২১ আগস্ট, ২০২০ ১৬:৪৮

তাঁরা দিয়ে গেছেন প্রাণ

মাহমুদ হাসান

তাঁরা দিয়ে গেছেন প্রাণ

১৫ আগস্টের অবশিষ্ট ঘাতকেরা ২১ আগস্ট দ্বিতীয়বার হত্যা করতে চেয়েছিল বাংলাদেশকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘাতকচক্র নিপুণ নিশানা করেছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি, তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট তার পরিবার হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। তিনি হারান স্নেহময় পিতামাতা, আদরের ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন। আর বাংলাদেশ হারায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তার সহধর্মিণী ও রাজনৈতিক প্রেরণাদাত্রী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে। ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকায় দুইবোন প্রাণে রক্ষা পেলেও ঘাতকচক্রের টার্গেটে পরিণত হন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। ২০০৪ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে তার প্রাণনাশের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র হয়েছে অন্তত ঊনিশবার।  

২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানী ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আ্যভিনিউতে শান্তিসমাবেশ ডেকেছিল আওয়ামী লীগ। শান্তিমিছিল-পূর্ব সেই সমাবেশে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মুহূর্মুহু গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পেলেও তার কানের পর্দা ফেটে যায়। তিনি শব্দাঘাতে গুরুতর আহত হন। সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন। এদের মধ্যে ১৬ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আহত ৮ জন। এদের মধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজন বিশিষ্ট নারীনেত্রী ও আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক বেগম আইভি রহমান। ২৪ আগস্ট ঢাকা সিএমএইচ-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ দুইশ’র বেশি নেতাকর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষ। দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরাও ছিলেন আহতের তালিকায়। তারা এখনো গ্রেনেডের স্পি­ন্টার নিজেদের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন।  

পরে জানা যায়, শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার সেই কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল জঙ্গিসর্দার মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে তার জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) এর প্রশিক্ষিত সদস্যরা। আর হত্যা পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিল তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপির সেকেন্ডে-ইন-কমান্ড তারেক রহমানের হাওয়া ভবন। এছাড়া তৎকালীন মন্ত্রিসভার দু’জন সদস্য, রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয়রা হত্যাচেষ্টার ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধায়ন করে।

আমার চোখের সামনে ঘটেছিল আরেক অভিশপ্ত আগস্টের সেই মর্মন্তুদ ঘটনা। তখন আমি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতার কাজ করি। নিহতদের নিয়ে যুগান্তরে ছাপা আমার লেখা একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ- “লালবাগের আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ কর্মী সুফিয়া বেগম (৪০)। যিনি আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুস সামাদ মুন্সির সঙ্গে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় স্বামীকে হারান। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর সুফিয়া আর বিয়ে করেননি। দুই ছেলে নিয়ে হাজারিবাগের বাড্ডানগর লেনে থাকতেন। বহু কষ্টের জীবন নিয়েও তিনি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুতে ছেলে রাসেল ও সোহেল আজ নিঃস্ব। বাবা নেই, মা-ও চলে গেলেন। কে দেবে এখন তাদের সান্ত্বনা?

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী দলের সদস্য ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স কর্পোরাল মাহবুবুর রশীদ (৩৮)। তিনি বলতেন, ‘নেত্রীর জন্য জীবন দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করবো না।’ মাহবুব নিজের জীবন দিয়েই বাঁচিয়েছেন প্রিয় নেত্রীকে। ঘাতকরা যখন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে চোরাগোপ্তা গ্রেনেড ও গুলি ছুঁড়ছিল, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মাহবুবও তাকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সভানেত্রীর জিপগাড়ির জানালা আগলে দাঁড়িয়ে থাকেন। গ্রেনেড গুলি থেকে নেত্রীর প্রাণ রক্ষা করতে পারলেও সেদিন গুলিতে প্রাণ হারান মাহবুব।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম (৬৮)। যিনি দলের কর্মীদের কাছে ‘আদাচাচা’ নামে পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর পরে তাকে সমাধিস্থ করা হয় শাহজাহানপুরে তার সহধর্মীণী তাসলিমা বেগমের পাশে। স্কুল শিক্ষিকা মেয়ে মাহবুবা আক্তার পিতৃহত্যার বিচার চান।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক মুশতাক আহমেদ সেন্টুর বাড়ি বরিশালের মুলাদীতে। সেন্টু আহতাবস্থায় অনেকক্ষণ পড়েছিলেন রক্তাক্ত রাস্তার ওপর। যথাসময়ে হাসপাতালে নেয়া গেলে হয়তো বেঁচে যেতেন সেন্টু। নাসিরউদ্দিন সরদার (৪০) ছিলেন পুরান ঢাকার চালের আড়তের দিনমজুর। অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু রাজনীতির নেশায় থাকতেন বুঁদ। ঘাতকের গ্রেনেডে ক্ষত-বিক্ষত নাসিরউদ্দিন চিরনিন্দ্রায় শায়িত হয়েছেন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ছোটচর গ্রামে।

কয়েকদিন পরই মেহেদীর রঙে রাঙাতো স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কুদ্দুস পাটোয়ারীর দু’হাত। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ভয়াবহ গ্রেনেড কেড়ে নিয়ে গেছে তার স্বপ্ন। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার বিষ্ণপুরের তার বাড়ি। মৃত ছেলের ছবি বুকে নিয়ে দিনরাত বিলাপ করছেন আবদুল কুদ্দুসের দুঃখিনী মা।

পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন মৃধার বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার পশ্চিম আলীপুরে। পুত্রশোকে কাতর বাবা মোতালেব মৃধা ও মা আমিনা বেগম ছেলের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে কান্নাকাটি করেন। মোতালেব মৃধা বলেন, মামুনের রক্তের বিনিময়ে হলেও দেশে যেন শান্তি ফিরে আসে, তারা তাই চান। পাশাপাশি বিচারও চান। 

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফ মিয়া (৫০) ঢাকার ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের রিকশা শ্রমিক লীগের নেতা। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার বাউরখোলা গ্রামে তার বাড়ি। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পরে স্ত্রী পিয়ারা বেগম আজ অসহায়। তার চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। ১৫ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রিনা (৪৫)। স্বামী বশির আহমেদ। বাসা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইগার টেকে। বড় উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি সমাবেশে এসেছিলেন। আর ঘরে ফিরতে পারেননি। নগরীর হাজারীবাগের বাড্ডানগর লেনের আফাসউদ্দিনের মেয়ে রিজিয়া বেগম (৪৫) স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেত্রী। শান্তির জন্য তিনিও জীবন দিয়েছেন। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার চরপাড়ার যুবলীগ নেতা আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম (২৫)। তার মাথার ওপর ছিল রাজনৈতিক মামলা। পুলিশি হয়রানির হাত থেকে বাঁচার জন্য ঢাকায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেই অবস্থায় দলের প্রতিটি সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন। লিটন মুন্সি লিটু, পিতা আইয়ুব আলী মুন্সি। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার উত্তর হোসেনপুরে। তিনি ছিলেন স্থানীয় যুবলীগ সভাপতি । তার মৃত্যুতে একমাত্র সন্তান মিথিল এতিম হয়েছে। মহানগরীর ৮৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা  আতিক সরকার (৩৫)। বাবা আবদুস সামাদ সরকার। বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার পশ্চিম পাঁচআনি গ্রামে। ঢাকায় থাকতেন উত্তর যাত্রাবাড়িতে। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। তার অবর্তমানে স্ত্রী লাইলি বেগমের দু’চোখে অন্ধকার। ২০ নম্বর আগামাসি লেনের বাসিন্দা শামসুদ্দিনের পুত্র আশরাফউদ্দিন বেলাল ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বেলালের মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভাবা। কিছুদিন পর তার কন্যা সন্তান পৃথিবীর আলো দেখলেও সে কোন দিন বাবার মুখ দেখতে পাবে না। বেলালের বাবা ছেলের রক্তমাখা শার্ট রেখে দিয়েছেন। রতন শিকদার (৪০) রিরোলিং ব্যবসায়ী। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের উত্তর মাসদাইর। ২১ আগস্ট তিনি প্রিয়নেত্রীকে কাছ থেকে দেখতে ঢাকায় এসে নিজের জীবনটা দিয়ে গেছেন। তার বাবা আবদুল হক সিকদার, মা মমতাজ বেগম। স্ত্রী নুসরাত জাহান রুবি, ছেলে আনন্দ ও মেয়ে অপূর্বা এর বিচার চান। ঢাকার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বালুঘাট ইউনিট যুবলীগের কার্যকরী সদস্য আবুল কালাম আজাদ (৩৮) থাকতেন বাড়নটেক পল্ল­বীতে। বাড়ি শরীয়তপুরের সখিপুরে। সেখানে মা ও স্ত্রী অসহায় জীবনযাপন করছেন। সেদিনের হামলায় আরও যারা জীবন দিয়েছেন তারা হলেন- আবুল কাশেম (৫০), জাহেদ আলী (৩৫), মমিন আলী (৩৫), সামসুদ্দিন (৫৫) ও ইছহাক (৩৫)।

লেখক: উপসম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর