৮ নভেম্বর, ২০২০ ১৭:৪৭

কেমন হতে পারে আগামী দিনের বিএমএ?

ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

কেমন হতে পারে আগামী দিনের বিএমএ?

ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

দেখতে দেখতে অনেক বেলা হলো। সামান্য একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশে-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতাও কম হলো না। পেশা ও বাস্তবতার স্বার্থে অস্ট্রেলিয়ায় বসত গড়লেও একটা দিনের জন্যও বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি নি। যখনি পৃথিবীর কোথাও ভালো কিছু দেখি, মনে হয় বাংলাদেশেও তো এরকম করা যেতো। তবে এরকম ভাবার আগে আমি বাংলাদেশের বাস্তবতাটাও বিবেচনায় রাখি। রাতারাতি বাংলাদেশের সবকিছু বদলে যাবে তা যেমন ভাবি না, তেমনি পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছে তাও যেন ঠিকঠাক গতি পায়।

কদিন আগে একটা কাজে অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েই আমার অকারণে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কথা মনে পড়লো। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন আমরা মাঝেমধ্যে বিএমএতে যেতাম। তখন এরশাদের শাসনকাল, সে সময়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিএমএর খুব সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নব্বইয়ে গণঅভূত্থানের মুখে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের মূলেও ছিল বিএমএর স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন এবং শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মদান। নব্বইয়ের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলনের মৃত্যুতে সারা দেশে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছিল। সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল এরশাদের তখতে তাউস।

বিএমএ আমার খুব প্রিয় সংগঠন। এখনো দেশে গেলে বিএমএ ভবনে যাই। অনেক সন্ধ্যায় বসে সবার সাথে আড্ডা দেই, ঝালমুড়ি খাই। কিন্তু আশিনব্বই দশকের সেই বিএমএকে খুঁজে পাই না। ব্যক্তিজীবনে জেনেছি, স্মৃতিকে খুঁজতে যেতে নেই। কোন কিছুই নাকি আর আগের মতো হয় না। কিন্তু এটি একটি শীর্ষ পেশাজীবী সংগঠনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য হবার কথা না।

ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অনেক তফাৎ। যুগের দাবি মিটিয়েই প্রতিষ্ঠানকে চলতে হয়। আর তা যদি হয় বিএমএর মতো পেশাজীবী সংগঠন, তাহলে তো তাকে বিশ্বের চিকিৎসা পেশার অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়েই এগোতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে আমরা ভবিষ্যতে বিএমএর কাছে কেমন ভূমিকা প্রত্যাশা করতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি।

আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সকল চিকিৎসকই সরকারি চাকরিতে ছিলেন। বিএমএর সে সময়ের একুশ দফা বা অন্যান্য দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অধিকাংশই সরকারি চাকরিরত চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল। বর্তমানে দেশে কর্মরত চিকিৎসকদের সংখ্যা পচাঁত্তর হাজারের বেশি, যার অধিকাংশই বেসরকারি খাতে কর্মরত। বিএমএকে এখন আর কেবলমাত্র সরকারি চিকিৎসকদের দাবি দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই চলবে না।

বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত ক্রমশ বিস্তৃত হলেও এখাতের প্রতি না সরকার, না বিএমএ, কারোই পর্যাপ্ত আগ্রহ দেখা যায় না। অথচ এই খাতের ভবিষ্যত সম্ভাবনাও কিন্তু প্রচুর। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সাথে মিলে বিএমএ এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারে। সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে বেসরকারি খাতকে কী করে আরও দায়বদ্ধ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে আরও সম্পৃক্ত করতে পারে, সেটা নিয়ে বিএমএর ভাবা উচিত।

স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সেবা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পেশা। আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানের হলেও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবায় বিশ্বের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। এর জন্য সম্পদের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি নীতি নির্ধারণী বিষয়ে
আমাদের চিন্তা-ভাবনা অনেক পেছানো। স্বাস্থ্যখাতের সামগ্রিক উন্নয়ন ছাড়া জনগণকে মানসম্মত সেবা প্রদান করা কঠিন। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ করলে তাতে না বাড়বে গণসন্তুষ্ঠি, না কমবে চিকিৎসকদের অসন্তোষ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত পুনর্গঠনে বিএমএ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণের চিকিৎসা সেবার মানোন্নত করতে কতকিছু যে করার আছে, বিএমএর উচিত তার কিছুটা অন্তত করা। একবার যদি সেই কাজগুলো শুরু হয়, তাহলে চারদিক থেকে আরও অনেক উদ্যোগী সংগঠন ও মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।

এখনো স্বাস্থ্যখাতের যে কোন ইস্যুতে আমি অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘বিএমএ কী করে?’। অথচ দেখা যায় যে, সে সব বিষয় সম্পূর্ণ সরকারের বা অন্য কারো এখতিয়ার। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়,   সাধারণ জনগণের কাছে বিএমএর গুরুত্ব এখনো অপরিসীম। বিএমএকে তার অবস্থানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। যদিও তারা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান নয়, তবে জনগণ ও চিকিৎসকদের স্বার্থে তাদের কার্যকরী প্রভাবকের ভূমিকা রাখতে হবে। এটাই বিএমএর কাছে সময়ের দাবি।

বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের পদায়নের ব্যাপারে বিএমএ খুব সোচ্চার। এই ইস্যুতে অনেকদিন পরে প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসকদের যৌথ সংগঠন প্রকৃচিও জেগে উঠেছে। অনেক চিকিৎসককেই আমি বলতে শুনেছি, ‘স্বাস্থ্যখাতে আমলাদের পদায়ন ঠেকাতে বিএমএ যতটা তৎপর, চিকিৎসকদের স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ইস্যুতে তারা এতটা সক্রিয় নয় কেন?’। আন্তক্যাডার বৈষম্য নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে কথা বলেন। অনেকেই প্রশাসন ক্যাডারের মত স্বাস্থ্যক্যাডারেও সুযোগ-সুবিধা চান। কিন্তু আমার মনে হয়, বিষয়টা এতো সরল নয়। চরিত্রগতভাবে স্বাস্থ্য ক্যাডার অন্যান্য ক্যাডারের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন তাই সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। হয় বিচার বিভাগের মত স্বতন্ত্র ক্যাডার হিসেবে, নতুবা ক্যাডার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে দেশব্যাপী ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ গড়ে তুলতে হবে।

স্বাস্থ্য প্রশাসন চালানোর জন্য নিজেদের ভেতর থেকেই স্বাস্থ্য-প্রশাসক তৈরি করতে হবে। একজন ব্যস্ত প্রফেসরকে হঠাৎ করে এনে স্বাস্থ্য পরিচালক বা মহাপরিচালক বানিয়ে দিলে যে ভালো ফল পাওয়া যায় না, এটা এতদিনে নিশ্চয়ই আমরা বুঝতে পারছি। এরকম আরও অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে। বিএমএর উচিত হবে, এসব ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে ভাবা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এসব বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা।

দীর্ঘদিন বিএমএর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিএমএ তখনি সফল হয়েছে, যখনি সেখানে একটা টিম হিসেবে সবাই কাজ করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের মত একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সভাপতি থাকা সত্বেও বিএমএতে টিমওয়ার্কটা অনুপস্থিত। অথচ যে কোন সংগঠনের সাফল্যের জন্য টিমওয়ার্ক খুব জরুরি। নিজস্ব কাজ না থাকলে খুব কম চিকিৎসককেই আজকাল বিএমএমুখী হতে দেখা যায়। বিএমএতে এখন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পেশার স্বার্থে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা করার মত লোকের খুব অভাব। দু'বছর আগে অক্টোবর মাসে গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চিকিৎসকদের একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

বিএমএর পক্ষ থেকে তখন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উপস্থাপিত হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনপূর্ব বিধানের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, যদি পুনর্নির্বাচিত হন, তাহলে যেন দাবিগুলো পেশ করা হয়। আমি জানি না, সেদিনের পেশকৃত সেই দাবিগুলো নিয়ে পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কি বিএমএ নেতৃবৃন্দের আর কোন আলোচনা হয়েছিল নাকি?

সবশেষে একটি কথা বলতে চাই। বিএমএ সর্বস্তরের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন। এটি কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন নয়। চিকিৎসকদের রাজনৈতিক আদর্শ চর্চার জন্য স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদসহ (স্বাচিপ) অন্যান্য সংগঠন রয়েছে। গত বিএমএ নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন ডা. জালাল-ডা. দুলাল প্যানেলের ‘রাজনীতি যার যার বিএমএ সবার’স্লোগানটি খুব মনে ধরেছিল। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বিএমএ তার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য অবস্থানটি বজায় রেখেই জনগণের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসকদের পেশার স্বার্থ বজায় রাখবে। চিকিৎসকদের অভিভাবক সংগঠন হিসেবে বিএমএ বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, ভবিষ্যতে বিএমএর কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এন্ড রেস্পন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর)

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর