২৩ জুন, ২০২০ ২০:৫৪

ভার্চুয়াল দুনিয়া : মিছে মায়া!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

ভার্চুয়াল দুনিয়া : মিছে মায়া!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

কালকের সকালটা দেখবো কিনা তারই কোনো নিশ্চয়তা নেই। ‌অথচ এক যুগের হিসেব কষি। জীবনটা আসলে এমন শুভংকরের ফাঁকিই। চারপাশে কিছু মায়া অথবা মোহ। মুঠো ভর্তি; হাত খালির মতন অবস্থা আর কি! মিছে মরীচিকা... টানেলের ওপাশে অন্ধকারই থাকে, আলো হাতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না যে!

ফেসবুকের কারণে আমাদের আবেগ কমেছে। হিংসা বৃদ্ধি পেয়েছে, বাহ্যিক জীবনের প্রতি লোভী হয়েছি আমরা। এখন গল্পও করি ফেসবুক স্ক্রল করার ফাঁকে ফাঁকে। আমরা বেড়াতে যেয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য না দেখে স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে থাকি। আমাদের একটা সুন্দর জীবন ছিল। আমরা গল্প করতাম, হাসতাম, ঘুরতাম। অথচ লাইক কমেন্ট লাইভ আর শেয়ারের মোহে পড়ে আমরা সেই জীবনকে খুন করেছি।

হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা
নয়নে সাজায়ে মায়া মরীচিকা 
শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে ...

ফেসবুকের কারণে মানুষ এখন অনেকটাই স্বার্থপর ও ঘরকুনো। বন্ধুত্ব বলে আদতে আর আবেগীয় কিছু নেই। পুরোটাই এখন ভার্চুয়াল। আত্মার সম্পর্ক বলে খুব কমই অবশিষ্ট আছে। ফেসবুক মানে এখন স্রেফ লোক দেখানো। দেখো, দেখো, আমাকে দেখো। আমার মতো সুখী ও পারফেক্ট মানুষ আর হয় না। না, অন্যের দুঃখ শোক কষ্টে আমরা বিচলিত হচ্ছি না। অন্যকে নিয়ে ভাবার আমাদের সময় কোথায়! আমরা তো সবাই এখন আত্মসুখে মগ্ন।

ফেসবুকবাসীর মতন এমন জ্ঞানী বুদ্ধিমান প্রাণী আর কোথাও নেই। তারা জানে না এমন কোনো বিষয় ত্রিভুবনে নেই। ভূরি ভূরি জ্ঞানের বহর সাজিয়ে ছেড়ে দেয় ফেসবুকের পাতায়। সেখানে কচিপাঠার বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে উঠতি লেখক, পড়তি ক্যারিয়ারবিষয়ক বক্তা, উঠতি সেলিব্রেটি সবার তত্ত্বকথা থরে থরে সাজানো। এখানে সবাই সর্বজ্ঞ। কেউ কারো চেয়ে একটুও কম নয়।

ফেসবুকের সবচেয়ে ভয়ানক জিনিস হলো ফেসবুক ভাইরাল। এটা যেকোন বাজে ভাইরাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন এমন অসংখ্য লিংক বা কনটেন্ট চ্যাটবক্সে পাই। যার উপরে বা নিচে লেখা থাকে ভাইরাল করুন। আমরা বুঝে বা না বুঝে, কোনো রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই এগুলো ছড়াই। এগুলো অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসে আমাদের মত পাবলিকের ঘাড়ে। সুপার ইমপোজ করা বা ফটোএডিট করে বানানো ছবি, মিথ্যে কনটেন্ট কখনো বা শুধুই ‘গুজব’। আপনিও কিন্তু জেনে বা না জেনে ছড়াচ্ছেন। হ্যাঁ পরে হয়তো প্রমাণ হলো ব্যাপারটা স্রেফ গুজব ছিল বা তথ্যগুলো উদ্দেশ্যমূলক ছিল। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেলো। ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার ক্যামেরা ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে। শত শত লোক দেখছে, আহা-উঁহু করছে। দিনশেষে সব হারিয়ে আপনি একেবারে নিঃস্ব।

মজার ব্যাপার, পাবলিক আপনার ভালো কথা শুনবে না, কিন্তু আজেবাজে কিছু ভাইরাল হলে পাল্লা দিয়ে তাতে লাইক কমেন্ট দিতে থাকবে, নিজের ওয়ালে শেয়ারও করবে। যেন আপনার মতন গর্হিত অপরাধ দুনিয়ায় এর আগে আর কেউ কখনো করেনি। পাবলিক ভাত মাছ খাওয়ার চেয়েও বেশি খায় যে জিনিস তার নাম হলো ‘গুজব’! গুজবের পাখায় ভর করে রাণীর কোলের কালো ছেলে কা কা করে উড়ে পালায়।

মানুষকে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন, মতিচ্ছন্ন আর নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে এই ফেসবুক। নির্বোধের মত ফেসবুকের বুকে যথেচ্ছ আঁচড় কাটবেন না। কারণ আপনি জানেন না, বিপদ কোন দিক থেকে আসবে। চাই কি, শাঁখের করাতের মত ফেসবুক দুই দিকেই কাটবে। ঘরে এবং বাইরে। ভুল ঠিকানায় যদি চলে যায় চিঠি, সে চিঠির জবাব আসে না। আপনার ফেসবুক জানে না সঠিক মানুষের ঠিকানা।

এক কবি একটা কবিতা লিখে ইনবক্সে অনেককেই পাঠায়। যাকে পাঠায় তাকেই লেখে তোমার জন্য আমার এই নিবেদন। একদিন মেয়েদের এক সিক্রেট গ্রুপে কার প্রেমিক কাকে কতটা ভালোবাসে তা নিয়ে আলোচনা চলছিলো। প্রেমিকের ডেডিকেশন বোঝাতে কেউ কেউ তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটা পোস্ট করলো। পোস্ট এ্যাপ্রুভ করতে যেয়ে গ্রুপ এডমিন পড়লো মহাবিপদে। ২০ জন প্রেমিকা একই কবিতা পোস্ট করেছে!

ম্যাসেঞ্জারে খুব সহজেই লাভ ইউ, মিস ইউ বলে দেওয়া যায়। একই টেক্সট কপি করে ১০ জনকে দেওয়া যায়। রাতভর কথার সাথে সাথে টুকরো টুকরো আরেও অনেক কিছুই হয়তো বিনিময় হয়। কিন্তু তার রেশ সকালের ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। কারো চোখে চোখ রেখে ভালোবাসি বলার মধ্যে যে ভালোলাগা, যে আনন্দ তা কি ওই চ্যাট বক্সে মেলে! কারো হাত ধরে সবুজ ঘাসে উদ্দেশ্যহীন হাঁটার যে সুখ তা মেলে না রাতভর ভিডিওকলে।

কাউকে ছোট করা, কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। ফেসবুকে সেডিজমের প্র্যাক্টিসটা একটু বেশিই হয়। অন্যের কাটাঘায়ে নুনের ছিটা দিতেই যেন বেশি আনন্দ এখানে। একটা মায়ার পৃথিবী, একটা আত্মিক বন্ধন কোনোভাবেই ভার্চুয়াল পৃথিবীর চেয়ে দামী হতে পারে না। ফেসবুকে লাখ লাখ ফ্যান ফলোয়ার। আজই একটা বিপদে পড়েন, ডাক দেন তো, দেখেন কয়জন সাড়া দেয়। বিপদে ভার্চুয়াল বন্ধু না, সত্যিকারের বন্ধুরাই ঝাপিয়ে পড়ে।

ইদানীং একটা ট্রেন্ড হয়েছে কোনো একটা মুভমেন্ট বা ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটা ইভেন্ট খোলা। সেখানে বিভিন্ন জনকে ইনভাইটেশন পাঠানো হয়। শত শত, হাজার হাজার লোক সেইসব ইভেন্টে গোয়িং চেকইন দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ব্যানার ধরার মতন লোকও যোগাড় হয় না।

ফেসবুক অনেকটা মিছে মায়ার মতনই। হাত ভর্তি চাঁন্দের আলো ধরতে গেলে নাই!

লেখক : সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট। 

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর