনন্দবাজারের মাথায় নতুন পালক।

তিনি আনন্দবাজারকে পাঠকের চাহিদা অনুসারে লঘু না করে দিয়ে, দিতে চান এক নয়া উৎকর্ষ। তিনি সবসময় বলতেন, পাঠক যা চাইছে তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে কাগজ বিক্রি করা আমার কাজ নয়। পাঠক জানে না সে কি চায়। আমি বলবো পাঠকের কি প্রয়োজন? তিনি গুণের মান দিতেন। সম্রাট আকবর যেমন দিয়েছিলেন তাঁর নবরত্নসভাকে। আনন্দবাজারে আমাকে ওরা অনেক বেতন দিয়েছে। এই বেতন বৃদ্ধির পূর্ণ কৃতিত্ব অভীকবাবুর। বর্তমান থেকে আমাকে আনন্দবাজারে নিয়ে আসার সময় তৎকালীন Executive Editor সুমন চট্টোপাধ্যায়কে বলেন, অন্যের টিমে ম্যারাডোনা কেন খেলবে? খেললে আমার টিমে খেলবে। যে টিম নাম্বার ওয়ান। উপসাগরীয় যুদ্ধে সুদীপ্ত সেনগুপ্তকে পাঠান, সুমনদাকে শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া, সেখানে গিয়ে সুমনদা প্রভাকরণের সাক্ষাৎকার করে এনেছে। এসব চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি মনে করতেন, উৎকর্ষের জন্য অর্থব্যয় করতে হয়। গৌতম ভট্টাচার্যের মতো ক্রীড়া সাংবাদিককে ব্র্যান্ড বানানো ছিল অভীকবাবুর ম্যাজিক। তার জন্য তাঁকে একের পর এক বড় বড় ম্যাচ, বড় বড় ইভেন্টে বিদেশের নানা দেশে পাঠান। এতে রাজকোষে টান পড়ে কিন্তু অভীকবাবু যে সময় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন আনন্দবাজার সাম্রাজ্য সাফল্যেরও চূড়ান্ত শীর্ষে। বলা যায় তখন মুঘল আমলের আকবর বাদশার জমানা। তবে সবাই কি ব্র্যান্ড হতে পারে? জহুরি জহর চিনতেন।  সুমন দে ছিলেন স্টার নিউজের হিন্দি চ্যানেলের কলকাতা প্রতিনিধি। সুমনের অধ্যবসায় অসীম। যোগ্যতা আছে কিন্তু অভীকবাবু না থাকলে সুমন দে সুমন দে হতেন না।

সাংবাদিক হিসেবে একথা তো বলাই যায়, ম্যানেজমেন্ট যত গুড় ঢালবে ততই সাংবাদিকতা মিষ্টি হবে। আমি বর্তমান থেকে এসেছিলাম। সেখানে বরুণবাবু কাট ইওর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইওর ক্লথ এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। তাই বিদেশে গেলেও আমরা টেনেটুনে চালাতাম। হোটেলে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদেশে চিরকাল রুম শেয়ার করতাম। আনন্দবাজারে এসে বিদেশে প্রথম সিঙ্গল অকুপ্যান্সিতে থাকলাম অনেক ডলার দিয়ে। অবশ্য বরুণবাবুও আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সমস্ত সফরে পাঠাতেন। অভীকবাবুও বলে দেন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি সফরেই তুমি যাবে। তাতে ওদের কাছে তোমার গুরুত্ব বাড়বে। তুমি খবর পাবে। এটা আনন্দবাজারের জন্যই প্রয়োজন। এর ফলে জীবনের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার অনেক ভরেছে নানা মুক্তো মাণিক্যে।

অভীকবাবুর এই উদারতার সুযোগও অনেকে নিয়েছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ তিনি রাখতেন না এ ব্যাপারে। অনেক ক্ষেত্রে ধরে নিতেন শতকরা ২/৩ ভাগ অপচয়, নয়-ছয়ও হবে। এটা অনেকটা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে TDloss’এর (ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন লস) মত, তবে এই স্বর্ণযুগ ইতিহাসে কখনই স্থায়ী হয় না। গোটা দেশের বিশেষত বাংলার অর্থনীতিতে অবক্ষয় শুরু হয় সিপিএমের জমানাতেই। রাজ্যের অর্থনীতি যদি অবক্ষয়ের শিকার হয় তবে সংবাদপত্রগুলোতেও তার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে। অভীকবাবুর সাধের আনন্দবাজারও আর্থিক অনটনে পড়ে। আজও সে সংকট কাটেনি। আনন্দবাজারের উৎকর্ষের শ্লাঘা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যাতে গ্রামাঞ্চলের সার্কুলেশনে ধাক্কা লাগে। ‘বর্তমান’ ক্রমশ রাজ্যে বাড়তে থাকে। nature abhors vaccum. আনন্দবাজারের অবক্ষয়ে বর্তমানের শ্রীবৃদ্ধি। মতাদর্শ বা সাংবাদিকতার উৎকর্ষের চেয়েও বড় প্রশ্ন হল আম জনতা, আমরা বলতাম মাছওয়ালা-পটলঅয়ালা-আলুওয়ালা আনন্দবাজার পড়ছে না, ‘বর্তমান’ পড়ছে। ফলে অমর্ত্য সেনের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার হতে পারে কিন্তু রাজ্যের সাধারণ মানুষের কাগজ হয়ে ওঠে বর্তমান। ব্যবসায় সংখ্যা সবচেয়ে বড় কথা। সংখ্যা ব্রহ্ম!

তবে অভীকবাবু একজন সম্পাদক ও মানুষ হিসেবে কিন্তু অতুলনীয়, অনবদ্য। পনেরো বছর ওনার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে কাজ করেছি। শুধু দেশে নয় বিদেশেও ওনার সঙ্গ পেয়েছি। নিউইয়র্ক বা লন্ডনে। অভীকবাবুর গপ্পো শুরু করলে এত সহজে তো শেষ হবে না।

শুধু কি সাংবাদিকতা? তিনি শেখাতেন ডাইনিং এটিকেট। চা খেলে দুধগুলে চামচটা টেবিলে রাখা নাকি প্লেটের ওপর রাখা, এসব শিখেছি। কখনও নানা রকম পরীক্ষামূলক রান্নাবান্না করেছেন, কখনও কফি বানাচ্ছেন, পৃথিবীর সেরা চা কোনটি, কোন কফি বা অলিভ ওয়েল সেরা এসব নিয়ে গবেষণা করেছেন। অভীকবাবুর সঙ্গে আমার প্রায় ১৫ বছর একটানা কাজ করা যেন কেটে গেছে এক নিঃশ্বাসে। আমাকে তো একবার একটা স্টোরি প্রায় ১০/১২ বার এডিট করান। আমিও সংশোধন করেই যাচ্ছি। সবশেষে বললেন, এখন মোটামুটি হয়েছে। স্টোরিটাও আমার মনে আছে। দিল্লিতে রাজনৈতিক নেতাদের আম-খাওয়ানোর পার্টি। ইফতার পার্টি না, আম পার্টি। সে লেখাটির জন্য পেঙ্গুইনের কুসুম বুধওয়ারের Romance of the Mango-the complete book of the king of fruits বইটি আমাকে পড়তে হয়। মুঘল আমলে কীভাবে আমের ভেতর মাংস দিয়ে সম্রাটরা খেতেন সে সব পর্যন্ত পড়তে হয়। প্রথম পাতায় অ্যাস্কর স্টোরি হয়। হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজারের বার্তা সম্পাদক। খুবই যোগ্য বার্তা সম্পাদক ছিলেন হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়। এরকম বহু স্টোরি নির্মাণের সাক্ষী ছিলেন তিনি।

বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে ব্যক্তি অভীক সরকারের ভূমিকা নিশ্চিতভাবে লেখা থাকবে খুব উজ্জ্বল অক্ষরে। ওনার মানসিকতা বুঝেছিলাম যখন সিঙ্গুরে টাটার আগমনের বিরুদ্ধে মমতার তীব্র আন্দোলন চলছে। আনন্দবাজার টাটার কারখানা স্থাপনের পক্ষে। আনন্দবাজারের সার্কুলেশন তখন প্রায় ৫০ হাজার কমে যায়। তাঁকে  জিজ্ঞেস করলাম, মানুষ মমতার আন্দোলনের পক্ষে। এটা কৃষকদের ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধবাবু হয়ত রাজ্যের ভালো চাইছেন কিন্তু মানুষ তো ওনার পক্ষে থাকছে না। অভীকবাবু বলেছিলেন, সার্কুলেশন কমে গেলেও আমি আপস করবো না। কারণ এটা আমার মতাদর্শগত অবস্থান। আমার আদর্শগত অবস্থানের সাথে আমি আপস করনো না।

পরে নন্দীগ্রামে গুলি চলার পর অবশ্য পরিস্থিতিটা পাল্টে যায়। অভীকবাবুও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বুদ্ধবাবু সরকারের ব্যর্থতায়। আমার খালি মনে হচ্ছিলো খুবই সাধারণ এক সাংবাদিক কর্মী হিসেবে, এটা তো লিটল ম্যাগাজিন নয়, মাস কাগজ। মানুষ যা চাইছে তার বিরুদ্ধে গেলে সার্কুলেশন মার খাবে। পরে ভাবলাম হতে পারে এটা আম বর্তমান-মানসিকতা।

অভীক সরকারকে নিয়ে খুশবন্ত সিংহের একটি চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধ আছে। Why I supported Emergency – এই বইটিতে একটি প্রবন্ধের নাম অভীক সরকার। এই প্রবন্ধটিতেও খুশবন্ত সিং অভীকবাবুর এই বিচিত্রগামী মনস্তত্বকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। তবে অভীকবাবুর ৭৫তম জন্মদিনে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটি দেন তাঁর ভাই অরূপ সরকার। চুপচাপ তিনি লন্ডন-কলকাতার বহু বিশিষ্ট দেশি বিদেশি বিদগ্ধ মানুষকে দিয়ে একটি বই নির্মাণ করেন এবং একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করে বইটি প্রকাশ করেন। অভীকবাবু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টের পাননি তাঁর ভাই ওর জন্মদিনে এরকম একটা চমক দেবেন।

আমি যখন আনন্দবাজারে যোগ দেই তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী। এরপর লোকসভা ভোটে বিজেপি পরাস্ত হয় এবং মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হন। তখন কোন এক সাংবাদিক আমাকে বলেছিল, বাজপেয়ী-আদবাণী চলে গেল কংগ্রেস এসেছে। এবার দেখবি তোর কি হয়? মালিককে চিনিস না। তোর প্রয়োজন নেই, তোকে এবার অবজ্ঞা করবে। চিনেও চিনতে পারবে না। মালিকের ঐ প্রকাশ্য ভদ্রভাবে অপমান করাটা হজম করতে পারবি তো?

বাস্তব কিন্তু হল বিপরীত। অভীকবাবু বললেন, তুমি আমাকে আডবানির সঙ্গে আলাপ করিয়েছিলে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব সোনিয়া গান্ধীর কাছে। ১০ বছর কংগ্রেস জমানায় আমি একই ভাবে কাজ করেছি। নিয়মিত খবর করেছি, খবর করিয়েছি। সোনিয়ার কাছে অভীকবাবু যখনই গেছেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। সংসদের সেন্ট্রাল হলে সোনিয়া গান্ধী একবার কর্ণ সিংহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, হি ইস অভীকস্‌ ম্যান ইন দিল্লি। মনমোহন সিংহের সঙ্গে বহু বিদেশ সফরেও গেছি, বাজপেয়ীর সফরের মতো।  (চলবে)

লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর