৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১১:২২

মামুন: হারিয়ে যাওয়া এক গল্পের নাম

মামুন: হারিয়ে যাওয়া এক গল্পের নাম

মামুন নামের গল্পটি নেই। দু’বছর হয়ে গেল। এই সময়ে কতজনের কত গল্প জমেছে। সুখ-দৃঃখের স্মৃতি বেড়েছে। বেঁচে থাকলে পরিচিতজনদের সেসব গল্পের অনেকগুলোতেই মামুনও থাকতো। মামুন ছেলেটাই ছিল এমন। কারনে অকারণে গল্পের মধ্যে হাজির হয়ে যেত। কখনো আনন্দ হয়ে, তার অতি আনন্দ কখনো বা বিরক্তির কারণও হয়ে যেতো। কিন্তু তার ওপর বিরক্তি খুব বেশি সময় ধরে রাখা যেত না। এমন কিছু করতো যে উপস্থিত সবাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতো।নিজে হেসে যেত, হাসাতো আশেপাশের সবাইকে। এই এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল মামুনের- মানুষকে হাসানো। শুধু ভালবাসা দিয়ে মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার এক সম্মোহনী শক্তি ছিল তার।

মামুনের সেই হাসিটা নেই। দু’বছর হয়ে গেল। এখনো তার হাসিমাখা চেহারাটা স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে। একবার, দুবার, বারবার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দিনে কত কত নোটিফিকেশন আসে। সেখানে ভেসে আসে অতীত স্মৃতিও। মেমোরি হিসেবে আসে নোটিফিকেশন। ঘুরেফিরে সেখানেও মামুন। আরো অনেকের সাথে তারও সরব উপস্থিতি। এই একটা বিষয়ে মামুন ছিল যেন অদ্বিতীয়। যে কোন ছবিতে তার থাকতেই হবে। কোথায় দাঁড়ালে ছবি থেকে তাকে বাদ দেয়া যাবে না, তা খুব ভালই জানা ছিল তার। ছবি তোলার ঠিক আগ মুহূর্তে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যেত যেন তাকে উপলক্ষ করেই ছবিটা তোলা হচ্ছে। খুব কম সময়ই সে অন্যের ছবি তুলে দিয়েছে। বরং ছবিতে নিজে থাকতে চাইতো। এই আমরা ছবি তোলার জন্য আরো অনেক সময় পাব, মামুন পাবে না। সে কথা কি ওর ভেতর থেকে কেউ জানিয়ে দিয়েছিল? কে, জানে। এখনও সেই সব ছবিগুলো সামনে আসে আর চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। ঝাপসা চোখে মামুনের ছবির দিকে চেয়ে থাকি। 

দু’বছর হয়ে গেল। পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে সবসময় মামুন কোন না কোনভাবে আলোচনায় থাকতো। আলোচনায় থাকতে পছন্দও করতোও হয়তো। মামুনের উপস্থিতিতে তাকে নিয়ে যেমন আলোচনা হতো, হতো তার অনুপস্থিতিতেও। আমরা এখনো তাকে নিয়ে কথা বলি, তার অভাব অনুভব করি। এটাও এক ভীষণ রকমের যোগ্যতা। আজীবন মামুন নামের হাসি মুখটি চোখের কোন ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। এই যোগ্যতা সবার থাকে না। সবাই সবসময় আলোচনায় থাকতে পারে না। সবাইকে নিয়ে সব গল্প আড্ডায় আলোচনা হয় না। কিন্তু মামুন আলাদা, অবশ্যই ভিন্নরকম। পরিচিতজনদের আড্ডায় থাকুক না থাকুক মামুন প্রসঙ্গ চলে আসতই, এখনো যেমন আসে। আর কোন আড্ডায় মামুন থাকা মানেই ছিল আলোচনা তার দিকে ঘুরে যাওয়া। যত কথাই বলা হোক, ভাল হোক মন্দ হোক, তার পক্ষে হোক বিপক্ষে হোক; সবকিছুই হাসিমুখে মেনে নিত মামুন। রাগারাগির কোন বালাই-ই নেই। বরং হাসির রেশটা ছড়িয়ে দিত সবার মাঝে। তার এই হাসিমাখা মুখের অন্তরালে হয়তো কোন কষ্টও লুকিয়ে ছিল। যেমন ধুলোবালির রাস্তায় দাঁড়িয়ে একদিন বলছিলো “এই শহরের বাতাসে ধুলাবালি উড়ে না, যা উড়ে তা হলো কান্না। একটু বাতাসে তা যদি চোখে আসে, তা পানি হয়ে ঝরে পড়ে।”
 
সেই সহজ সরল, নিরাগ মামুনটা নেই। দু’বছর হয়ে গেল। মামুনের একটি দিক ছিল, কারো নামে গুরতর অভিযোগ করতো না। আর যদি কারও উপর মন খারাপ হতো, তাহলে খুব চুপ হয়ে যেত। সেটা তার খুব কাছের দুই একজন জানত বা বুঝতে পারতো। জীবন নিয়ে কতজনের কতশত পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু' নিজের জীবন নিয়ে মামুনের কোন পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয়নি কখনো। মামুন মানে হলো একজন নিপাট সহজ সরল হাসি খুশি ভরা একটি ছেলে। জীবনের মানে যার কাছে ছিল সাদাসিধা।  জীবনের খুব জটিল কিছু সে বুঝত না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জীবনই যে তাকে নিয়ে এমন পরিকল্পনা করে রেখেছিল, কে জানতো। তাই কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট হয় মামুন। দু’বছর আগের সেই রাতটা এখনো ভয়ানক কষ্ট হয়ে জমে আছে বুকের গভীরে। সারাক্ষণ হাসতে থাকা মামুন দুম করে চলে যাবে, তাও আবার ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে। এখনো মানতে কষ্ট হয়। তাই এখনো মামুনকেই মনে পড়ে আমাদের; আড্ডায়, গল্পে, কল্পনায়। হৃদয়ের পিঠে ভালবাসা জড়ো হয়। চোখের কোণে জমে উঠে জল। আহ! মামুন, আমাদের মামুন!
 
এভাবে এত তাড়াতাড়ি মামুন চলে যাবে তা আমাদের কারো কল্পনাতেও ছিল না। এত ছোট জীবনেই কত গভীর দাগ কেটে গেছে ছেলেটা, তা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। এখন্‌ও মনে হয় এই বুঝি ফোন দিয়ে বলবে, কোথা্‌য় সবাই। যে কোন জায়গার নাম বলে সে কোথায় জিজ্ঞেস করলেই বলতো সেও রাস্তায়। তার সেই রাস্তা আর যেন শেষ হয় না। ঘণ্টাখানিক পর ফোন দিলেও বলবে রাস্তায়। তারপর আসবে মামুন। চলবে তর্কবিতর্ক, বকাবকি, গল্প আরেও কতকিছু। আর সেই প্রাণখোলা হাসি। প্রতিদিনের প্রায় প্রতিবেলার সাথেই জড়িয়ে ছিল মামুন। কখনো অ্যাসাইমেন্টে, কখনো সন্ধ্যা-রাতের আড্ডায়। কতশত স্মৃতি যে জমা আছে তাকে নিয়ে। সব স্মৃতিই দু’বছর আগের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই আটকে গেছে সবার জীবন পাতায়। কারো সাথে টঙ দোকানে চা খেতে খেতে জমেছিল শেষ তর্কটা, কারো সাথে ইটিভির গলিতে, কারো সাথে গুলশানের রাস্তার মোড়ে, কারো সাথে বা টেলিফোনে হয়েছিল শেষ কথাটা। সেই স্মৃতিগুলোই এখনো হাতড়ে বেড়াই। যেখানে যেখানে মামুনের সাতে আড্ডা দিতাম এখনো সেখানে গেলে মোচড় দিয়ে উঠে বুকের ভেতরটা। আক্ষেপ বাড়ায় শুধু। এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যেতে হলো মামুন? আর কল্পনায় মামুনকে ভাবি। ইশ ছেলেটা এখন এখানে থাকলে কি করত? আচ্ছা করোনার এই মহামারীতে মামুন কি নিয়ম মেনে মাস্ক পরে থাকতো সবসময়? নাকি বলতো আরে এত ভয়ের কি আছে, আমার কিছুই হবেনা। এমন কত কিছুই আর জানা হবে না। যেমন এখন জানি না আকাশের কোন তারা হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে মামুন। আর মিটিমিটি হেসে বলছে, সব দেখছি কিন্তু, আমি সব জানি। আহ! সেই মামুন, আমাদের মামুন নেই। মামুন নেই কিন্তু মামুনের না থাকা আমাদের প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় মামুন কতো বেশি করে আছে আমাদের মাঝে। মামুনের অভাবে যে বিশাল কষ্ট ও বেদনা তা মামুনের কাছের মানুষ ছাড়া কেউ বুঝবে না। মামুন ছিলো এমনই, তাকে মিস করতে আপনি বাধ্য। 

মামুনের একটা প্রিয় গান ছিল যা প্রায়ই বেসুরা গলায় প্রায়ই গাইতো...
“আজ চলতে শিখে গেছি
তোকে নেই কিছু প্রয়োজন
তবু ভীষণ অপ্রয়োজনে তোকেই খুঁজেছে আমার মন
তুই হয়তো ভালোই আছিস
আর আমিও মন্দ নেই
তবু অসময়ে এসে স্মৃতিগুলো বুকে আঁকিবুকি কাটবেই।

তুই কত দূরে চলে গেলি
তোকে হারিয়ে ফেলেছি আমি
এই দুঃখটা হয়ে থাক
এই দুঃখটা বড় দামি।”

কখনো ভাবিনি মামুনের পথ চলা ঠিক এই গানের লাইনের মতই হয়ে যাবে একদিন। 

লেখক: আশরাফুল আলম খোকন, সিলভিয়া পারভীন লেনি, নাসিম রুপক, জয়দেব নন্দী, রোকন উদ্দিন, নাজমুল আলম নবীন, শারমিন সুলতানা লিলি, নীলাদ্রী শেখর, আশিক রনো, ইমতিয়াজ বাপ্পী, শ্রাবন মহসীন।

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর