২১ অক্টোবর, ২০২০ ২১:০৮

বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে

কবীর চৌধুরী তন্ময়

বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে

কবীর চৌধুরী তন্ময়

শিরোনামের কথাটি আমার ব্যক্তিগত নয়, তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-এর এমন কথায় কিংবা বাংলাদেশ এগিয়ে চলার পরিসংখ্যানে আমরা বাঙালিরা একদিকে যেমন আবেগে আপ্লুত, অন্যদিকে আরো উদ্যমী হয়ে পড়ি। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলার স্বপ্ন বুনি। কারণ, আমাদের অর্জনগুলো ঐতিহাসিক, ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসও গণশ্রম বা পারিশ্রমিক মনোবলের বৃত্তিতে সৃষ্ট।

বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে কিংবা ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে- এমন খবর ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোই মূলত আমাদের বেশি করে জানিয়েছে।ভারত অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের পেছনে পড়ে যাবে- এটি যেমন ভারতকে নিরব কষ্ট দিচ্ছে, আরাব নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হচ্ছে। ভারত সরকারের কোথায় কী ভুল হয়েছে, কোথায় কী দুর্বলতা বা ঘাটতি রয়েছে কিংবা মোদী সরকার কী কী করেছে- এসব বিষয় নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ হচ্ছে। এ নিয়ে ভারত সরব থাকলেও এদিকে বাংলাদেশ যেন একপ্রকার নিরবতাই পালন করছে। আমাদের টকশোগুলোতেও খুব বেশি মাতামাতি করতে দেখা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করেনি।

গত ১৫ অক্টোবর ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম, ‘ভারত, পূর্ব দিকে তাকাও : বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের (ভারতের) জন্যও শিক্ষণীয়।’ আবার (১৪ অক্টোবর) আনন্দবাজার পত্রিকায় শিরোনাম ছিল-‘পড়ছে ভারত! মাথাপিছু উৎপাদনে ‘আচ্ছে দিন’ যাচ্ছে বাংলাদেশে।’ ভারতের মূল গণমাধ্যমের সাথে-সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়া নিয়ে ‘বেশ সরব’ হতে দেখা গেছে।

কারণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তার ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ নামক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতের মাথা পিছু জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি দাঁড়াবে ১ হাজার ৮ শ’ ৭৭ ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মাথা পিছু উৎপাদন হবে ১ হাজার ৮ শ’ ৮৮ ডলার।

আর এ নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো আলোচনা না হলেও ভারতে বিষয়টি তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। রাহুল গান্ধী টুইট করে বিজেপির কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এটাই বিজেপির হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অর্জন।’ অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান ইকোনমিস্ট অধ্যাপক কৌশিক বসু এই অবস্থায় ভারতকে ‘শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি’ চালু করার আহ্বানও করেছেন।

দি প্রিন্ট-এর প্রধান সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক শেখর গুপ্ত ১৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর চলতি অর্থ বছরের প্রতিবেদন ভারতের অর্থনীতির অ্যাকিলিস হিল বা সবচেয়ে দুর্বল স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ সংস্থার আয়না ভারতের জন্য বড়ই নিষ্ঠুর!’

অন্যদিকে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের বিশ্লেষণগুলো বেশ নজর কেড়েছে। অনেকে খুব সুন্দর করে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে- পঞ্চাশ বছর পর এমন সুখের ঢেকুর তোলা বন্ধ করে মোদী সরকার শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে ও  নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তর কথা শোনা যায়। তারপরেও শেখ হাসিনা কী করে মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবেও দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পর্যায়ে রেখেছে এবং কী ধরণের নেতৃত্বের কৌশলে আজ ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে- এগুলো শেখার পরমার্শ দেওয়া হয়েছে।

তবে একটা জিনিস খুব (আমার ব্যক্তিগত) ভালো লেগেছে, জিডিপি নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় যারাই রিপোর্ট করেছেন কেউ বাংলাদেশ নিয়ে কটু কথা বলেননি, বরং বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিসংখ্যান দেখে তাদের কেউ কেউ প্রাণ খুলে প্রশংসাও করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়েও বিশ্লেষণ করতে দেখা গেছে।

আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে। আইএমএফ-এর এই পূর্বাভাস অনুযায়ী ভারত মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও নেপালের থেকে সামান্য এগিয়ে থাকবে। সে হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তানের আগে চলে আসবে বাংলাদেশ।

আর বাংলাদেশ যে এবারই ভারতকে পেছনে ফেলেছে তা কিন্তু নয়। আর এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত স্বাতী নারায়নের এক প্রতিবেদন উল্লেখ করে মোদী সরকারের এক মন্ত্রী বেশ ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে বাংলাদেশের অর্ধেক লোক ভারতে চলে আসবে।’ 

স্বাতী নারায়ন তখন প্রশ্ন তুলে জিজ্ঞেস করেন- কেন আসবে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়িতে টয়লেট, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্কুল-কলেজে ছাত্রী ভর্তি, নারী কর্মী, স্বাক্ষরতার হার- এসব অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তারা বিনামূল্যে প্রতি বছর চার কোটির বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠ্যবই দিচ্ছে। বাংলাদেশ কেবল মাথা জিডিপিতেই ভারতের থেকে সামান্য পিছিয়ে। শেখর গুপ্ত বলেছেন, এখন জিডিপিতেও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার খবরে অনেকের (স্বাধীনতাকামী মানুষ) ভেতর নিরব উত্তেজনা কাজ করছে। কারণ, এক সময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতো, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। গৌরবময় হয়েছে বাঙালি জাতি, যা অর্জনে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন শেখ হাসিনা।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নেও শেখ হাসিনা জনগণের ‘জীবন’ ও ‘জীবিকার’ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিঃস্বার্থভাবে নিরলস পরিশ্রম করেছেন, করে যাচ্ছেন। করোনার প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট সংকটের শুরু থেকেই তিনি এ ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জাতির অভিভাবক হিসেবে ৩১ দফা নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন বার বার। 

আমাদের সকল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে পেছনে ফেলে ‘পেটে খেলে পিটে সয়’- স্লোগানকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগ, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাসহ কৃষকের ‘ফসল’ ঘরে উঠেছে একমাত্র শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে। আর কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তার ব্যবস্থা করে ১০ মিলিয়নের বেশি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সরকার। 

অন্যদিকে ৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুরসহ ৫ মিলিয়ন মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা করা হয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক করা ও বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ প্রদান শেখ হাসিনার সফল সিদ্ধান্ত। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। মাদ্রাসা, মসজিদ ও মন্দির থেকে শুরু করে এতিম ও গরিব শিক্ষার্থী, স্কুল শিক্ষক, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ যারা সাধারণভাবে সরকারি সহায়তার আওতাভুক্ত নন, তাদের মধ্যে ২.৫ বিলিয়নের বেশি টাকা সুষ্ঠুভাবে বিতরণও করেছেন। আলোচনা ও সমালোচনার মাঝেও একদিকে নাগরিকের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করেছেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাকাও সচল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

এদিকে, শুধু জিডিপি নয়, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (১৬ অক্টোবর) হাঙ্গার ইনডেক্স প্রকাশ করেছে, এখানেও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অপুষ্টির হার কমিয়ে ক্ষুধা মুক্তির লড়ায়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫, আর ভারতের অবস্থান ৯৪। পাকিস্তানের ৮৮-এর অবস্থান থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, যেখানে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮।

পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিশ্ব সুখ, টিকাদান, শিশুমৃত্যুরোধ ইত্যাদির মতো সমস্ত সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। আর ভারত মাত্র দুটি সূচকে এগিয়ে ছিল, ১. মাথাপিছু আয় ও ২. মানব উন্নয়ন। এবার মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের।

আর তাই শেখ হাসিনার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আর বিচক্ষণ নেতৃত্ব নিয়ে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। আর তাই আইএমএফ-এর পূর্বাভাস প্রকাশের পর ভারতের অনেকেই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল থেকে ‘ভারত পলিসি নির্ধারণ’ করার আহ্বান করেন। আবার বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। আর তাই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিরোধের নানামুখী ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, সীমান্ত হত্যাবন্ধসহ আরও ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তরিকতা নিয়ে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে।

আর বাংলাদেশকে তার সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগানোর উদ্যমী হয়ে পরিকল্পনা করেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতিকে আমরা আগামী বছরগুলোতে কোথায় নিয়ে যেতে চাই, অর্থনীতির চাকা কতটা সচল দেখতে চাই- এই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আমাদের কর্মপন্থা সাজাতে হবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর