২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৯:০০

নারী সবকালেই আকাশের মত একা

হাসিনা আকতার নিগার

নারী সবকালেই আকাশের মত একা

হাসিনা আকতার নিগার

লকডাউনের ঘরবন্দি সময় শিখিয়েছে পৃথিবীতে মানুষ এককভাবে ক্ষমতাধর নয়। তাই মুক্ত আকাশে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণাটা বড় তাড়া করছে নিজেকে। ২০২০ সালের শুরুতে জীবনটা থমকে গেছে ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কারণে। মানুষের সব দম্ভ, অহমিকা, প্রভাব প্রতিপত্তি এক নিমিষে তুচ্ছ হয়ে গেল করোনাভাইরাস নামের এ অদৃশ্য শক্তির কাছে। সারা পৃথিবীকে ঘরবন্দি করে দিয়েছে এ ভাইরাস। 

চীনের উহান শহর থেকে সৃষ্ট ভাইরাস মানুষকে অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।  রাজনৈতিক হিসাবে এ ভাইরাস মানবসৃষ্ট নাকি প্রকৃতি থেকে সে অন্য এক বিতর্ক। কিন্তু মানুষের অত্যাচারে জর্জরিত প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন দেখে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়েছে। প্রকৃতি তার আপন রূপে ফিরে যে শিক্ষা দিয়েছে, তা আগামী দিনের পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এমনটাই আশা ছিল সকলের। বলা হয়ে থাকে প্রকৃতি তার নিয়মের অনিয়মকে সহ্য করে না। তাই প্রকৃতির বিচারের কাছে মানুষ বড় অসহায়। যার প্রমাণ কোভিড ১৯।  
 
সারা পৃথিবী একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কোভিড-১৯ মানুষকে যে বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে তার অন্যতম একটি হলো- 'পারস্পরিক সম্পর্ক'। বর্তমান সময়ে মানুষের ছুটে চলা জীবনে একে অপরের সম্পর্কগুলো অনেক বেশি যান্ত্রিক ও আলগা হয়ে গেছে। বিশেষ করে পরিবারিক সম্পর্ক। চাওয়া  পাওয়র বাইরে যে আত্মিক একটা জীবন আছে, তা ভুলেই গেছে মানুষ। 

গত মার্চ মাস থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে একটা অন্য রকম অনুভূতি এসেছে প্রায় সবার পরিবার। বাইরের জগতের ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে যাও আবেগ, ভালোবাসা, বেদনা সব যেন নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছে নতুন করে। নারীদের সংসার জীবনে কোভিড-১৯ কাজের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। গৃহকর্মী ছাড়া সাংসারিক কাজ কেউ কেউ একা সামলিয়েছে। আবার কেউ কেউ সহযোগিতা পেয়েছে স্বামী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে। হাউস ওয়াইফদের কি এমন কাজ- এ কথাটা বদলে দিয়েছে কোভিড ১৯। কারণ অফিসের কাজের চেয়ে ঘরের কাজ কোন অংশে কম নয়, তা বুঝতে পেরেছে স্বামীরা। 

ঘর সংসারের বাইরে একান্তভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে কখনো মনের আকাশে বিষন্নতা মেঘ এসে জমেছে। আবার কখনো মনে হয়েছে যদি বেঁচে থাকি জীবনের ভুলগুলো শুধরে হাসবো প্রাণ ভরে। চারদিকে করোনার আতঙ্ক এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে সকলের মাঝে। ঘর বাহির সামলানো নারী জীবনে অনিশ্চয়তার শঙ্কা তাড়া করছে এখন অবধি। সব কিছু ছাপিয়ে কেবল মনে হয়েছে, সবাইকে আগলে রাখতে রাখতে এই যে আমিকে হারিয়ে ফেলেছি; সে কথা কি কেউ মনে রেখেছে? নারী তার সম্মানটুকু পায় না বলে এ মহামারীর কালেও নির্যাতিত হয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অনেক নারী অত্যাচারিত হবার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। ঘরবন্দি জীবনে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে সময়ের ব্যবধানে কন্যা জায়া জননী হয়ে বেঁচে আছি কেবল। সেখানে সেই আমিটা নেই, যে আমি হবার স্বপ্ন দেখতাম।   

একজন নারী সবার আগে একজন মানুষ। অথচ আধুনিক সমাজেও নারীর প্রতি মানসিকতা বদল হয়নি। পরিবার সমাজ যে কোন কাজে সবার আগে দোষী করে নারীকে। বিয়ে না টিকলে স্ত্রীর দোষ। কারণ নারীর একমাত্র দায় স্বামী ও তার পরিবারের মন যুগিয়ে চলা। সন্তান বিপথে গেলে মায়ের দোষ। কারণ মা সন্তানের দেখভাল করতে পারেনি। এমনিভাবে এ সমাজ হাজারো খুঁত ধরে নারীর।
 
জীবনযুদ্ধে পোড় খাওয়া নারীদের লড়াইকে সম্মান দেয়ার বদলে অপবাদটাই বেশি জুটে। অথচ তাদের চলার পথের যন্ত্রণাগুলো হয় একান্ত তার। করোনাভাইরাসের কালে জীবনের ডায়েরিটা যেন আপনা আপনি চোখের সামনে ভেসে উঠে। ঘরবন্দি কর্মহীন সময়ে আগামী দিনের দুঃশ্চিন্তার সাথে অতীতের মিল খুঁজে পায়। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিটা সব সময় এক হয় না। হয়তো সে কারণে আবেগ প্রশ্র‍য় পেয়ে প্রশ্ন করে নিজেকে। লড়াই করা চলা জীবনে করোনাভাইরাস চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে। একজন নারী স্বাবলম্বী হতে গিয়ে পুরুষের চেয়ে কম সংগ্রাম করে না। তাই তার কাছে করোনাভাইরাসের এ মহামারী আর দশজনের মতই চিন্তনীয় বিষয়। কারণ নারীর দায়িত্ববোধ, সামাজিক অবস্থান ও বাস্তবতার হিসাবকে তছনছ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস।   

প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আর রোগ আক্রান্তের খবর শুনতে শুনতে দমবন্ধ করা পরিবেশে ছিল লকডাউন কালে। ভার্চুয়াল জগতে সবাই সবার কাছে ছিল। তবুও নিত্যদিনের চেনা শহর চেনা মানুষ আর ছুটে চলা জগৎটাকে আবার ফিরে পাওয়ার আকুলতাতে কাটত রাত-দিন। একটাই আরাধনা ছিল, এ মহামারী থেকে মুক্তি। 

করোনাভাইরাস পৃথিবীকে বদলে দিবে এ চিন্তাটা তাত্ত্বিক। দুঃখজনক হলো-  প্রকৃতি  থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে পারেনি বলে বদলে যেতে পারেনি। মানবিকতাকে ধারণ করতে পারেনি বলে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়েছে করোনাকালে। সমাজ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আহত হয়েছে মানুষ। এতটা বৈরি পরিবেশ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে জেনেছি একটা সত্য। বোধ করি সে সত্যটা সবার জন্য এক। নারী বা পুরুষ নয় বরং একজন মানুষ হিসাবে 'আমি  কিংবা আপনি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবকালেই আকাশের মত একা।

লেখক : কলামিস্ট

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর